বাঙালি ফুটবল মন

বাঙালির স্বপ্নের দেশ আমেরিকা। ভালোবাসা ব্রাজিল- আর্জেন্টিনা- ইরান বা আফ্রিকার কোনো দেশের প্রতি। আমেরিকার প্রতি বিদ্বেষ।
ছবি: এএফপি

বাঙালির স্বপ্নের দেশ আমেরিকা। ভালোবাসা ব্রাজিল- আর্জেন্টিনা- ইরান বা আফ্রিকার কোনো দেশের প্রতি। আমেরিকার প্রতি বিদ্বেষ।

বিশ্বকাপ ফুটবলে আমেরিকার সঙ্গে ল্যাটিন আমেরিকান কোনো দেশের খেলায়, আমাদের অবস্থান সব সময় আমেরিকার বিপক্ষে। প্রাণ দিয়ে সমর্থন করি ল্যাটিন দেশটিকে। দেশটি আর্জেন্টিনা বা ব্রাজিল হলে তো কথাই নেই। যতটা জোর দিয়ে ল্যাটিন দেশটির বিজয় চাই, তাই চেয়ে বেশি আমেরিকার পরাজয় প্রত্যাশা করি। ব্রাজিলের সঙ্গে কিছু আমদানিজনিত বাণিজ্যিক স্বার্থ থাকলেও, ল্যাটিন অন্য কোনো দেশের সঙ্গে তেমন কিছু নেই বললেই চলে।

ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা বা ল্যাটিন কোনো দেশে আমরা কাজের জন্যে যেতেও চাই না। সন্তানকে পড়ালেখার জন্যে পাঠাতে চাই আমেরিকা।

আমেরিকায় ব্যক্তি পর্যায়ে যাওয়ার বিষয় ছাড়াও, বিশাল বাণিজ্যিক স্বার্থ বাংলাদেশের। বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের বাজার আমেরিকা। যে পোশাক শিল্প মালিকরা আমেরিকার বাজারে তৈরি পোশাক রপ্তানি করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন, তাদেরও প্রায় সবাই ফুটবলে আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল বা ইউরোপের কোনো দেশের সমর্থক। যারা আমেরিকায় বৈধ- অবৈধ অর্থে বাড়ি কিনেছেন, সম্পদের মালিক হয়েছেন-তাদেরও প্রায় সবাই ফুটবলে ল্যাটিন, ইউরোপ বা আফ্রিকার সমর্থক, আমেরিকার নয়।

২.

যেকোনো কিছুর বিনিময়ে আমরা যেতে চাই ইউরোপের কোনো দেশে। সেখানে একটি কাজ চাই, নাগরিকত্ব চাই। স্থায়ীভাবে থেকে যেতে চাই। সন্তান,আত্মীয়- পরিজনদের নিয়ে যেতে চাই।

আমেরিকার ক্ষেত্রে বলা যেতে পারে, তারা ফুটবল অত ভালো খেলে না। কিন্তু ইউরোপ?

তারা তো ভালো ফুটবল খেলে। বাঙালির প্রিয় ফুটবল বাঁচিয়ে রেখেছে বা বেঁচে আছে ইউরোপের কারণে। ফুটবলের যে অর্থ- বাণিজ্য,তার প্রায় পুরোটাই ইউরোপ নির্ভর। ম্যারাডোনা থেকে মেসি, তাদের বিকাশ- প্রতিষ্ঠা সবই ইউরোপে। শারীরিকভাবে অসুস্থ শিশুটি যদি আর্জেন্টিনা থেকে স্পেনে আসার সুযোগ না পেতেন, অন্য গ্রহের ফুটবলার হিসেবে খ্যাত লিওনেল মেসির দেখা মিলতো? মেসির মেসি হয়ে ওঠা, প্রতিষ্ঠা- বিত্ত সবই তো বার্সেলোনায় খেলে। স্পেন যে ভালো ফুটবল খেলে না, তাও নয়। ল্যাটিন দলগুলোর চেয়েও ভালো ফুটবল খেলেই তারা বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। একজন ইনিয়েস্তা যেকোনো তারকা ফুটবলারের চেয়ে বড় তারকা। ফুটবল শৈলীতেও তিনি অনন্য। কিন্তু বাঙালি মনে স্থান পেয়েছেন মেসি বা নেইমার, ইনিয়েস্তা নয়। রোনালদো- মেসি বিতর্কে বাঙালির বেশির ভাগ সমর্থন মেসির দিকে।

