খেলার মাঠ রক্ষায় জনআন্দোলন

২০২২ সালের ২৫ এপ্রিল বিকেল ৪টার দিকে তেঁতুলতলা মাঠে গিয়ে দেখা যায়, নির্মাণ কাজ চলছে। অন্যদিকে বিভিন্ন সংগঠনের কর্মী ও এলাকাবাসী মাঠ রক্ষায় আন্দোলন করছেন। তাদের পেছনে পুলিশ বসে আছে। ছবি: স্টার

পৃথিবীর সর্বপ্রাচীন 'খেলার মাঠ' কোনটি? দুনিয়ার তাবৎ 'খেলার মাঠ' মানবসভ্যতার বিবর্তন ও ক্রমবিকাশের সাক্ষী। এক একটি খেলার মাঠ এক এক অঞ্চলের সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও পরিবেশগত ইতিহাস।

মূলত শারীরিক ও মানসিক বিনোদন ও সুরক্ষায় গড়ে ওঠা 'খেলার মাঠ'গুলো বহু স্মৃতি-বিস্মৃতির দলিল। খেলার মাঠেই বহু শিশুর সামাজিক পাঠ হয়। বন্ধুত্ব, বনিবনা, মনোমালিন্য, হারজিত, দ্বন্দ্ব রূপান্তর, নেতৃত্ব, দাদাগিরি, সহানুভূতি, তর্ক, সংঘাত কিংবা ভাগাভাগির সংস্কৃতি সবই থাকে খেলার মাঠে।

'খেলার মাঠ' প্রাকৃতিকভাবে গড়ে ওঠে না, প্রকৃতির মাঝেই এটি সামাজিক নির্মাণ। ১৮৫৯ সালে ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টারে এক প্রাচীন খেলার মাঠ গড়ে ওঠে। ১৮৮৫ সালে জার্মানি, ১৮৮৬ সালে আমেরিকার বোস্টন কিংবা ১৮৮৯ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার পোর্ট এলিজাবেথের সেন্ট জর্জেস পার্ক মাঠের মতো বহু প্রাচীন খেলার মাঠ আছে দুনিয়া জুড়ে।

বাংলাদেশের প্রাচীন খেলার মাঠ কোনটি?

হয়তো প্রত্নতাত্ত্বিক, নৃবিজ্ঞানী কিংবা ইতিহাসবিদেরা দেশের প্রাচীন খেলার মাঠ নিয়ে কাজ শুরু করবেন। বাংলাদেশের খেলার মাঠগুলোর নামকরণ, ইতিহাস, বিবরণ, সংকট ও রূপান্তর নিয়ে কোনো খতিয়ান কি গবেষণা খুঁজে পাওয়া কঠিন? হয়তো কোনো গ্রামে, পাহাড়ে কিংবা নদীর তীরে বা প্রাচীন বৃক্ষকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে কোনো খেলার মাঠ। হয়তো কিছু শিশু কোনো ছোট্ট জমিনে কোনো একদিন দাড়িয়াবান্ধা, বৌচি, পাতাপলান্তি কিংবা গোল্লাছুট খেলা শুরু করেছিল। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে সেটিই একসময় সবার খেলার মাঠ হয়ে ওঠে। মুখে মুখে এই মাঠ একটি নাম নিয়ে বড় হয়ে ওঠে।

কেবল খেলা নয়, দেশের অনেক মাঠ নানা সামাজিক পর্ব, ধর্মীয় কৃত্য, জমায়েত ও গণআন্দোলনেও ভূমিকা রাখে। আবার কখনো আমন ও বোরো মওসুমের ধান কাটার পর হাওর ও বিলজমিন মৌসুমি খেলার মাঠ হয়ে ওঠে। 'খেলার মাঠ' এক জীবন্ত সত্ত্বা। মানুষের প্রতিদিনের ক্রীড়া, কসরততে খেলার মাঠ 'খেলার মাঠ' হিসেবে জীবন্ত থাকে।

মানবসভ্যতার অবিচ্ছেদ্য সঙ্গী এই খেলার মাঠের গুরুত্ব নিয়ে আলাদা আলাপের দরকার আছে কি? উনিশ শতকে উন্নয়ন মনস্তত্ত্ববিদ ফ্রেডরিক ফ্রোবেল শিশুদের মনোসামাজিক বিকাশ ও সুস্বাস্থ্যের জন্য 'খেলার মাঠের' গুরুত্ব তুলে ধরেন। ২০২২ সালের ১১ মে জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও শিশুদের মানসিক ও শারীরিক বিকাশের জন্য প্রতিটি এলাকায় খেলার মাঠের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন। প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেন, সরকার যেখানেই খালি জায়গা পাচ্ছে সেখানেই খেলার মাঠ করে দিচ্ছে।

দেশ-দুনিয়া জুড়ে সবাই খেলার মাঠের গুরুত্ব বুঝলেও কিছু মানুষ ও প্রকল্প বাংলাদেশের সব খেলার মাঠ চুরমার করে দিচ্ছে। নগরায়ণ, শিল্পায়ন, দখল কিংবা অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রকল্পের কারণে আমাদের স্মৃতিময় খেলার মাঠগুলো আজ বিপদে। খেলার মাঠ বাঁচাতে দেশজুড়ে আজ লড়ছে মানুষ। যদিও খেলার মাঠ রক্ষায় জনআন্দোলন নতুন ঘটনা নয়। ১৯০৬ সালে কানাডার নোভা স্কশিয়াতে গড়ে ওঠা খেলার মাঠ রক্ষা আন্দোলন কিংবা বাংলাদেশের তেঁতুলতলা মাঠ রক্ষা আন্দোলন এক গর্বিত উদাহরণ।

