মাননীয়: মুখে মুখদোষ, হাতে অজুহাত
নানান মন্দের মাঝেও ভালো খবর হিসেবে ধরা দিয়েছে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বেহেশত বিষয়ক মন্তব্যের জন্য দুঃখ প্রকাশ। বাংলাদেশের রাজাসন থেকে কারো দুঃখ প্রকাশের দৃষ্টান্ত এটি।
গত রোববার, সপ্তাহের প্রথম কার্যদিবসে, জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল ব্যাচলেটের ঢাকায় পা রাখার দিনে দুঃখ প্রকাশ করতে গিয়ে সরকার ও দলের উচ্চপর্যায় থেকে ধমক খাওয়ার কথাও ফাঁস করে দিয়েছেন সাংবাদিকদের কাছে। তিনি বলেছেন, গণ্ডগোলটা সাংবাদিকরাই বাধিয়েছেন।
এর আগে, অতিকথকদের আবারও ধমকালেন ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক, হেভিওয়েট মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। আরও আগে, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীও শাসিয়েছেন কয়েক দফায়। মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের নির্দেশ দিয়েছেন, কাণ্ডজ্ঞান খরচ করে কথা বলতে।
গত শনিবার দলীয় অনুষ্ঠানে কড়া ভাষায় ওবায়দুল কাদের বলেছেন, দায়িত্বজ্ঞানহীনভাবে কথা না বলতে। এই পরামর্শের সঙ্গে আবারও স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, যেখানে সংকটে মানুষের দুশ্চিন্তায় প্রধানমন্ত্রী রাতে নির্ঘুম থাকেন, সেখানে অনেকের বেফাঁস বক্তব্য ও ক্ষমতার বাহাদুরি দুঃখজনক।
ওবায়দুল কাদেরের পরামর্শটি এসেছে এর আগের দিন শনিবার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেনের 'বাংলাদেশের মানুষ বেহেশতে আছে' মন্তব্যের জেরে।
স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর সাবধান করে দেওয়ার পরও যারা সংযত হননি, তাদের কাছে সাধারণ সম্পাদকের আহ্বান কতোটা সাধারণ বা অসাধারণভাবে গ্রাহ্য হবে—এ প্রশ্নের মাঝে ওই দিনই নতুন করে ট্রলে পড়েন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি বেহেশতের কথা বলেননি দাবি করে দোষ চাপান সাংবাদিকদের ওপর। সাংবাদিকরা তার বক্তব্য টুইস্ট করেছেন, বাক্যের শব্দ গোলমাল করেছেন—এ দাবি করতে গিয়ে আবার আগের কথাই বলে ফেলেন। এতে তার আগের বক্তব্য আবার শুনে বিনোদিত হয়েছেন অনেকে। বেগতিক অবস্থায় রোববার ড. মোমেনের দুঃখ প্রকাশ।
বক্তব্য অস্বীকার করে তিনি নিজেই পানিটা বেশি ঘোলা করে ফেলেন। বেহেশতের কথা না আনলে সম্ভবত এতো ভাইরালের বিষয় হতো না পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যটি। বেহেশত শব্দ ব্যবহার না করে এর আগে এ ধরনের কথা তার সহকর্মীদের অনেকেই করেছেন। বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম সুখী দেশ, আয়-আয়ুতে টইটুম্বুর মানুষ, গরুও এখন ভাত খায়, উন্নয়নের জোয়ারে দেশে এখন ভিক্ষা দেওয়ার লোকও পাওয়া যায় না, কোরবানির গোশত নেওয়ার লোক নেইসহ বহু বচন-বাচন রয়েছে তাদের।
এসব কথায় মানুষ কষ্টের সঙ্গে বিনোদিত হয়েছে। কিন্তু, একটু গোলমাল বেঁধেছে পররাষ্ট্রমন্ত্রী দেশকে সিঙ্গাপুর-কানাডা পার করে বেহেশতে নিয়ে যাওয়ায়। 'দেশের মানুষ' না বলে 'আমরা' বললেও কিছুটা ফাঁক থাকতো। 'আমরা' মানে তিনি নিজে, তার পরিবার, সহকর্মীসহ তাদের স্বজন-জ্ঞাতিগোষ্ঠী এবং ক্ষমতাসীন দলের সুবিধাভোগী ভাবলে ভুল হয় না। 'দেশের মানুষ' সম্বোধন করে সবাইকে বেহেশতবাসী না করলেও হয়তো পার হয়ে যেত ইস্যুটা।
