শিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত কিংবা নিরক্ষর মানুষের আগ্রহ ‘অর্থ’ ও ‘ক্ষমতা’

শিক্ষিত মানুষ বাড়ছে, বাড়ছে বেকারত্ব, লোভ ও ক্ষোভ। ক্ষমতার লড়াইয়ের প্রভাব শুধু বিরোধী দল নয়, বরং এখন নিজ নিজ দল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, গবেষণা প্রতিষ্ঠান সর্বত্র। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষার হার বৃদ্ধি পেলেও উচ্চশিক্ষিত ও নিরক্ষর মানুষের জীবনাচারে খুব একটা পার্থক্য দেখা যায় না।

শিক্ষিত মানুষ বাড়ছে, বাড়ছে বেকারত্ব, লোভ ও ক্ষোভ। ক্ষমতার লড়াইয়ের প্রভাব শুধু বিরোধী দল নয়, বরং এখন নিজ নিজ দল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, গবেষণা প্রতিষ্ঠান সর্বত্র। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষার হার বৃদ্ধি পেলেও উচ্চশিক্ষিত ও নিরক্ষর মানুষের জীবনাচারে খুব একটা পার্থক্য দেখা যায় না।

ধর্ম ও পেশাভেদের মানুষে একটা বিষয়ে মিল আছে। মিলটি লোভ ও অনৈতিকতার। শিক্ষা আমাদের রুচি, মানসিকতা, মনোযোগের ক্ষেত্রে বাড়তি কোনো মাত্রা যোগ করতে পারছে না। গোটা সমাজের মানুষ 'অর্থ' ও 'ক্ষমতা'কে কেন্দ্র করে এগিয়ে যাচ্ছে। বৈধ কিংবা অবৈধ বিষয়টিও মুখ্য নয়, বরং দিন শেষে যেকোনো উপায়ে অর্থ কিংবা ক্ষমতা অর্জনই সমাজে সফলতার মানদণ্ড।

কে কোন বিষয়ে পড়ছে, কোন পেশায় আছে, সেই বিষয়টি ভালো নাকি খারাপ— তা পরিমাপ করা হচ্ছে সে যে বিষয়ে পড়ে, যে পেশায় চাকরি করে তাতে কত টাকা কামানো যায়, কতটা ক্ষমতার চর্চা করা যায় তার ওপর। এতে করে গোটা সমাজে এক মানসিক অসুস্থতায় আক্রান্ত।

ক্ষমতা ও টাকা কামানোর পর্যায়ে যারা নিজেদের উন্নীত করতে পারছেন না, তারা মানসিকভাবে চাপে আছেন, হতাশা ঘিরে দিন পার করছেন, নিজেদের ব্যর্থ মনে করছেন, সমাজও ব্যর্থতার আঙ্গুল দেখাচ্ছে। আর যারা যেতে পারছেন, তারা প্রতিযোগিতায় নামছেন— কে কত বেশি টাকা কামাই করতে পারেন, ক্ষমতার পরিদর্শন করতে পারেন।

এতে সেবার বদলে বিপদের সুযোগে ঘুষ নেওয়ার সংস্কৃতি সাহায্যপ্রার্থীকে গভীর সংকটে ফেলে দিচ্ছে। সুযোগটি অপরাধীকে অপরাধ করে পার পেতে টনিক হিসেবে কাজ করছে। সেবার জায়গাগুলোতে ঘুষের সংস্কৃতি গোটা সমাজকে গিলে ফেলছে।

অথচ যেকোনো ধর্মের, বর্ণের বিবেকবান, শিক্ষিত মানুষমাত্র উপলব্ধি হওয়ার কথা যে পৃথিবীতে খুব অল্প সময়ের জন্যই মানুষের আগমন। আজকের যে সম্পদ, যে জমির ভোগদখল আমরা করছি তা ১০০ বছর আগে আমাদের ছিল না। যাদের ছিল তারা নেই, তবে সম্পদগুলো ঠিকই আছে। একসময়ে দেশে জমিদারি প্রথা ছিল। জমিদাররা তা ভোগ করলেও তাদের পরবর্তী প্রজন্মগুলোর হদিস আমরা খুব একটা পাই না। আজকের উচ্চবিত্ত শ্রেণি যারা সম্পদের পাহাড় গড়ছে, নিজেদের প্রয়োজন মিটিয়ে তাদের চৌদ্দপুরুষের খোরাক মেটাতে, তাদের বাংলার মৌর্য, শুঙ্গ, কুষাণ, গুপ্ত, পাল, সেন, সুলতানি, মোগল, পাকিস্তান পরবর্তী বর্তমান বাংলাদেশ থেকে অসংখ্য ইতিহাসের ঘটনা থেকে শিক্ষা নেওয়ার সুযোগ আছে। যদিও আমরা সাল আর ঘটনাটি মনে রাখি, কিন্তু সেখান থেকে শিক্ষা নেই না। সর্বোচ্চ সম্পদ অর্জন করলেও একটা নির্দিষ্ট সময় পর ব্যক্তি চাইলেও সম্পদকে আর ধরে রাখতে পারে না।