বলাইশিমূল মাঠ রক্ষায় আজ জাগছে আরেক জনআন্দোলন। নেত্রকোণার কেন্দুয়ার এই শতবর্ষী মাঠের ঐতিহ্য বিনষ্ট করে গড়ে তোলা হয়েছে ভূমিহীন গরিব মানুষের জন্য সরকারি আশ্রয়ণ প্রকল্প। চলতি আলাপখানি বলাইশিমূল মাঠ রক্ষার আন্দোলনে একাত্ম হয়ে দেশের সব খেলার মাঠ সুরক্ষার দাবি তুলছে।

বলাইশিমুল মাঠ, কেন্দুয়া, নেত্রকোণা

নেত্রকোণার কেন্দুয়ার বলাইশিমূল ইউনিয়নে এক শতবর্ষী খেলার মাঠের নাম বলাইশিমূল মাঠ। এই মাঠে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় ১০০টি গৃহ নির্মাণের জন্য একটি প্রকল্প গৃহীত হয়। বলাইশিমূল মৌজায় ৮৫ একর খাসজমির ভেতর আশ্রয়ণ প্রকল্পের জন্য ১০ একর জমি থাকা সত্ত্বেও প্রশাসন খেলার মাঠের এক একর ৮০ শতাংশ ভূমিতে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর নির্মাণ করছেন। শুরু থেকেই খেলার মাঠ রক্ষায় এলাকাবাসী আন্দোলনে নামে এবং স্থানীয় প্রশাসন এলাকাবাসীর দাবিকে গুরুত্ব না দিয়ে ২৩টি ঘর নির্মাণের কাজ শুরু করে।

২০২২ সালের ১২ আগস্ট রাতে বলাইশিমূল মাঠে নির্মাণাধীন আশ্রয়ণ প্রকল্পের ৭ ও ৮ নম্বর ঘরে আগুন লাগে। এর পরিপ্রেক্ষিতে পরদিন আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আন্দোলনকারীদের হুমকি দেন। নির্মাণকাজ বন্ধ না হওয়ায় আন্দোলনকারীদের পক্ষে হাবিবুর রহমান মন্ডলসহ ৮ জন বাদী হয়ে ২০২২ সালের ৩০ মে জেলা প্রশাসক, উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউএনও, সহকারী কমিশনারকে (ভূমি) আসামি করে আদালতে মামলা দায়ের করেন।

মামলা বিচারাধীন থাকলেও প্রশাসন পুলিশি পাহারায় নির্মাণ কাজ অব্যাহত রাখে। ২০২২ সালের ২ জুন রাতে নির্মাণাধীন ঘরের গাঁথুনি কারা যেন ভেঙে দেয়। ৩ জুন প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা কার্যালয়ের উপসহকারী প্রকৌশলী বাদী হয়ে বলাইশিমূলের ১৯ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। মামলায় বলাইশিমূল ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আলী আকবর তালুকদার ও ৫ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক ইউপি সদস্য হায়দার আলী তালুকদারকে গ্রেপ্তার করা হয়, বর্তমানে তারা জামিনে আছেন।

মাঠরক্ষা গণকমিটির আহ্বায়ক আবুল কালাম আল আজাদ, আবদুল আওয়াল মাস্টার, মামুনুর রহমান খান হলিসহ ৬২ জনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। ২০২২ সালের ১ জুলাই বলাইশিমূল মাঠ রক্ষায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে একটি মানববন্ধন হয়। ১২ জুলাই কেন্দুয়ায় হাজারো মানুষ মানববন্ধন ও বিক্ষোভ মিছিল করেন।

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির (বেলা) আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ১৪ আগস্ট হাইকোর্ট বলাইশিমূল মাঠে নির্মাণকাজের ওপর ৩ মাসের নিষেধাজ্ঞা দেন। কিন্তু খেলার মাঠের শ্রেণী পরিবর্তন করে এখন এটিকে 'কান্দা জমি' হিসেবে দেখানো হচ্ছে।

সাংবাদিককে মামলার হুমকি দেওয়ায় কেন্দুয়ার ইউএনওকে সতর্ক করেছেন জেলা প্রশাসক। ১৯ আগস্ট বলাইশিমূল ইউনিয়নের ২৮ গ্রামের মানুষ এক গণবৈঠকে কেন্দুয়ার ইউএনও মাহমুদা বেগমকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে এবং ২৪ আগস্ট তার বদলি হয় মদনে। পরবর্তীতে তাকে চট্টগ্রামে বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে পদায়ন করা হয়।

বলাইশিমূল ঈদগাহ ময়দানে মাঠরক্ষা গণকমিটি ২ সেপ্টেম্বর এক সমাবেশের আয়োজন করে। তেঁতুলতলা মাঠ রক্ষাকর্মী, পরিবেশবিদ, সংস্কৃতিকর্মী, মানবাধিকার কর্মীরা এতে সংহতি জানান।

তেঁতুলতলা মাঠ, কলাবাগান, ঢাকা

দীর্ঘদিন কোনো এলাকা খেলার মাঠ, ঈদগাহ বা অন্য কোনো জনস্বার্থমূলক কাজে ব্যবহার করলে সেটি পাবলিক উন্মুক্ত স্থান হিসেবে গণ্য হয়ে যায়। কলাবাগানের তেঁতুলতলা মাঠটিও এমনি এক উন্মুক্ত খেলার মাঠ। খসড়া ডিটেইল এরিয়া প্ল্যানে (ড্যাপ) এই মাঠকে উন্মুক্ত স্থান হিসেবেই দেখানো হয়েছে। একসময় ডিপার্টমেন্ট অব আর্কিটেকচার এই মাঠটিকে খেলার মাঠ হিসেবে রাখার জন্য গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছিল।

