এরা হয়তো একদিন দেশটাকেই খেয়ে ফেলবে
বাবা-মায়ের সঙ্গে নতুন শহরে যাচ্ছে ছোট্ট মেয়ে চিহিরো। পথ হারিয়ে তারা একটি ছোট্ট বনের ভেতরে ঢুকে পড়ে। সেই বনের ভেতর দিয়ে চলতে চলতে হঠাৎ সামনে দেখে একটি প্রাচীন বাড়ির গেট ও একটি আজব মূর্তি।
চিহিরো পরিবেশ-পরিস্থিতি দেখে ভয় পায়, ফিরে যেতে চায়। বাবা-মা তাকে গাড়িতে থাকতে বলে। ছোট্ট চিহিরোকে তারা বলে, বাড়ির ভেতরটা দেখেই চলে আসবে।
কিন্তু একা ভয় পেয়ে চিহিরো তাদের পিছু নেয়। চিহিরোর বাবা-মা বাড়িটির ভেতরে গিয়ে দেখে, বাড়িটির পেছনে বাইরে যাওয়ার একটি পথ দেখা যাচ্ছে। সেটি দিয়ে এগিয়ে তারা দেখে, সেখানে জনমানবহীন অন্য একটি শহর। শহরটিতে ঢোকা মাত্রই খাবারের সুন্দর ঘ্রাণ পেতে থাকে তারা।
একটু এগিয়েই তারা দেখে, টেবিলে সারি সারি খাবার, কিন্তু চারপাশে কেউ নেই। একটু ডাকাডাকি করে চিহিরোর মা-বাবা ভাবে, খেয়ে নেই, কাউন্টারের লোক এলে বিল দেওয়া যাবে। তারা সুস্বাদু খাবারগুলো খেতে শুরু করে।
ওদিকে চুপচাপ পরিবেশ দেখে চিহিরোর ভয় আরও বেড়ে যায়। বাবা-মাকে ছেড়ে আজব ভীতিকর এলাকাটা একটু ঘুরে ফিরে দেখতে থাকে চিহিরো। এদিকে সুস্বাদু সব খাবার গোগ্রাসে খেতে থাকেন চিহিরোর বাবা-মা। চিহিরো ঘুরে এসে পেছন থেকে দেখে মা-বাবা বেশ মোটা হয়ে গেছে খেতে খেতে। ভয় পেয়ে তাদের ডাকলে তারা ফিরে তাকায়। চিহিরো অবাক হয়ে দেখে, শুকরে পরিণত হয়েছে তার বাবা-মা।
সেই দেশের ডাইনি এভাবে লোভী মানুষদের ধরে এনে খাইয়ে মোটা তাজা করে এবং একদিন রোষ্ট বানিয়ে খেয়ে ফেলে। জাপানের স্টুডিও জিবলির এনিমেটেড ফিল্ম 'স্পিরিটেড অ্যাওয়ে'র গল্পটা এমনই।
আমাদের মধ্যে অনেকেই চিহিরোর বাবা-মায়ের মত শুধু গোগ্রাসে খাচ্ছে। অন্যের জমি, টাকা, সম্পদ, বাড়ি-ঘর সবকিছু খাচ্ছে। এমনকি পার্ক, পাহাড়, নদী, উপকূল ভূমিও বাদ যাচ্ছে না। প্রয়োজন হলে তারা মানুষ ও পশুপাখিও খেয়ে ফেলতে পারে।
যেমন এরাই খেতে উদ্যত হয়েছে ঐতিহাসিক বাহাদুর শাহ পার্ক। পুরান ঢাকার এক চিলতে গাছে ঢাকা জায়গা এই বাহাদুর শাহ পার্ক। খবরে দেখলাম, সম্প্রতি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন 'ফুড ভ্যান' প্রকল্প নামে পার্কের ভেতরে খাবারের দোকান তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে।
এর মানে, মানুষের নিঃশ্বাস নেওয়ার, হাঁটার অবশিষ্ট এই পার্কটুকুও তারা হজম করার পরিকল্পনা করেছে। বাহাদুর শাহ পার্কের চারদিকে নানা ধরনের খাবারের দোকান। এত দোকান থাকার পরেও কেন পার্কের ভেতরে গাছ কেটে খাবারের দোকান বানাতে হবে? স্থানীয় মানুষ অত্যন্ত ক্ষোভ ও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন সিটি করপোরেশনের এই সিদ্ধান্তে।
বাহাদুর শাহ পার্ক শুধু একটি পার্ক নয়। এটি একটি ঐতিহাসিক স্থাপনা। আঠারো শতকের শেষ দিকে এখানে ঢাকার আর্মেনীয়দের বিলিয়ার্ড ক্লাব ছিল, যার স্থানীয় নাম ছিল আন্টাঘর। ১৮৫৮ সালে রানি ভিক্টোরিয়া ভারতবর্ষের শাসনভার গ্রহণ করার পর এই ময়দানেই এ সংক্রান্ত একটি ঘোষণা পাঠ করে শোনান ঢাকা বিভাগের কমিশনার। সেই থেকে এই স্থানের নাম হয় 'ভিক্টোরিয়া পার্ক'।