সম্পদের নেশায় দেশে ঘুষ প্রথার রমরমা অবস্থা। সাম্প্রতিক সময়ের আলোচিত বিভিন্ন অর্থনৈতিক কেলেঙ্কারিতে, অনৈতিক কাজে নিরক্ষর মানুষের চেয়ে শিক্ষিত মানুষের দ্বারা বাংলাদেশ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলে পত্রিকার সংবাদগুলো তথ্য দেয়। তাদের এই অর্থ ও ক্ষমতার লোভকে কাজে লাগিয়ে নানা পেশায় ও নেশায় বিভিন্ন অপরাধে জড়িত গোষ্ঠী পার পেয়ে যাচ্ছে।

কখনো এই অপরাধী চক্র খুন করে ঘুষ দেওয়ার মধ্য দিয়ে পার পেয়ে যাচ্ছে। আইনের পরোয়া করছে না, অপরাধ করে পার পেয়ে যাওয়া সোৎসাহে অপরাধ বাড়িয়ে দিচ্ছে। বর্তমানে কোনো বৈধ কাজ বিনা ঘুষে করা মুশকিল, এমনকি অসম্ভব হয়ে গেছে। এমনকি স্কুল-কলেজ-মাদরাসার শিক্ষকরাও উপজেলা শিক্ষা অফিসার থেকে শুরু করে বোর্ড পর্যন্ত বৈধ কাজ ঘুষ ছাড়া আদায় করতে পারছেন না। শহর থেকে গ্রামাঞ্চল মাদকের আখড়ায় পরিণত হলেও ঘুষের কারণে অপরাধীরা প্রশান্তচিত্তে অপরাধ করে যাচ্ছে। বাংলাদেশের সর্বত্র এখন ঘুষের রাজত্ব। ঘুষের দাপটে মেধা ও যোগ্যতা মূল্যহীন।

ঘুষের সংস্কৃতি দিন শেষে একটি অসুস্থ সমাজের দিকে সবাইকে হাতছানি দিচ্ছে। অথচ ধর্মীয় শিক্ষাগুলোও আমাদের শেখাচ্ছে— ত্যাগ করো, ভোগ করো কম, তাতেই মিলবে প্রশান্তি।

বৌদ্ধ ধর্ম মতে, দুঃখের কারণ হলো মানব মনের তৃষ্ণা, কামনা, বাসনা। বুদ্ধের মতে, কামনামুক্ত হৃদয়েই নির্বাণের প্রদীপ জ্বলে এবং দুঃখের অবসান ঘটে। বুদ্ধ দুঃখ নিরোধের উপায় হিসেবে ৮টি শিক্ষণীয় মার্গের কথা উল্লেখ করেছেন, যা অষ্টাঙ্গিক মার্গ হিসেবে পরিচিত। জীবিকা নির্বাহের ক্ষেত্রে বৌদ্ধ ধর্ম অস্ত্র, প্রাণী, মাংস, নেশা ও বিষ এই পঞ্চ বাণিজ্য অবশ্যই পরিহার করতে বলে। সেই সঙ্গে মিথ্যা ভাষণ, অন্যায় আচরণ বর্জন করে সদুপায়ে জীবিকা নির্বাহ করাই মুক্তিকামীর জন্য অপরিহার্য বলে জোর দেয়। অষ্টাঙ্গিক মার্গের শেষ মার্গে সবসময় মনে সত্য ও কল্যাণকর চিন্তার ধ্যান করা, দৃঢ় সংকল্পের দ্বারা ইচ্ছা ও কামনাকে নিয়ন্ত্রণ করার মধ্য দিয়ে নির্বাণ লাভ করার কথা বলে। এক কথায় বৌদ্ধ ধর্মে প্রকৃত সত্যকে পূর্ণভাবে উপলব্ধি করায় প্রজ্ঞাবান সাধক জগৎ ও জীবনের স্বরূপ সম্পর্কে অবহিত হয়ে সমস্ত মোহমুক্ত অবস্থায় শক্তিশালী নির্বাণ লাভ করার পথ দেখায়। বৌদ্ধধর্মে কর্মবাদও গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। কর্মের ফলে মানুষের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতকে নিয়ন্ত্রণ করে, মানুষ যে কাজ করবে তাকে অবশ্যই সে কাজের ফলাফল ভোগ করতে হবে। সে কাজ শারীরিক হোক বা মানসিক।