তেঁতুলতলা মাঠে কলাবাগান থানা ভবন নির্মাণের বরাদ্দ পায় পুলিশ। ২০২২ সালের ৩১ জানুয়ারি মাঠটিকে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঘেরাও দেওয়া হয়। এর প্রতিবাদে এলাকার শিশু-কিশোররা সারাদিন সেখানে খেলাধুলা করে। রাতে ৩ শিশুকে ধরে পুলিশ মাঠে নিয়ে কানে ধরে ওঠবস করায় এবং 'মাঠ চাই না' এমন স্বীকারোক্তি নেয়।

শিশুদের শাস্তি দেওয়ায় কলাবাগান থানার এসআইসহ ৩ কনস্টেবলকে প্রত্যাহার করা হয়। ডিএমপির পক্ষ থেকে 'তেঁতুলতলা মাঠ কলাবাগান থানা ডিএমপি ঢাকার নিজস্ব ভবন নির্মাণের জন্য নির্ধারিত' এমন একটি সাইনবোর্ড টানানো হয়। এরপর থেকেই তেঁতুলতলা মাঠ রক্ষায় আন্দোলনে নামে এলাকাবাসী। ২০২২ সালের ২৪ এপ্রিল পুলিশ মাঠে প্রাচীর নির্মাণের কাজ শুরু করলে উদীচী শিল্পী গোষ্ঠীর কর্মী সৈয়দা রত্না তার পুত্রসহ সেখানে গিয়ে ফেসবুক লাইভ শুরু করেন। পরে পুলিশ তাদের ধরে থানায় নিয়ে যায়।

এ নিয়ে অনলাইন ও অফলাইনে তর্ক-ক্ষোভ শুরু হলে ১৩ ঘণ্টা পর পুলিশ মুচলেকা নিয়ে তাদের ছেড়ে দেয়। পরবর্তীতে তেঁতুলতলা মাঠে থানা ভবন না করে শিশুদের খেলার মাঠ হিসেবেই রক্ষা করার নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী।

মান্দারী মাঠ, লক্ষ্মীপুর

১৯৪৬ সালে লক্ষ্মীপুরে প্রতিষ্ঠিত হয় মান্দারী বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়। বিদ্যালয়ের মান্দারী মাঠটি বেশ প্রাচীন। সরকারিভাবে প্রায় ৮৫ লাখ টাকা মান্দারী বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের ভবন নির্মাণের জন্য বরাদ্দ হয়। ভবন নির্মাণের জন্য মাটি পরীক্ষা হয়। কিন্তু মাটি পরীক্ষার স্থানে ভবন নির্মাণ না করে বিদ্যালয়ের প্রাচীন খেলার মাঠটি দখল করে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ভবন নির্মাণ কাজ শুরু করে। বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানায়, ভবন নির্মাণের জন্য মাঠের পশ্চিম পাশ থেকে ৩০ ফুট জায়গা নিয়ে পূর্ব পাশে ৩৬-৪০ ফুট জায়গা ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। মাঠটি রক্ষায় শিক্ষার্থীসহ এলাকাবাসী আন্দোলন শুরু করে। ২০২২ সালের ১৪ জুন বিদ্যালয়ের সামনে শিক্ষার্থী ও এলাকাবাসীসহ ১৫টি ক্লাবের উদ্যোগের এক মানববন্ধন হয়।

বাইট্টাপাড়া মাঠ, লংগদু, রাঙামাটি

পার্বত্য রাঙামাটিতে সমতল খেলার মাঠ খুব বেশি নেই। লংগদুর বাইট্টাপাড়া মাঠটি এলাকার শিশু, কিশোর, যুবকদের খেলাধুলায় দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। খেলার মাঠে একটি মডেল মসজিদ নির্মাণের পরিকল্পনা হয় এবং মাঠটিকে বাঁচিয়ে মাঠের পাশেই এই মসজিদ নির্মাণের দাবি জানান এলাকার জনগণ। এ নিয়ে ২০২২ সালের ১১ মে লংগদু উপজেলা চত্বরে 'মাঠ বাঁচাও, প্রজন্ম বাঁচাও' দাবি নিয়ে 'সর্বস্তরের সচেতন নাগরিক সমাজ' এক মানববন্ধন করে। আন্দোলনকারীদের পক্ষ থেকে মাঠটিকে রক্ষা করে অন্যত্র মসজিদ নির্মাণের দাবি জানিয়ে ইউএনওর মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি পেশ করা হয়।

এমসি কলেজ মাঠ, টিলাগড়, সিলেট

সিলেটের মুরারীচাঁদ কলেজ বা এমসি কলেজ দেশের এক ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং প্রতিষ্ঠাকালের দিক থেকে এটি দেশের সপ্তম প্রতিষ্ঠিত কলেজ। শিক্ষানুরাগী রাজা গিরিশচন্দ্র রায়ের অনুদানে তার প্রমাতামহের নামে এটি ১৮৯২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই এমসি কলেজের মাঠ এলাকার এক উল্লেখযোগ্য উন্মুক্ত খেলার মাঠ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। কিন্তু সম্প্রতি এই মাঠ দখল ও বিনষ্ট করে কিছু অপরিকল্পিত নির্মাণ কাজ শুরু হয়। রাতের বেলায় মাঠের বাউন্ডারির ভেতরে এসে ড্রেন করার নামে বিরাট এক খাল খনন করার কাজ শুরু করে ভূমিদস্যুরা। প্রায় ১০ ফুট প্রস্থ ও ৫৯৪ ফুট দীর্ঘ এক খাল খনন শুরু হয়।