১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহের পর এক প্রহসনমূলক বিচারে ইংরেজ শাসকেরা ফাঁসি দেয় অসংখ্য সিপাহিকে। তারপর জনগণকে ভয় দেখাতে সিপাহিদের লাশ এনে ঝুলিয়ে দেওয়া হতো এই ময়দানের বিভিন্ন গাছের ডালে। ১৯৫৭ বা ১৯৬১ সালে সিপাহি বিদ্রোহের শতবার্ষিকী পালন উপলক্ষে এখানে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করে পার্কের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় বাহাদুর শাহ পার্ক। সিপাহি বিদ্রোহ অনুষ্ঠিত হয় ইংরেজ শাসনের সমাপ্তি ঘটিয়ে মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহের শাসন ফিরিয়ে আনার জন্য। তাই তার নামানুসারে এর নতুন নামকরণ করা হয় 'বাহাদুর শাহ পার্ক'।
শুধু কী বাহাদুর শাহ পার্ক? কক্সবাজারের বনাঞ্চলের ভেতর উন্মুক্ত কারাগার বানাতে চায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা বিভাগের অধীনে থাকা কারা অধিদপ্তর। এ লক্ষ্যে কারা অধিদপ্তরকে উখিয়া উপজেলার পাগলীবিল এলাকায় সংরক্ষিত বনের ১৬০ একর বনভূমি বরাদ্দ দিয়েছে কক্সবাজার জেলা প্রশাসন।
চারদিকে এত জায়গা থাকতেও কেন একটি সংরক্ষিত বনের ভেতরে কারাগার স্থাপন করতে হবে, বুঝতে পারছি না। এমনিতেই বাংলাদেশে বনভূমির পরিমাণ প্রয়োজনের তুলনায় অনেক অনেক কম। সেখানে বনভূমি কেটে কারাগার!
এই বরাদ্দ দেওয়ার ক্ষেত্রে বিদ্যমান আইন, জাতীয় বননীতি, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের পরিপত্র ও উচ্চ আদালতের রায় অমান্য করা হয়েছে বলে বন বিভাগ অভিযোগ করেছে। জেলা প্রশাসনের এই ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার কারণ কী হতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়। সেই লোভ। কারো না কারো লোভ হয়েছে বনভূমি গ্রাস করার।
বাংলাদেশ স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে কপ-২৬ জলবায়ু শীর্ষ সম্মেলনে গিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু '২০৩০ সালের মধ্যে বন উজাড় বন্ধে আন্তর্জাতিক ঘোষণার' সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করতে পারেনি। ১১৪টি দেশের নেতারা বন উজাড় রোধে চুক্তিতে সই করলেও, সেই তালিকায় ছিল না বাংলাদেশ। কেন বাংলাদেশ এরকম একটা জনগুরুত্বপূর্ণ চুক্তিতে সই করলো না? কারণ সর্বগ্রাসী লোভ আমাদের তাড়িত করছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে শীর্ষ ক্ষতিগ্রস্ত দেশ বাংলাদেশ। অথচ বন উজাড়, নদী ভরাট, পাহাড় কাটা, বনভূমি দখল করে সাফারি পার্ক বানাতে আমরা পিছপা হই না। এর আগে আমরা দেখেছি সংরক্ষিত বন উজাড় করে ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক বানাতে চেয়েছে বিসিক।
৪০০ কোটি টাকা প্রস্তাবিত বাজেটে মধুপুর শালবনের ২১৪ একর বন উজাড় করে ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক বানানোর আবদার জানিয়েছিল বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক)। তারা নির্বোধের মতো যুক্তি দেখিয়েছে, দেশের সর্বশেষ সমতল বনের মধ্যে অন্যতম এই শালবন অযথা পড়ে আছে। তাই তারা এই শালবনে ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক তৈরি করতে চাইছে।
আশঙ্কার কথা হচ্ছে, যেহেতু বাংলাদেশ বন উজাড় বন্ধ সংক্রান্ত চুক্তিতে সই করেনি, কাজেই যেকোনো কারণ দেখিয়ে এই শালবন উজাড় হয়েই যেতে পারে। হয়তো কক্সবাজারের সংরক্ষিত বনে গাছ কেটে কারাগারও হয়ে যাবে।
পরিবেশবাদীদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা এবং স্থানীয় জনগণের তীব্র আপত্তি ও প্রতিবাদ সত্ত্বেও সরকার ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান পরিবেশগতভাবে বিপন্ন এলাকায় নানা প্রকল্প গ্রহণ করেই চলেছে।
চলতি বছরের শুরুতে ৮৪৬ কোটি ২৫ লাখ টাকা ব্যয়ে মৌলভীবাজারের জুড়ীতে এক সাফারি পার্কের মহাপরিকল্পনা চূড়ান্ত করেছে বন অধিদপ্তর। জুড়ীতে লাঠিটিলা সংরক্ষিত বনের এলাকায় ওই পার্কে মূলত বিদেশি প্রাণী আনা হবে।
মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী, সাফারি পার্কটিতে বন্যপ্রাণী বাবদ ২০৩ কোটি ৪০ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এর আওতায় কত প্রাণী আসবে, কতজন বাঁচবে, কতজন যত্নআত্তি পাবে, এই বিষয়গুলো স্পষ্ট না হলেও, ব্যয়িত অর্থ যে কারো না কারো পেটে ঢুকে যাবে, তা এই মহাপরিকল্পনা দেখেই বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না।
বন উজাড়, পাহাড় কাটা ও নদী দখলের মূল কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে অন্যের জমি বা সরকারি সম্পত্তি আত্মসাৎ। বন সংরক্ষণ ও উন্নয়নের কথা বলে এ যাবৎকালে বনভূমি দখল করা হলেও, আদতে উদ্দেশ্য ছিল নৃ-গোষ্ঠীর মানুষের উচ্ছেদ এবং বনভূমি গ্রাস করা। আমরা বনভূমি খেয়ে সাফারি পার্ক বানাই। একটার পর একটা পশুর মৃত্যুতে দেশের সাফারি পার্কের মান, প্রাণীদের খাবার ও চিকিৎসকের মান, সার্বিক তত্ত্বাবধানের দুর্বলতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, কিন্তু কোনো ফয়সালা হয়নি।
আমাদের দেশে 'খেকো' মানুষের সংখ্যা এত বাড়ছে যে সংরক্ষিত এলাকা এবং আইনগতভাবে ঘোষিত অভয়ারণ্যও এরা হজম করে ফেলছে। আমাদের নদী দূষিত, আমাদের বাতাস দূষিত, অ-বসবাসযোগ্য একটি নগরীতে আমরা বাস করি, কিন্তু এরপরেও কোনো বিকার নেই। এ দেশের সর্বভুক লোভী মানুষগুলো গোগ্রাসে খাওয়া থামাতে পারছে না।
তবে এই খাওয়াতে দেশের সাধারণ মানুষের, যেমন: জেলে, কৃষক, রিকশাচালক, ছোটখাট চাকুরে, পেশাজীবী, দোকানদার, কুলি-মজুর, মাঝি, কামার-কুমার, দলিত-হরিজনের কোনো অংশগ্রহণ নেই। একশ্রেণীর ধনী, লুটেরা, অসৎ ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ, আমলা, ক্ষমতাধর মানুষ দেশের সম্পত্তি গোগ্রাসে গিলছে। একই দেশ, একই সমস্যা, অথচ মানুষের জীবনবোধ ও সমস্যার কত ফারাক, কতটা বৈপরীত্য!
দেশে বাড়ি ভাড়া, চিকিৎসা, পরিবহন, খাবার, পোশাক, বিনোদন— সবকিছুর দাম ক্রমাগত বাড়ছেই। সাধারণ মানুষের জীবন অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে। অথচ এই দেশেই এমন একটা ভোগবাদী শ্রেণী গড়ে উঠেছে, যারা শুধুই খাই খাই করছে। এভাবে খেতে খেতে তারা দেশের প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করছে, নীতি-নৈতিকতাকে কবর দিচ্ছে, শিক্ষা ব্যবস্থাকে নষ্ট করছে, বাজার ব্যবস্থাকে অসম করে তুলেছে, ঘুষ-দুর্নীতির চর্চা করে নিজেদের উদরপূর্তি করছে। এ একটা ভয়াবহ চক্র।
সিনেমার চিহিরো নামের সেই ছোট্ট মেয়েটি অনেক চেষ্টা করে শেষপর্যন্ত তার লোভী বাবা-মাকে ডাইনির হাত থেকে ফিরিয়ে আনতে পেরেছিল। আমাদের দেশের এসব দুর্নীতিপরায়ণ লোভী মানুষের সন্তানরা কি পারবে চিহিরোর মতো তাদের লোভী বাবা-মাকে ফিরিয়ে আনতে? নাকি তারাও গা ভাসিয়ে দেবে সেই পথেই?
শাহানা হুদা রঞ্জনা, সিনিয়র কোঅর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)
Comments