এরপরও সময়ের আলোচিত একটি উদাহরণ তৈরি হলো এই দুঃখ প্রকাশের ঘটনায়। গত বছর কয়েকে নানা কারণে দেশে কার্টুনিস্ট ও রম্য লেখক কমে গেছেন বা থমকে গেছেন। মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, আমলাসহ বরেণ্যরা লেখকদের বাড়া ভাতে ছাই দেওয়ার মতো বিনোদনের ঘাটতি কাটিয়ে দিচ্ছেন। নিত্য ঘটাচ্ছেন রম্যময় ঘটনা। তাদের কল্যাণে কৌতুক, হাস্যকর, স্যাটায়ার, জোকস, তামাশা, সার্কাস সাপ্লাই হচ্ছে মাঝেমধ্যেই। করোনা, ডেঙ্গুসহ নানান রোগ-শোক মাড়িয়ে অর্থনীতি, অভাব-অনটন, ডলার সংকট কিচ্ছু বাদ দেন না তারা। প্রয়োজনে স্ক্রিপ্ট লিখিয়ে সেটা আবৃতিও করেন।
করোনার সময় ওবায়দুল কাদের বলে দিয়েছিলেন 'আমরা করোনার চেয়ে শক্তিশালী'। রূপপুরের বালিশ কাণ্ডের সময় রম্যের লেটেস্ট ভার্সনে তিনি বলেছিলেন, বালিশের কোটি কোটি টাকা চুরি যারা করেছে তারা ছিচকে চোর। ডেঙ্গুর প্রকোপের সময় স্থানীয় সরকার মন্ত্রী তাজুল ইসলাম জানিয়েছেন, দেশের উন্নয়ন হওয়ায় ডেঙ্গু এসেছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রীসহ ঢাকার ২ মেয়রও কতো রম্যসালাদ জোগান দিয়েছেন। টিভি-চলচ্চিত্র নায়িকাদের নিয়ে মন্ত্রীদের রাস্তা ঝাড়ু দেওয়ার মনোমুগ্ধকর তামাশা এখনও ঘুরছে সোশ্যাল মিডিয়ায়।
মান্যবররা অনেকে ট্রল আইটেম হয়ে বাড়তি তৃপ্তি পান বলেও বাজারে আলোচনা আছে। তা করোনা-ডেঙ্গু, বন্যা-খরা কাটিয়ে জ্বালানি তেলের জ্বালা, ভোজ্যতেলের কারসাজি, ডলার সংকট, নিত্যপণ্যের আগুনের মাঝেও। কারো অসুস্থতা, এমনকি মৃত্যু নিয়ে হালকা মন্তব্য করতেও তাদের বুক কাঁপে না। নইলে কি করে কোনো মন্ত্রী বলেন, বহু দেশের মানুষেরই বিমানে চড়ার সামর্থ্য নেই, সেখানে আমরা প্লেনে করে পিঁয়াজ নিয়ে আসি?
যানজটকে উন্নয়নের প্রমাণ বলে মশকরায়ও মুখ আটকায় না। বিদেশের মন্ত্রীরা এখন বাংলাদেশের মন্ত্রীদের অ্যাপয়েন্টমেন্টের জন্য বসে থাকে— এই গর্ব জানান দিয়েছেন আরেক মন্ত্রী। উড়োজাহাজ থেকে দেখলে ঢাকাকে প্যারিস মনে হয় বলে হাসেনও। প্রত্যেকের গায়ে জামাকাপড় আছে, খুব খারাপ আছি মনে করি না—ধরনের কথামালা মানুষকে কলিজা-ছেঁড়া বেদনা দেয়। তার ওপর একই বিষয়ে আজ এক কথা, কাল আরেক কথার চাতুরি। এই চাতুরি এখন একটা স্মার্টনেস। 'সুবক্তা' হিসেবে কোথাও কোথাও সমাদৃতও হন।
মেধা-শিক্ষা, নীতি-নৈতিকতা, সততার কোনো প্রশ্ন নেই। সিনিয়র-জুনিয়রও বিষয় নয়। রাষ্ট্রীয় বা দলীয় সিনিয়ররাও জুনিয়রদের সঙ্গে পেরে উঠতে গিয়ে লিপ্ত হচ্ছেন এ প্রতিযোগিতায়। সুফলও পাচ্ছেন। এক এক ঘটনায় হাতেনাতে প্রমাণ হচ্ছে মুখের জোরের বরকত। ব্যক্তিত্ব বা শিক্ষার বদলে নিম্নমানের কথার বিষে কেউ কষ্ট পাচ্ছে বা পাবে—তা ভাবনায়ও নিতে হয় না তাদের। সত্য-মিথ্যা, ভদ্রতা-চাতুরি, বিনয়-অসভ্যতা, মমতা-নিষ্ঠুরতাসহ প্রায় সবই এখন আপেক্ষিকতায় ঠাসা। মুখের সঙ্গে তাদের শরীরী ভাষাও সেই বার্তাই দিয়ে আসছে।