শতবর্ষী প্রাচীন এই মাঠ রক্ষায় আন্দোলন শুরু হয়। ২০২২ সালের ১৬ এপ্রিল এমসি কলেজের মাঠ রক্ষার দাবিতে মানববন্ধন করেন শিক্ষার্থী ও শিক্ষকেরা। সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র এই আন্দোলনে উপস্থিত হয়ে সংহতি জানান। আন্দোলনকারীরা মাঠ রক্ষায় বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক, ডিআইজি, মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার বরাবর স্মারকলিপি পেশ করেন।

হলদিঘর মাঠ, শাহজাদপুর, সিরাজগঞ্জ

সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরের বলদীপাড়া-হলদিঘর গ্রামের হলদিঘর মাঠ এক ঐতিহ্যবাহী মাঠ। এই মাঠে ভূমিহীনদের জন্য একটি আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর নির্মাণ করতে গেলে এলাকাবাসীর সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়ায় স্থানীয় প্রশাসন। ঐতিহ্যবাহী এ মাঠ রক্ষায় ঐক্যবদ্ধ হয় মানুষ। ২০২২ সালের ১১ জুলাই শতবর্ষী এ মাঠ রক্ষায় অনুষ্ঠিত হয় বিশাল সমাবেশ ও মানববন্ধন। ২০২২ সালের ২১ আগস্ট আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষে আহত হন নারী-শিশুসহ গ্রামবাসী অনেকেই এবং সহকারী কমিশনার (ভূমি)। সহকারী কমিশনার (ভূমি) ৫৪ জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাত আরও ১২০ জনকে আসামি করে থানায় মামলা করে।

এ ঘটনায় পুলিশ দুগ্ধপোষ্য শিশুসহ ওজুফা বেগম, ঝর্ণা বেগম, ফুল পরী, মালেকা বেগম, খুশি বেগম, আখলিমা খাতুন, সফিয়া খাতুনসহ মোট ৯ জনকে গ্রেপ্তার করে জেলহাজতে পাঠায়। দুগ্ধপোষ্য শিশুসহ আটকের কারণে বিতর্ক ওঠায় ৩ দিন পরে নারীদের জামিন হয়। খেলার মাঠ রক্ষা করে অন্যত্র আশ্রয়ণ প্রকল্প করা, মামলা প্রত্যাহার এবং গ্রেপ্তারকৃতদের নিঃশর্ত মুক্তির আবেদন জানিয়ে বিবৃতি দেন দেশের নাগরিকরা।

বকশিবাজার মাঠ, ঢাকা

পুরনো ঢাকার বকশিবাজার মাঠ এক গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন। সরকারি মাদরাসা-ই-আলিয়া এবং নবকুমার স্কুল সংলগ্ন এ মাঠে বিভিন্ন সময়ে অস্থায়ী স্থাপনা তৈরি করে নানাভাবে এর দখল নিচ্ছে বেশ কিছু মানুষ। আশেপাশে আর কোনো মাঠ নেই, এমনকি অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বাৎসরিক ক্রীড়া অনুষ্ঠানও এখানেই হয়। মাঠটি রক্ষায় পরিবেশবাদী, শিক্ষার্থী, ক্রীড়ামোদী ও এলাকার মানুষ আন্দোলনে নামে। ২০১৮ সালের ১১ নভেম্বর মাঠ রক্ষায় এক মানববন্ধন হয়।

আলিগঞ্জ মাঠ, ফতুল্লা, নারায়ণগঞ্জ

নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার আলীগঞ্জ এক ঐতিহ্যবাহী খেলার মাঠ। ঢাকার পোস্তগোলা থেকে ফতুল্লার পঞ্চবটী এলাকার প্রায় ২০ লাখ মানুষের জন্য এই একটি পাবলিক মাঠই এখনও টিকে আছে। কিন্তু প্রাচীন এই মাঠে সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য ১৫তলা বিশিষ্ট ৮টি ভবন নির্মাণের এক প্রকল্প প্রস্তাবিত হয়েছে, যেখানে প্রায় ৬৭২টি ফ্ল্যাট থাকবে। শুরু হয় আলিগঞ্জ মাঠ রক্ষা আন্দোলন, মানববন্ধন, সড়ক অবরোধসহ নানা কর্মসূচি। ২০১৯ সালের ২৮ মে প্রশাসন আবাসন প্রকল্পের কাজ শুরুর জন্য মাঠে গেলে আন্দোলনকারীদের বাধার মুখে ফিরে যেতে বাধ্য হন।

মাঠ রক্ষায় ২৫ হাজার গণস্বাক্ষর জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর কাছে জমা দেন আন্দোলনকারীরা। মাঠ রক্ষায় উচ্চ আদালতে একটি রিটও হয়েছে, আদালতের নির্দেশে নির্মাণ কাজ স্থগিত আছে।

ধূপখোলা মাঠ, ঢাকা

পুরনো ঢাকার ধূপখোলা মাঠ ঢাকা মহানগরীর সর্ববৃহৎ মাঠ। পুরানো ঢাকার ৭টি থানার শিশু-কিশোর-যুবকরা এই মাঠে খেলা করে। প্রবীণ, নারী ও নগরবাসী এখানে অবসর ও স্বাস্থ্য সুরক্ষার কাজে আসে। মাঠটি ৩টি ভাগে বিভক্ত। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় খেলার মাঠ, ইস্ট অ্যান্ড ক্লাব মাঠ ও স্থানীয় খেলার মাঠ।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৪৫ নম্বর ওয়ার্ডের অন্তর্ভুক্ত ৭ দশমিক ৪৭ একর আয়তনের এই ঐতিহ্যবাহী মাঠটি নানা অপরিকল্পিত উন্নয়নের ফলে হুমকির মুখে। ২০১৬ সালে এখানে একটি বাণিজ্যিক শিশুপার্ক নির্মাণের উদ্যোগ নিলে এই মাঠ রক্ষায় আন্দোলনে নামে নগরবাসী। আন্দোলনের কারণে শিশুপার্ক স্থগিত হয়ে যায়।

