থেঁতলানো দেহ আর ‘...হাসি পুষ্পের হাসি’

Shahjahan Khan
দুর্ঘটনার পর সংবাদকর্মীদের সে সংক্রান্ত প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন নৌপরিবহনমন্ত্রী শাহজাহান খান। ছবি: সময় টেলিভিশনের ভিডিও ফুটেজ থেকে নেওয়া

পরাধীন দেশে শোষকের অত্যাচার-অন্যায্যতা-নিপীড়ন দেখে কবি নজরুল লিখেছিলেন, ‘দেখিয়া-শুনিয়া খেপিয়া গিয়াছি, তাই যাহা আসে কই মুখে’।

দিন বদলেছে। এখন আমরা ‘খেপে’ যাই না। ‘মুখে যা আসে’ তা বলি না। বলতে পারি না।

আমরা নীরব, নির্বিকার। সবকিছু মেনে নিতে শিখেছি। শিখেছি শুধু নিজে ভালো থাকার কায়দা-কানুন। এই কায়দা উটপাখির বালুতে, হাতির জঙ্গলে মুখ লুকানোর কায়দা। আমি দেখলাম না মানে, কেউ আমাকে দেখল না। ‘আমি তো ভালো আছি, আমার সন্তানের তো কিছু হয়নি’- কী দরকার অন্যকে নিয়ে ভাবার বা ঝামেলায় জড়ানোর!

মিম বা রাজীবের বাবা-মা, আত্মীয়-পরিজন, বন্ধুদের আর্তচিৎকার গিজ গিজ করা এই মানুষের শহরে, কংক্রিটের দেয়ালে দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হয়। ভেতরে দগ্ধ-মর্মাহত মানুষের কিছু করার থাকে না।

থেঁতলানো দেহ যে রাজীব বা মিমের, কষ্ট হয় চিনতে। পিচঢালা রাজপথ আর রাজীব-মিমের রক্ত মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়।

কলেজ ছুটির পর বিমানবন্দর সড়কে তারা দলবেঁধে দাঁড়িয়ে ছিল, রাস্তার পাশে গাছের ছায়ায়। প্রতিদিনই তারা এভাবে দাঁড়িয়ে থাকে বাসের অপেক্ষায়। একটি বাস আরেকটি বাসকে দানবীয় রূপে অতিক্রম করে চাপা দিয়ে দিল রাজীব, মিমদের। দুজন পৃথিবী থেকে চলে গেল। আহত হয়ে হাসপাতালে স্থান নিলো অনেকে। সহপাঠী বন্ধুদের আর্তচিৎকারে ভারি হয়ে উঠল বাতাস-আকাশ। আপনি পত্রিকায় পড়ছেন, টেলিভিশনে দেখছেন। তাও টেলিভিশনে রক্ত, থেঁতলানো ক্ষত-বিক্ষত ছবি দেখাচ্ছে না। তা আপনি সহ্য করতে পারছেন না। চোখ ঘুরিয়ে নিচ্ছেন টেলিভিশনের পর্দা থেকে। একটু চিন্তা করেন সহপাঠী বন্ধুদের কথা। এক মুহূর্ত আগে যে রাজীব-মিম তাদের সঙ্গে হাসিমুখে গল্প করছিল, তারা নেই...। ভাবতে পারছেন? রাজীব-মিমের বাবা-মায়ের স্থানে বসান তো নিজেকে। আপনার সন্তানের দিকে তাকিয়ে ভাবেন একবার, রক্ত-থেঁতলে যাওয়া দেহ...। পারছেন ভাবতে?

আপনি পারেন বা না পারেন, তাতে কিছু যায়-আসে না। যাদের পারার কথা তারা ঠিকই পারেন।

রাজীব-মিম এবং আরও অনেক আহতদের রক্ত বৃষ্টিতে ভেসে যাচ্ছিল, ক্ষিপ্ত বন্ধুরা কিছু বাস ভাঙচুর করছিল। ঠিক সেই সময়ে অন্য একটি অনুষ্ঠানে সংবাদকর্মীদের মুখোমুখি হলেন নেতা-মন্ত্রী শাহজাহান খান। তিনি নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হলেও, মূলত ড্রাইভার হেলপারদের নেতা। নিজের পরিবার-আত্মীয়রা জাবালে নূরসহ অনেক পরিবহনের মালিক। মালিক, শ্রমিকনেতা মন্ত্রীর কাছে সংবাদকর্মীরা জানতে চেয়েছিলেন ঘণ্টাখানেক আগের দুর্ঘটনার বিষয়ে তার প্রতিক্রিয়া। দুই জন শিক্ষার্থীর মৃত্যুবিষয়ক প্রশ্নে মন্ত্রী হাসছিলেন। তার বিগলিত হাসি থামছিল না। বিদ্রোহী কবি যেমন লিখেছিলেন, ’আমি জাহান্নামের আগুনে বসিয়া হাসি পুষ্পের হাসি’-সেভাবেই হাসছিলেন মন্ত্রী।