সনাতন বা হিন্দু ধর্ম বিশ্বাসের অন্যতম একটি অংশ মুক্তিবাদ। হিন্দু ধর্মে মোক্ষের মাধ্যমে পরমার্থ লাভের ৩টি পথ— জ্ঞানমার্গ, ভক্তিমার্গ ও কর্মমার্গ। এই ৩ ধরণের মার্গেও মানুষের প্রতি সেবা, ভালোবাসা, ত্যাগ, আন্তরিকতার কথা বলা হয়েছে।

ইসলাম ধর্মেও সেবার জন্য জ্ঞান ও দানকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। যে কারণে আমরা মধ্যযুগে আল্লাহর নামে সমস্ত সম্পত্তি ওয়াকফ করে দেওয়া মানুষ হিসেবে হাজী মুহাম্মদ মহসিন, নওয়াব ফয়জুন্নেসাকে পাই। ব্রিটিশ আমলে মেয়েদের জন্য ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল গড়তে দেখি নওয়াব ফয়জুন্নেসাকে, জনকল্যাণে পুকুর, রাস্তাঘাট নির্মাণে বাংলাতেও খানজাহান আলীকে এগিয়ে আসতে দেখি।

হিন্দুদের এগিয়ে আসতে দেখি বরিশালে বিএম কলেজ প্রতিষ্ঠায়, খুলনায় বিএল কলেজ প্রতিষ্ঠাসহ বিভিন্ন অঞ্চলে শিক্ষা, সংস্কৃতি, লাইব্রেরির উৎকর্ষতায়। কিন্তু সেই দৃশ্যপট পাল্টে গিয়ে বর্তমান সময়ে শিক্ষা যেন আমাদের ভোগের সংস্কৃতির দিকে গোটা জাতি উজ্জীবিত করছে।

এতে ঘুষ নেওয়া প্রত্যেক পিতার প্রতি সন্তানের ঘৃণা থাকার কথা থাকলেও, ঘুষখোরকে ঘৃণার চোখে দেখার কথা থাকলেও বরং ঘুষ বেশ সম্মানজনক অবস্থাতেই আছে। যে বা যারা ঘুষ নিচ্ছেন, তাদের মধ্যে লজ্জার ছিটে-ফোঁটাও নেই। বরং নিরাপদ ও নিরবিচ্ছিন্নভাবে ঘুষ খেতে বিশাল বাহিনী, সিন্ডিকেট রাজপথ থেকে অলিতে-গলিতে ছড়িয়ে আছে।

শিক্ষার ঘাটতি থাকায় নিরক্ষর মানুষের মধ্যে অর্থ ও ক্ষমতাকেন্দ্রিক নজর থাকার কথা থাকলেও বরং বাস্তবে শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মধ্যেই টাকা ও ক্ষমতা পাওয়ার প্রতিযোগিতা, এর ক্ষুধা এখন সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। শিক্ষা যদি আমাদের মানবিকতার, সেবার মানসিকতা বিনির্মাণের, দক্ষতা ও যোগ্যতা অর্জন করে তা গণমানুষের কল্যাণে ব্যয় করার চেয়ে মানুষকে জিম্মি করার কাজে ব্যয় করতে উদ্বুদ্ধ করে, তাহলে সেই সমাজের শিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত ও নিরক্ষর মানুষের চিন্তা ও কর্মে কোনো পার্থক্য থাকে না। অর্থ ও ক্ষমতাই সেই সমাজের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে।

লেখক: শিক্ষক, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়

mutasim.b@cou.ac.bd

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

Goods worth Tk 16k imported at Tk 2.59 crore

State-run Power Grid Company of Bangladesh Ltd (PGCBL) imported 68 kilograms of tower bolts, nuts and washers from India for a whopping $2,39,695 or Tk 2.59 crore, which is 1,619 times the contract value.

1h ago