জনআন্দোলনের কারণে মাঠ দখল করে নির্মাণ প্রকল্প বন্ধ থাকলেও ২০২১ সালে সিটি করপোরেশন পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র ছাড়াই মাঠের ভেতর বহুতল বাণিজ্যিক মার্কেটের কাজ শুরু করে। এ কারণে মাঠের প্রায় শূন্য দশমিক ৬২ শতাংশ জায়গা কমে যাবে। মাঠ রক্ষায় বেলা সংশ্লিষ্টদের লিগ্যাল নোটিশ দিয়েছে।

বড়গোপটিলা মাঠ, তাহিরপুর, সুনামগঞ্জ

তাহিরপুরের উত্তর বড়দল ইউনিয়নের রাজাই মৌজায় অবস্থিত লাউড়ের গড়ের এক সুপ্রাচীন পাবলিক খেলার মাঠের নাম 'বড়গোপটিলা মাঠ'। এটি কেবল নিছক খেলার মাঠ নয়, লাউড়-মাহারাম অরণ্যের শেষ প্রাকৃতিক স্মৃতিচিহ্ন। অভিন্ন যাদুকাটা নদী লাগোয়া প্রায় ৩১২ একর ১ নম্বর খাস খতিয়ান লাউড়ের গড় টিলায় মাঠটি অবস্থিত।

স্থানীয় মান্দি, হাজং জনগোষ্ঠী এই মাঠটির পত্তন করলেও পরবর্তীতে এই মাঠ দখলে নানা সময়ে মরিয়া হয়েছে এলাকায় নয়াবসতি স্থাপনকারী বাঙালিরা। মাঠ রক্ষায় আন্দোলনকারীরা ২০২০ সালের ৭ সেপ্টেম্বর মাঠটি ফেরত চেয়ে উপজেলা প্রশাসন, পুলিশ ও জনপ্রতিনিধির কাছে আবেদন করে। ১৩ সেপ্টেম্বর এ নিয়ে এক সালিশ বৈঠক হয়। আন্দোলনের মুখে স্থানীয় জনগণের ব্যবস্থাপনায় আবারো মাঠটি ফেরত দেওয়া হয়।

নামোভদ্রা মাঠ, রাজশাহী

রাজশাহীর নামোভদ্রা এলাকায় গড়ে উঠেছে শহরের বর্ধিত আবাসিক প্রকল্প এবং এখানেই গড়ে উঠেছে দরিদ্র মানুষের বহু নগরবস্তি। নামোভদ্রা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একটি ছোট খেলার মাঠ আছে। এই মাঠেই এলাকার শিশু-কিশোররা খেলা করে। এই বিদ্যালয়ের মাঠ দখল করে প্রভাবশালীদের রাস্তা নির্মাণের অভিযোগ উঠেছে।

মাঠ বাঁচাতে ২০২২ সালের ২০ মার্চ গণমাধ্যমের কাছে আকুল আর্তি জানায় শিশুরা। এর আগেও রাজশাহীতে বিদ্যালয়ের খেলার মাঠ বাঁচাতে আন্দোলনে নামে শিক্ষার্থী ও নাগরিক সমাজ। রাজশাহী মহানগরীর উপশহরে বিদ্যালয় মাঠে শিক্ষা অধিদপ্তরের শিক্ষা ভবন নির্মাণের প্রতিবাদে ২০১৬ সালের ২৫ জানুয়ারি ক্রীড়াবিদসহ নানা শ্রেণী-পেশার মানুষ মানববন্ধন করেন।

ভেড়ভেড়ী মাঠ, কিশোরগঞ্জ, নীলফামারী

নীলফামারীর কিশোরগঞ্জের পুটিমারী ইউনিয়নের ভেড়ভেড়ী মাঝাপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠটি ভেড়ভেড়ী মাঠ নামে পরিচিত। প্রাচীন এই খেলার মাঠটি এলাকার শিশু-কিশোর-যুবক-প্রবীণের প্রাণ। অপরিকল্পিতভাবে মাটি কেটে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ৪তলা ভবন নির্মাণের নামে মাঠটির বৈশিষ্ট্য বিনষ্টের প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু করে।

মাঠ রক্ষায় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে এলাকাবাসী আন্দোলনে নামে। ২০১৯ সালের ১৫ এপ্রিল তারা বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করে। পরবর্তীতে প্রশাসন বরাবর স্মারকলিপি পেশ করে।

তারুলী মাঠ, ঝালকাঠি

ঝালকাঠি সদরের তারুলী প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের উন্মুক্ত মাঠটি আরও সম্প্রসারিত করতে চান বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। বিদ্যালয়ের জন্য ১২ জন জমি দান করেছিলেন। জমিদাতাদের ২ জন ওয়ারিশ খেলার মাঠ সম্প্রসারণে বাধা দেন। তারুলী মাঠ রক্ষায় প্রশাসনের হস্তক্ষেপ প্রত্যাশা করে শিক্ষার্থী ও এলাকাবাসী মিছিল, সমাবেশ শুরু করে। ২০২২ সালের ২৯ আগস্ট কেওড়া-ঝালকাঠি সড়কে তারা মানববন্ধন করেন।