মনে হচ্ছিল, কোনো সাফল্য বা আনন্দের ঘটনাবিষয়ক প্রশ্ন করা হয়েছে। হাসিমুখে মুখে মন্ত্রী বললেন, ‘যে যতটা অপরাধ করবে, সে সেইভাবে শাস্তি পাবে।’

সংবাদকর্মীরা নাছোড়বান্দার মতো প্রশ্ন করছিলেন, বলছিলেন হত্যাকাণ্ড ঘটানো কেউ আপনার মদদে শাস্তি পায় না...। পরিপূর্ণ হাসি মুখে এবার মন্ত্রী বললেন আসল কথা।

‘শোনেন, কয়েকদিন আগে ভারতের মহারাষ্ট্রে একটা গাড়ি অ্যাকসিডেন্টে ৩৩ জন মারা গেল। এখন সেখানে কী আমরা যেভাবে এগুলোকে নিয়ে কথা বলি, এগুলো কি উনারা কথা বলেন?’

মন্ত্রীর বক্তব্যের অর্থ বা তাৎপর্য বোঝার জন্যে গবেষণার প্রয়োজন হয় না। সহজ-সরলভাবেই বোঝা যায়, ৩৩ জন মারা যাওয়া নিয়ে ভারতে কথা হয় না, দুজন মারা যাওয়া নিয়ে বাংলাদেশে কেন এত কথা হবে? কেন সংবাদকর্মীরা এত প্রশ্ন করবেন?

ভারতে ৩৩ জন রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে বাসের জন্যে অপেক্ষা করছিলেন না। বাস তাদের চাপা দিয়ে হত্যা করেনি। দুর্গম পাহাড়ি পথে বাসটি খাদে পড়ে ৩৩ জন নিহত হয়েছেন। চালকের ভুলে হোক, দুর্গম পাহাড় আঁকাবাঁকা পথের কারণে হোক, এটা একটা দুর্ঘটনা। বাসের জন্যে অপেক্ষমাণ শিক্ষার্থীদের চাপা দিয়ে থেঁতলে দেয়া দুর্ঘটনার সঙ্গে তা তুলনা করা যায় কিনা, তা বিবেচনার বিষয়। হ্যাঁ, দুর্ঘটনা সব দেশেই ঘটে, মানুষ মারাও যায়। কিন্তু বাংলাদেশের মতো এমন নিয়মকানুনহীন দানবীয় ভঙ্গিতে শহরে বা হাইওয়েতে বাস-ট্রাক আর কোনো দেশে চলে? একটি নজিরও দেখানো যাবে? একজন মন্ত্রীর এমন অবস্থানের নজির আছে কোথাও?

মৃত্যু বা দুর্ঘটনার পর বাস, চালক-হেলপাররা চলে আসেন দোষারোপের কেন্দ্রে। পরিসংখ্যান বলে ৪৯% দুর্ঘটনা ঘটে চালকদের দায়িত্বহীন চালানোর কারণে। এখানেই শেষ নয়, আরও কথা আছে। যে বাসটি চালককে দেওয়া হয়েছে, সেটা ফিটনেসবিহীন চলাচলের অনুপযোগী। প্রতি ট্রিপ অনুযায়ী মালিককে ভাড়া পরিশোধ করতে হবে। সকাল থেকে মাঝ রাত পর্যন্ত একজন চালকই গাড়ি চালান। তার ঠিক মতো খাওয়া নেই, বিশ্রাম নেই। পুলিশকে নিয়মিত চাঁদা দিতে হয়। ফলে চালক আইন না মানার সুযোগ পেয়ে যায়। আর মালিক-শ্রমিকদের উভয় নেতা মন্ত্রী হওয়ায়, দুর্ঘটনা বা যা কিছু ঘটাক না কেন- তার শাস্তি হবে না, সেটা চালক-হেলপারদের জানা। বিশেষ একটি কারণে নয়, সামগ্রিক অব্যবস্থাপনার কারণে ঘটে দুর্ঘটনা। নিয়মিত মারা যায় মানুষ। মারা গেলেন রাজীব-মিম।

তা নিয়ে হাসি মুখের নেতা-মন্ত্রীর বক্তব্য শুনেছেন-দেখেছেন, এদেশের মানুষ। রাতে ভাত খেয়েছেন, ঘুমিয়েছেন। সকালে বেরিয়ে পড়েছেন, যে যার কাজে।

আজও দেশের কোথাও না কোথাও মানুষের শরীর থেঁতলে দেবে ক্ষমতাবানদের পরিবহন। তাতে আমাদের কারও ঘুমে কোনো সমস্যা হবে না, শুধু সন্তান বা বন্ধু হারানো কয়েকজন ছাড়া।

Comments

The Daily Star  | English

What are we building after dismantling the AL regime?

Democracy does not seem to be our focus today. Because if it were, then shouldn’t we have been talking about elections more?

8h ago