ঘটনা বেগতিক হয়ে গেলে তারা কথা পাল্টে দোষটা চাপান সাংবাদিকদের ওপর। পারলে অপদস্থও করেন। বরাবরই এটি বেশ সহজ কাজ। সেদিন শ্রীলঙ্কার উদাহরণ টেনে চীনের বিআরআই ঋণ নিয়ে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে সতর্কবার্তা দিয়ে আবার অস্বীকার করে ফেলেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। ফিনান্সিয়াল টাইমস পত্রিকায় দেওয়া সাক্ষাৎকার প্রকাশের ২৪ ঘণ্টা যেতে না যেতেই প্রতিবাদ পাঠিয়ে জানিয়েছেন, তিনি এরকম কিছুই বলেননি।
মুখের সঙ্গে হস্তশিল্পের কাজও এগিয়ে নিচ্ছেন অনেক মান্যবর। গত এক বছরে অর্ধ-ডজন সংসদ সদস্য মানুষ পিটিয়ে নানা সময়ে মিডিয়ায় জায়গা করেছেন। শিক্ষক-সাংবাদিক পিটিয়ে তাদের হাতের সঙ্গে পা-ও চলে গেছে কতো জনের গায়ে। কিছুদিন আগে রাজশাহী-১ আসনের সংসদ সদস্য ওমর ফারুক চৌধুরী এক কলেজ অধ্যক্ষকে পিটিয়ে সুপারহিট হওয়ার রেশ থাকতে থাকতেই দেশের আইনসভা জাতীয় সংসদ ভবনের এলইডি হলে কুমিল্লার দেবীদ্বার উপজেলা চেয়ারম্যানকে পেটানোর রেকর্ড ওই আসনের মাননীয় রাজী মোহাম্মদ ফখরুলের।
মাছ ব্যবসায়ীকে পিটিয়ে নাম কামিয়েছেন বরগুনা-২ আসনের সংসদ সদস্য শওকত হাচানুর রহমান রিমন। এর আগে, মোটরসাইকেল বহরকে সাইড না দেওয়ায় ছাত্রলীগ নেতা নজরুল ইসলামকে বেধড়ক পিটিয়েও আলোচিত হয়েছেন এই মাননীয়। তার ঝুলিতে রয়েছে সরকারি কর্মকর্তাকে মারধরেরও কৃতিত্বও। ২ কলেজ শিক্ষককে পেটানোর ঘটনায় ভাইরাল হয়েছেন ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার। ঢাকা-৫ আসনের সংসদ সদস্য কাজী মনিরুল ইসলাম মনু হাত চালিয়েছেন ডেমরা সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের এক দলিল লেখকের ওপর।
হাত থাকতে মুখের কাজ না করার ব্যাপারে এক সময় নামডাক ছিল টেকনাফের সাবেক সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদির। টেকনাফ পৌর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ইউছুফ মনো, পৌর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক ইউছুফ ভুট্টো, উপজেলা আওয়ামী লীগের স্বাস্থ্যবিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট মাহমুদুল হকের শরীর জেনেছে বদির হাতের জোর।
মুখ ও হাতের কাজের সঙ্গে অজুহাতের চর্চাতেও এই মান্যবররা অবিরাম যশখ্যাতি কামাচ্ছেন। সবকিছুতেই কড়া-চড়া অজুহাত বা যুক্তি দাঁড় করতে পারঙ্গম তারা। কেবল জ্বালানি তেল নয়; ডিম, লালশাক, লাউ, কুমড়া, মাছ, মুরগি থেকে শুরু করে প্রায় সব নিত্যপণ্যের দামের পেছনে করোনা, রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ, ডলার সংকটকে অজুহাত করে দেন কী চমৎকারভাবে! তাদের প্রশ্ন করতে মানা? রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের সব খরচ বাংলাদেশই বহন করছে? যুদ্ধের আওয়াজে মুরগি ডিম পাড়া কমিয়ে দিয়েছে? ডলারের তেজে শাক-সবজির ফলন কমে গেছে? এ রকম অবস্থায় ক্ষমতাসীন দল থেকে আবারও নেতাকর্মীদের মুখ সামলে কথা বলার নির্দেশনা ও একজন মন্ত্রীর দুঃখ প্রকাশ অবশ্যই ঘটনা।
লেখক: সাংবাদিক; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)
Comments