শমসের গাজী দীঘি মাঠ, ছাগলনাইয়া, ফেনী

ফেনীর ছাগলনাইয়ার শুভপুর ইউনিয়নের সোনাপুর গ্রামের ঐতিহাসিক শমসের গাজী দীঘির পাশে খেলতে খেলতে এক মাঠের জন্ম হয়েছে বহু আগে। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত এই মাঠ দেশ স্বাধীনের পর থেকে পাবলিক খেলার মাঠ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। নানা সময়ে এই মাঠ দখলের পাঁয়তারা হয়েছে। এলাকাবাসী বাধা দিয়েছেন।

সম্প্রতি সোনাপুর গ্রামের হামরুল ইসলাম চৌধুরী ও তার সহযোগীরা গর্ত করে মাঠে গাছ লাগাবেন বলে মাঠটি দখলের চেষ্টা চালাচ্ছে। মাঠ রক্ষায় আন্দোলনে নামে সোনাপুর, জগন্নাথপুর ও জয়চাঁদপুরের গ্রামবাসী। ২০২২ সালের ৯ আগস্ট মাঠ রক্ষায় অনুষ্ঠিত হয় মানববন্ধন ও সমাবেশ।

অন্নদা স্কুল মাঠ, সরাইল, ব্রাহ্মণবাড়িয়া

সরাইলের অন্নদা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠটি শতবর্ষী এক ঐতিহ্যবাহী মাঠ। মাঠের পরিধি বিনষ্ট করে মাটি কেটে বিদ্যালয়ের বহুতল ভবন নির্মাণের কাজ শুরু হয়। এ বিষয়ে শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও এলাকাবাসী প্রতিবাদ জানায়।

মাঠের পরিধি ঠিক রেখে পশ্চিম দিকে বিদ্যালয় ভবন নির্মাণের দাবি জানায় আন্দোলনকারীরা। তারা প্রশাসন বরাবর স্মারকলিপি পেশ করে। ২০২২ সালের ২৫ জানুয়ারি উপজেলার প্রধান সড়কে মাঠ রক্ষায় প্রতিবাদী বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।

শামলাপুর মাঠ, টেকনাফ, কক্সবাজার

টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের ঐতিহ্যবাহী শামলাপুর খেলার মাঠটি নানাভাবে দখলের পাঁয়তারা হয়েছে। নানা প্রতিষ্ঠান মাঠটি দখল করে তাদের অফিস স্থাপনা তৈরি করে দিয়েছিল, অনেকে ময়লার ভাগাড় করেছিল। এ মাঠে কেবল খেলা নয়, জানাজা ও মাহফিলও হয়। জবরদখলে জিম্মি এ মাঠ রক্ষায় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের কাছে অভিযোগ করেন এলাকাবাসী। এলাকাবাসীদের নিয়ে মাঠটি জবর-দখলমুক্ত করেন স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আমজাদ হোসেন খোকন।

চাঁদপাড়া মাঠ, ফুলবাড়ী, দিনাজপুর

ফুলবাড়ীর ছোটযমুনা তিরে চাঁদপাড়া মাঠ দীর্ঘদিন থেকে খেলার মাঠ ও ঐতিহ্যবাহী চড়কপূজার স্থল হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। সুজাপুর মৌজার ১৮১৫ দাগের এই জমি সবার জন্য উন্মুক্ত থাকার কথা আছে এসএ খতিয়ানে। কিন্তু পৌর কাউন্সিলর প্রভাব খাটিয়ে প্রাচীন এই মাঠটি নিজের বলে জবরদখল করেন।

মাঠ রক্ষায় এলাকাবাসী আন্দোলনে নামে। বিক্ষোভ মিছিল, সমাবেশ ও স্মারকলিপি পেশের মাধ্যমে তারা মাঠ রক্ষার দাবি তুলে ধরে প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের কাছে।

আইচগাতি-দেয়াড়া অগ্রদূত মাঠ, রূপসা, খুলনা

আইচগাতি-দেয়াড়া অগ্রদূত মাঠটি রূপসা খুলনার এক ঐতিহ্যবাহী খেলার মাঠ। এই মাঠ বহু কৃতী ক্রীড়াবিদ জন্ম দিয়েছে। কিন্তু বহু ক্রীড়াবিদের জননী এই মাঠ আজ হুমকির মুখে। মাঠ কর্তৃপক্ষ একটা সময় খান বাহাদুর প্রাথমিক বিদ্যালয় ও জুনিয়র বালিকা বিদ্যালয়ের জন্য জমি দান করে।

সম্প্রতি এখানে একটি উচ্চ বিদ্যালয়ের অনুমোদন হয়, কিন্তু খেলার মাঠের বৈশিষ্ট্য বিনষ্ট করে এই স্থাপনা গড়ে তোলার চেষ্টা চলছে। যদিও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশে উচ্চ বিদ্যালয় করার উপযুক্ত জায়গা রয়েছে।

২০২১ সালের ১৯ জুলাই মাঠ রক্ষায় এলাকাবাসী মানববন্ধন ও বিক্ষোভ মিছিল করেছে। ঐতিহ্যবাহী এই মাঠ বাঁচিয়েই উচ্চ বিদ্যালয় নির্মাণের দাবি তুলেছে তারা।

বিয়াঘাট মাঠ, গুরুদাসপুর, নাটোর

গুরুদাসপুরের বিয়াঘাট মাঠটি বেশ প্রাচীন। বর্তমানে মাঠটি বিয়াঘাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কিন্তু পাবলিক খেলার মাঠ। এই মাঠে এখনো দস্তনানগর, কুমারখালি, সরকারপাড়া, মিয়ানপাড়া, সরদারপাড়া, বিয়াঘাট ও বাবলাতলাসহ দশগ্রামের মানুষ এসে খেলাধুলা করে।

