‘উত্তম খবর’ থেকে মহানায়ক উত্তম কুমার!
বাড়ির ঠিকানা ৫১ নম্বর আহারিটোলা, কলকাতা। আর সময়টা ছিলো ১৯২৬ সালের ৩ সেপ্টেম্বর, দুপুরবেলা। বনেদি চট-ব্যবসায়ী কালিপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায়ের চতুর্থ সন্তান চপলা দেবী পুত্র সন্তান জন্ম দিলেন। বাড়ির পরিচারিকারা কালিপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায়কে বললেন, দাদা মশাই আপনার জন্য একটা খবর আছে। আপনার নাতি হয়েছে। এই খবর শুনে তিনি বলে উঠলেন, বেশ উত্তম খবর। নাতির নামও হবে উত্তম। সেই থেকেই বাংলার কিংবদন্তি অভিনেতার নাম হয়ে গিয়েছিল উত্তম কুমার। আর বাবা সাতকড়ি চট্টোপাধ্যায়ের পদবী চট্টোপাধ্যায় জুড়ে দিয়ে পুরো নাম হয়ে যায় উত্তম কুমার চট্টোপাধ্যায়। যদিও কাগজে-কলমে অরুণ কুমার চট্টোপাধ্যায় ছিলেন এই মহানায়ক।
দ্য ডেইলি স্টারকে এ কথাগুলো বলছিলেন প্রয়াত এই মহানায়কের এক সময়ের বান্ধবী ও সেজমামা রবীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের স্ত্রী ৮৪ বছরের মুকুল মুখোপাধ্যায়। দুদিন আগে ৫১ নম্বর বাড়িতে বসেই কথা হচ্ছিল উত্তম কুমারের জন্ম-ভিটে মামাবাড়ির লনে বসে।
তিনি বলছিলেন, “উত্তম কুমার আর দশটা মানুষের মতো ছিলেন না। ওর মধ্যে একটা জ্যোতি ছিল। খুব সাদা মনের মানুষ ছিলেন তিনি। তবে নিজের কষ্টগুলো কখনোই খুলে বলতেন না। সে কারণেই স্ত্রী গৌরির সঙ্গে বিচ্ছেদের পরও সুপ্রিয়া দেবীর সংসারের খবর আমাদের জানাতেন না।”
আরও বললেন, “তবে যতদিন গৌরির সঙ্গে সম্পর্ক ছিল ততদিন ভীষণই মামাবাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক ছিল। প্রায়ই গৌরিকে পাঠিয়ে দিতেন, রাতে চলে আসতেন নিজে। কষা মাংস, ভাত খেয়ে জমিয়ে আড্ডা দিতেন ভাই-বোন, মামা-মামিদের সঙ্গে।”
“যুবক উত্তম থেকে মহানায়ক উত্তম কুমার হয়ে উঠা সবই চোখের সামনে। কিন্তু, কোনদিনও ওর ভেতর অহংকার দেখিনি,” বলছিলেন মুকুল মুখোপাধ্যায়।
“১৯৮০ সালে ২৪ জুলাই মৃত্যুর খবরটা পৌঁছানোর পর আমরা কেউ স্বাভাবিক থাকতে পারেনি। তেমনই ওর মেঝ মামা গৌরিশঙ্কর মুখোপাধ্যায় বাক-রুদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন। এতো কম বয়সে ভাগনের মৃত্যুর কারণে উত্তমের জন্মভিটে মামাবাড়ির কোনও দেওয়ালে রাখা হয় না উত্তমের ছবি। এটা দেখে সবাই কষ্ট পাবেন- তাই এই রীতি পালন করা হচ্ছে ৩৮ বছর ধরেই,” সিক্ত চোখে এই কথা জানান উত্তম কুমারের প্রয়াত মামাতো ভাই বাবুয়ার স্ত্রী সুর্বণা মুখোপাধ্যায়।
উত্তম কুমারের সেঝমামা রবীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের মেঝছেলে সঞ্জীব মুখোপাধ্যায় বললেন, “পুজোর সময়ই দাদাকে খুব কাছে পেতাম। তিনি আহারিটোলার বিখ্যাত একটি মিষ্টির দোকানের সন্দেশ পছন্দ করতেন, সঙ্গে নিয়ে গিয়ে আমাদেরও খাওয়াতেন। চপলা পিসির বাড়িতে গেলেই পিসির হাতের ট্যাঙরা ও কই মাছ খেতাম। পিসি বলতেন, ‘এই দুটো মাছ ছাড়া উত্তম আর কোনও মাছই পছন্দ করেন না।’ দাদার পছন্দের সেই মাছ সামনে এলে আজও মনে কেমন একটা শিহরণ জাগে।”
উত্তম কুমারের চার মামার কেউ আজ বেঁচে নেই। তবে মামাদের পরিবারের বেশ কয়েকজন সদস্য বেঁচে আছেন। তাদের কাছে উত্তম কুমার মহানায়ক নন, কারো কাছে তিনি ভাগনে কিংবা কারো কাছে দাদা, কিংবা ভাসুর।
৫১ নম্বর আহারিটোলার একশো বছরের প্রাচীন ওই বাড়ির দেওয়ালে, আসবাবপত্রে এখনও উত্তম কুমারের শৈশব, কৈশোর ও যৌবনের যেমন স্মৃতি লেগে রয়েছে, তেমনি উত্তম-বিয়োগের ক্ষতচিহ্ন এখন দগদগ করছে সবার মনে, স্মৃতিতে।
Comments