কায়দা করে দায় এড়ানোর ফায়দা কী
বেইলি রোডে আগুনে আজ বিকেল পর্যন্ত ৪৬ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। গণমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে, নিহতদের বেশির ভাগের শরীরে পোড়া দাগ নেই। কারও কারও পোড়া দাগ থাকলেও তা মৃত্যু-ঝুঁকির মতো মারাত্মক নয়।
তাহলে এত মৃত্যুর কারণ কী? সেটা হয়তো চিকিৎসকেরা বলবেন। চুড়িহাট্টা ট্র্যাজেডির ৫ বছর হয়েছে গত সপ্তাহে। ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে রাজধানীর চকবাজারের চুড়িহাট্টায় সিলিন্ডারের বিস্ফোরণে ৭১ জন মানুষ প্রাণ হারান এবং বিপুল সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি ঘটে। বারবার এত মৃত্যুর খবর ও ক্ষয়ক্ষতিতে ধাক্কা খাবে যে কোন স্বাভাবিক মানুষ। একটু চিন্তা করলে মন খারাপ হবে।
প্রসঙ্গে মনে পড়ছে অস্ট্রেলিয়াতে ইউনিভার্সিটিতে আমরা গবেষণাকাজে ব্যস্ত থাকতাম কেউ ক্লাসে বা সেমিনারে। হঠাৎ রুমের মধ্যে সাইরেন বেজে উঠলে সবাই দৌড়ে বেরিয়ে যেতো। রাস্তায় ও আঙ্গিনায় অনেক মানুষের ভিড় হতো। পরে জানা যেতো এটা এমনিতেই নিয়মিত সতর্কতা সাইরেন। মাঝে মধ্যে সামান্য স্মোক বা ধোঁয়া দেখা গেলেও এরকম অটো সাইরেন বেজে উঠতো।
জাপানেও এমনটা দেখেছি যে প্রতিটি স্কুল, কলেজ ও ইউনিভার্সিটিতে অগ্নিকাণ্ড ও ভূমিকম্প থেকে বাঁচার জন্য বাচ্চাদেরকে নানানরকম সচেতন করানো হয়। এসব করার অর্থ কী? কারণ হলো সবাইকে সচেতন করা, নিয়ম মানতে উৎসাহিত ও বিপদ থেকে রক্ষা পেতে রপ্ত করে তোলা। এসব করা হলে বেইলি রোডের এ অগ্নিকাণ্ডে এরকম বড় সংখ্যার জানমাল হারাতে হতো না।
সংবেদনশীল মনের মানুষ হওয়ার যন্ত্রণা হলো প্রতিটি বিষয়ে ভাবা আর কষ্ট পাওয়া। শোকে মুহ্যমান হয়ে কেবল বেইলি রোডে অগ্নিশিখায় জ্বলন্ত ভবন ও বের হওয়া লাশদের কথা ভাবছি। ভাবছি স্বজনদের কথা। প্রথমেই প্রশ্ন আসে কেন ঘটে, কারা দায়ী? যারা ভাবি ইলেক্ট্রিসিটি বা গ্যাসের লাইন নিয়ম না মেনেও নেওয়া যাবে; যারা ভাবি এসব ইউটিলিটির ক্যাবল বা পাইপ কমদামি মানহীন হলেও হবে; যারা ভাবি কিচেনের নিরাপত্তার জন্য আলাদা জনবল নিয়োগ করে বাড়তি খরচ করার দরকার নেই; যারা ভাবি ভবন নির্মাণে গুণগত মান বজায় রাখার দরকার নেই; যারা পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা ভবনে রাখি না। যারা ভবনে পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপক রাখি না; যারা আলাদা সিঁড়ি ও বিকল্প একজিট রাখি না। (অনেক ভবনে কেবল সিঙ্গেল লিফট। বিকল্প একজিট নেই, এমনকি সিঁড়িও নেই।)
যারা এসব নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয় নিয়মিত তদন্ত করা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্বে থেকেও দায়িত্ব পালন করেন না তারা দায়ী। যারা ইন্সপেকশনকারী কর্মকর্তাদেরকে ফোন করে তদবির করে ছাড় দিতে বলেন- সেসকল বড় লাটরা দায়ী। তাহলে কারা দায়ী নয়? কেবল বেইলি রোডের ওই ভবনের মালিক দায়ী? না, সকল ভবনমালিক যারা এসব মানে না এবং সকল অফিস যারা মানানোর দায়িত্বে থেকেও মানাই না, আর সেসকল তদবিরকারী যারা এসব অন্যায়ের পক্ষে তদবির করেন, তারাই এসব অগ্নিকাণ্ড ও হত্যার জন্য দায়ী।
পরিহাসের বিষয় হলো যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তাদের পরিবার, স্বজন ও আত্মীয়দের বাসায় খোঁজ নিলে দেখা যাবে তাদের অনেকেই বাড়ি, দোকান ও ইউটিলিটি সংক্রান্ত বিধি বিধান মানেন না। তথা না মেনে যারা আমরা ভাবছি জিতে গেলাম, তারাই আবার ভিকটিম হই। মোদ্দাকথা হলো কায়দা করে দায় এড়িয়ে ফায়দা লাভের চেষ্টা করি বটে, তবে আখেরে লাভবান হতে পারি না। কারণ আমরা যারা নিয়ম মানি না বা মানাই না তারা কোনো না কোনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হই, নদী দূষণে, রোগেশোকে, অগ্নিকাণ্ডে, সড়ক দুর্ঘটনায় আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হই। তার মানে কায়দা করে দায় এড়িয়ে কোনো ফায়দা হয় না!