এই খেলার মাঠ বিনষ্ট করে শুরু হয় বিদ্যালয় ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা। মাঠের পরিধি কমিয়ে দিয়ে মাঠের পশ্চিম অংশে প্রায় ২৫ ফুট জুড়ে এই স্থাপনা নির্মিত হচ্ছে। কিন্তু অপরিকল্পিত ওয়াচব্লক সরিয়ে ভবন নির্মাণ করলে মাঠটি বেঁচে যাবে বলে দাবি তুলেছেন মাঠ রক্ষা আন্দোলনকারীরা।

২০২১ সালের ২২ সেপ্টেম্বর বিক্ষোভ মিছিল ও মানববন্ধন শেষে তারা প্রশাসনের কাছে মাঠ রক্ষায় স্মারকলিপি ও অভিযোগ পেশ করেন।

পঞ্চমীঘাট মাঠ, সোনারগাঁ, নারায়ণগঞ্জ

সোনারগাঁওয়ের পঞ্চমীঘাট বিদ্যালয়ের খেলার মাঠটি দখল করে সেখানে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নতুন ভবন নির্মাণের প্রকল্প নেয় ও কাজ শুরু করে। এর ফল পশ্চিম অংশ থেকে মাঠের মাঝ বরাবর প্রায় পুরোটাই ভবন নির্মাণের জন্য দখল হয়ে যাবে। শিক্ষার্থীরা মাঠটি বাঁচাতে স্কুল কর্তৃপক্ষকে বারবার আবেদন জানায়।

শেষে ২০২০ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি স্কুলের শিক্ষার্থীরা ক্লাস বর্জন করে মাঠ রক্ষায় মিছিল ও মানববন্ধন করে।

স্কুল মাঠ, সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, পটুয়াখালী

১৯১৯ সালে পটুয়াখালী সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। বিদ্যালয়ের মাঠটি দেশের এক প্রাচীন ও ঐতিহাসিক মাঠ। খেলার মাঠের রূপ ও বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন করে জেলা প্রশাসন এক বহুতল ভবন নির্মাণের প্রকল্প নেয়। এর প্রতিবাদে আন্দোলনে নামে শিক্ষার্থীরা। বিদ্যালয়ের হাজারো শিক্ষার্থী ২০২২ সারের ২৮ আগস্ট খেলার মাঠ রক্ষায় মানববন্ধন করে। 'বহুতল ভবন চাই না, খেলার মাঠ চাই' প্ল্যাকার্ড ও শ্লোগানে তারা দাবি তুলে ধরে।

কাউনিয়া স্কুল মাঠ, বরিশাল

বরিশাল নগরীর কাউনিয়া এলাকায় এ কাদের চৌধুরী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের খেলার মাঠ রক্ষার দাবিতে শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও এলাকাবাসী এক আন্দোলন গড়ে তুলেছেন। স্কুলটিতে একটি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র কাম স্কুল ভবন নির্মাণের জন্য সরকার প্রকল্প ও বাজেট বরাদ্দ দিয়েছে।

ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান স্কুলের প্রাচীন খেলার মাঠটিকে দখল করে সেখানেই এই স্থাপনা তৈরি শুরু করে। যদিও পূর্বদিকে নতুন ভবন নির্মাণ করলে মাঠটিকে বাঁচানো সম্ভব। মাঠটি বাঁচাতে আন্দোলনকারীরা ২০২১ সালের ৭ অক্টোবর এক মানববন্ধন ও সমাবেশ করে।

কী আছে আইনে?

খেলার মাঠ ও উন্মুক্ত স্থান সুরক্ষায় দেশে একটি আইন আছে। 'মহানগরী, বিভাগীয় শহর ও জেলা শহরের পৌর এলাকাসহ দেশের সকল পৌর এলাকার খেলার মাঠ, উন্মুক্ত স্থান, উদ্যান এবং প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন ২০০০'। বেশ দীর্ঘ নামের এই আইনটি কার্যকরেও রয়েছে দীর্ঘসূত্রিতা।

আইন বলা হয়েছে, ...খেলার মাঠ, উন্মুক্ত স্থান, উদ্যান এবং প্রাকৃতিক জলাদার হিসেবে চিহ্নিত জায়গার শ্রেণী পরিবর্তন করা যাইবে না বা উক্তরূপ জায়গা অন্য কোনভাবে ব্যবহার করা যাইবে না বা অনুরূপ ব্যবহারের জন্য ভাড়া, ইজারা বা অন্য কোনভাবে হস্তান্তর করা যাইবে না।

কিন্তু দেশে নগর কী গ্রাম, সর্বত্র খেলার মাঠ দখল করে মূলত কী করা হয়েছে? হয়তো নতুন কোনো অবকাঠামো বা স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে কিংবা সেখানে গড়ে তোলা হয়েছে কোনো অপরিকল্পিত বাণিজ্যিক প্রকল্প। এর ফলে সেই খেলার মাঠের বৈশিষ্ট্য এবং শ্রেণি অবশ্যই পরিবর্তন ঘটানো হয়েছে।

কারণ প্রাকৃতিক, ভৌগলিক, বাস্তুসংস্থান, পরিবেশগত, সাংস্কৃতিক ও সামাজিকভাবে সেটি এখন আর 'খেলার মাঠ' হিসেবে নেই। কিন্তু দেশে কতগুলো খেলার মাঠ হত্যা ও বিনষ্টের বিরুদ্ধে মামলা ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত হয়েছে? এমনকি আইনে দেশের গ্রাম ও ইউনিয়ন পর্যায়ে খেলার মাঠ রক্ষার কোনো বিধান নেই। অবশ্যই গ্রাম, শহর, পৌরসভা, সিটি করপোরেশন, ইউনিয়ন পরিষদ এলাকার খেলার মাঠের আইনগত নিরাপত্তা আইনে যুক্ত করা জরুরি।

খেলার মাঠ চাই

খেলার মাঠের অধিকার নাগরিক অধিকার। এটি মন-শরীর ও সংস্কৃতির সুস্থ বিকাশের এক অন্যতম শর্ত। কিন্তু দেশজুড়ে প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য ও প্রতিবেশের মতোই খুন হচ্ছে খেলার মাঠ।

উন্নয়ন বাহাদুরিতে উধাও হচ্ছে শত শত টুকরো টুকরো ছোট-বড় খেলার মাঠ। নগর পরিকল্পনাবিদেরা বলেন, একটি শহরে প্রতি আধা বর্গকিলোমিটারে একটি করে খেলার মাঠ প্রয়োজন। ৩০৫ দশমিক ৪৭ বর্গকিলোমিটার আয়তন বিবেচনায় ঢাকার ২ সিটি করপোরেশনে খেলার মাঠ দরকার অন্তত ৬১০টি। অথচ, মাঠ রয়েছে ২৫৬টি। ৪১টি ওয়ার্ডে কোনো মাঠ নেই।

ঐতিহ্যবাহী ধূপখোলা মাঠে নির্মিত হচ্ছে বিপণি-বিতান, শ্যামলী ক্লাব মাঠ দখল করে চলে তাঁত ও বস্ত্রমেলা। রাজধানীর জন্য করা ড্যাপের খসড়ায় বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী ঢাকায় মাঠ দরকার ১ হাজার ৪৬৬টি।

নগর পরিকল্পনাবিদদের সংগঠন 'বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি)' ২০১৯ সালের 'ঢাকা শহরে বিদ্যমান খেলার মাঠের ঘাটতি ও চাহিদা পর্যালোচনা' বিষয়ক এক গবেষণা করে। তাদের গবেষণায় ঢাকায় ২৩৫টি মাঠের উল্লেখ আছে।

কেবল ঢাকা নয়, খুন হয়ে গেছে দেশের সব এলাকার খেলার মাঠ। সিলেটের বিখ্যাত কালাপাথার মাঠ, কয়েদির মাঠ, গাছতলা মাঠ, মজুমদারবাড়ি মাঠ, বাগবাড়ি মাঠ, বাদামবাগিচা মাঠ, রাজবাড়ি মাঠ, ছড়ারপাড় মাঠ চোখের নিমিষে উধাও হয়ে গেল।

কেবল খেলা নয়, পাবলিক মাঠগুলো জনসংস্কৃতির এক দেশীয় মঞ্চ। এখানে পালাগান হয়, সার্কাস, ষাঁড়ের লড়াই, বারুণী, আড়ং, মৌসুমি মেলা, ঘোড়দৌড়, যাত্রাপালা, বার্ষিক প্রতিযোগিতা, মাহফিল, কীর্তন কতকিছুর আয়োজন ঘটে এইসব মাঠে। নওগাঁর মহাদেবপুরের নাটশাল মাঠে ওঁরাও-সাঁওতাল-মুন্ডাদের ঐতিহ্যবাহী কারাম পর্ব আয়োজিত হয় প্রতিবছর।

এভাবে একের পর এক খেলার মাঠ খুন হয়ে যাওয়ার পরিণতি কী? এর শারীরিক, সাংস্কৃতিক, মনস্তাত্ত্বিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক কিংবা রাজনৈতিক প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া কী? এ বিষয়ে আমরা কী জোরদার আওয়াজ তুলেছি? নীতিনির্ধারকরা কী জাতীয় সংসদে দেশের খেলার মাঠের সুরক্ষায় জোরদার কোনো তর্ক তুলেছে কখনো?

হয়তো সব পাবলিক মাঠ সবার জন্য এখনো সমানভাবে 'উন্মুক্ত' নয়। সামাজিকভাবে 'অস্পৃশ্য' অনেকে একই মাঠে হয়তো খেলতে পারে না। খেলার মাঠ নিয়ে চলতে থাকা এমন সামাজিক বঞ্চনা ও শ্রেণিদ্বন্দ্ব নিরসনও জরুরি।

দেশের সব খেলার মাঠ পাবলিক নথিভূক্তকরণ জরুরি। নামকরণ, ইতিহাস, বর্তমান অবস্থা, সংকটের কারণ ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা— এসব বিবরণ সম্মিলিত একটা জাতীয় তথ্যভাণ্ডার। পাশাপাশি খেলার মাঠ সুরক্ষায় আইন ও আইনি তৎপরতা জোরালো ও সক্রিয় হওয়া জরুরি। আবারো কেন্দুয়ার বলাইশিমূলসহ দেশের সব মাঠের সুরক্ষা ও ন্যায়বিচারের দাবি জানিয়ে চলতি আলাপখানি মাঠ রক্ষার আন্দোলনে সবাইকে সক্রিয় হওয়ার আহ্বান জানাই।

পাভেল পার্থ: লেখক ও গবেষক, প্রতিবেশ ও বৈচিত্র্য সংরক্ষণ

animistbangla@gmail.com

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

No kidney patient, they tried to rob bank for iPhones

Police say three robbers fabricated a story claiming that the robbery was to save a kidney patient

10m ago