এখন করণীয় কী? ক. ফায়ার রেজিস্টেন্ট বা ফায়ার ফাইটিং বিষয়ে প্রতিটি নাগরিক সচেতন হওয়া ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত সকল বিধিবিধান সঠিকভাবে মেনে চলা। খ. বহুতলভবন করার জন্য বিল্ডিং কোডসহ রাজউকের নির্ধারিত নিয়ম কানুন রয়েছে। সেগুলো মানতে বাধ্য করা গ) রাজউক ছাড়াও পরিবেশ অধিদপ্তর, ফায়ার সার্ভিস, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, সিটি কর্পোরেশনসহ প্রতিটি সংশ্লিষ্ট দপ্তর যথাযথ তদন্ত করে ছাড়পত্র দিতে হবে। এসব ছাড়পত্র প্রদানের ক্ষেত্রে কোনো ধরণের শৈথিল্য প্রদর্শন করা যাবে না।
বিশেষ করে রাজনৈতিক/ব্যবসায়ীক/ আমলাতান্ত্রিক/মিডিয়া/পেশাজীবী ঘরানার উচ্চমহলের কোনো তদবির করা বা তদবির গ্রহণ করা সমীচীন হবে না। গ. যেসব ভবনের অনুমোদন বা ছাড়পত্র নিয়ম না মেনে দেওয়া হয়েছে, রাজউক ও অন্যান্য সকল সংস্থার সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ঘ. নিয়ম না মেনে যদি কেউ ভবন করে, সে ভবনে কোনো ইউটিলিটিজ তথা পানি, বিদ্যুৎ, পয়ঃনিষ্কাশনের সংযোগ পাওয়ার কথা নয়, নিয়ম বহির্ভূত ভবনে যেন কোনো সার্ভিস না দেওয়া হয় সে বিষয়েও সকলকে সতর্ক হতে হবে। ঙ. আধুনিক যন্ত্রপাতি ও লজিস্টিকসহ আধুনিক ফায়ার সার্ভিস প্রস্তুত করা।
একই সঙ্গে যানজট নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি দুর্ঘটনাস্থলে দ্রুত পৌছাতে পারবে না। যানজটের কারণে সময়মত হাসপাতালে পৌছাতে না পারায় বার্ষিক কতজনের মৃত্যু হয়- এই তথ্যও বিবেচনায় রাখতে হবে। সর্বোপরি রাজনৈতিক, আমলাতান্ত্রিক, ব্যবাসায়িক ও পেশাজীবী সংগঠন ও নেতাদের সত্যিকার অর্থেই বিষয়টি অনুধাবন করে দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে।
অনেকেই উৎসুক জনতা নিয়ে সমালোচনা করে। নিশ্চয় অযথা ভিড় বা ভিডিও করা কাজের পরিবেশকে ধীরগতির করে, তবে উৎসুক জনতার অনেকে আবার জীবন বাজি রেখে ফায়ার সার্ভিসকে সহযোগিতা করে। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে এখনও এ মানবিকতার দিকটি আছে। এরকম মানবিকবোধ সম্পন্ন মানুষদেরকে অনুপ্রাণিত করতে হবে। পাশাপাশি নিজেরাসহ সকল স্টেকহোল্ডারকে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
নাগরিকের কর্তব্য ভুলে, ফাঁকি দিয়ে জিতে যাওয়ার লোভে, এখন আমাদের অনেকেই আত্মঘাতি ইঁদুরের ভূমিকা নিয়েছে। নিজেদের তৈরি করা ফাঁদে আমরাই পড়ি ও জানমাল হারাই। অনেকেই অদৃষ্টকে দোষ দিয়ে দায় সারাতে চাইবো, শক্তিশালী স্টেকহোল্ডারগণের একটি অংশ এসব প্রকৃতির খেলা বা সৃষ্টিকর্তার খেলা বলে চালিয়ে দিবে কিংবা ''তাদের মৃত্যু এভাবেই লেখা ছিল'' বাণী আওড়ে গা ভাসাবে।
কিন্তু সমজদার মাত্রই বোঝার কথা নিজেদের তৈরি করা গর্তে আমরা পা দিচ্ছি। আমরা নিজেরা মৃত্যু ডেকে আনছি। আমাদের অবহেলা, সমাজের অনিয়ম, জবাবদিহীতার অভাব, দায়িত্বশীলতার অভাব, আমাদের পরিশীলিত চিন্তার অভাব, আমাদের লোভ এসকল ঘটনার জন্য দায়ী। 'আমার দ্বারা অন্য মানুষের কোনো ক্ষতি হবে না, বা অন্যরা কোনো ঝুঁকিতে পড়বে না'- এ বোধে উজ্জীবিত হওয়ার মতো সংবেদনশীল মনন আমাদের সকলের প্রয়োজন।
ড. সফিকুল ইসলাম: গবেষক ও লেখক
Comments