আমেরিকার মত বাংলাদেশি তৈরি পোশাকের বড় বাজার ইউরোপ। পড়ালেখার জন্যেও যেতে চাই ইউরোপে। বিশেষ করে ইংল্যান্ডে। ফকল্যান্ড যুদ্ধের পর বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা- ইংল্যান্ড যখন মুখোমুখি হলো, বাঙালি প্রায় যুদ্ধাবস্থা তৈরি করে আর্জেন্টিনাকে সমর্থন করল। ম্যারাডোনারসম তো নয়-ই, একজন বাতিস্তুতা- বুরুচাগা বা ক্যানিজিয়াসম সমর্থনও বাঙালি মন কোনোদিন লিনেকারকে দেননি।

ইয়োহান ক্রুইফ, বেকেনবাওয়াররা ফুটবল নান্দনিকতায় কারও চেয়ে পিছিয়েছিলেন না। তাদেরকে বলা হয় টোটাল ফুটবলের জনক।

ক্রুইফের দুর্ভাগ্য বিশ্বকাপ জিততে পারেননি। বেকেনবাওয়ার খেলোয়াড়- অধিনায়ক হিসেবে বিশ্বকাপ জিতেছেন। দলকে বিজয়ী করেছেন কোচ- ম্যানেজার হিসেবেও। তারপরও তারা বাঙালি মনে ম্যারাডোনা- রোনাল্ডো- রোমারিও- মেসিদের কাছাকাছি জনপ্রিয়তাও পাননি।

৩.

পৃথিবীর অন্যতম ফুটবল পরাশক্তি ইতালি এবার বিশ্বকাপে নেই। তা বাঙালি মনে সামান্যতম কোনো গুরুত্ব পায়নি। আর্জেন্টিনা বা ব্রাজিল যদি বাদ পড়তো, বেদনায় নীল হয়ে যেত বাঙালি মন। ম্যারাডোনা- নেইমারদের বাধা দিতে যারা ফাউল করে বাঙালি মন তাদের প্রতি ক্ষিপ্ততা দেখায়।

ম্যারাডোনার হাত দিয়ে করা গোলও বাঙালি মনে ফুটবল নান্দনিকতা হিসেবে স্থান পায়। আর্জেন্টিনার বিপক্ষে বিতর্কিত পেনাল্টিতে যখন জার্মানি চ্যাম্পিয়ন হয়, ম্যারাডোনার চেয়ে বেশি কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে বাঙালি মন।

ম্যারাডোনার মাদকাসক্ত হয়ে পড়া, ক্যানিজিয়াদের মাদকাসক্ত করে তোলার পরও বাঙালি মন ম্যারাডোনার জন্যে কাঁদে। পুরো দল যার মাদক নেওয়ার কারণে বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নেয়, সেই ম্যারাডোনার কোনো দোষ দেখে না বাঙালি মন। সাংবাদিকদের এয়ারগান দিয়ে গুলি করলেও, বাঙালি মন ম্যারাডোনার প্রতি এতটুকু বিরূপ হয় না। রাশিয়ার ধূমপানমুক্ত স্টেডিয়ামেও, ম্যারাডোনা চুরুট ধরাতে পারেন। ঈশ্বরের হাত দিয়ে গোল করা ম্যারাডোনা বাঙালি মনে প্রায় ঈশ্বরতুল্য।

বেকেনবাওয়ার, লোথার ম্যাথিউস বা প্লাটিনিরা এর ছিটেফোটা পরিমাণ কিছু করলেও, ছি ছি রব উঠত বাঙালি মনে।

৪.

আমেরিকা বা ইউরোপের কোনো দেশের সঙ্গে আফ্রিকার কোনো দেশের খেলায় বাঙালি মন সব সময় আফ্রিকার দিকে ঝুঁকে থাকে।

এমন না যে আফ্রিকানরা ইউরোপের চেয়ে ভালো ফুটবল খেলে।

একজন রজার মিলা, রশীদ ইয়েকিনি বা কানু বাঙালি মন থেকে যতটা শ্রদ্ধা- সমর্থন- ভালোবাসা পান, সর্বকালের অন্যতম সেরা রুড গুলিত- ভ্যান বাস্তেন- বার্গক্যাম্পরাও তা পান না। শৈল্পিক ফুটবলই যদি সমর্থন- ভালোবাসার মাপকাঠি হয়, আফ্রিকান যেকোনো দেশের চেয়ে ইউরোপ এগিয়ে থাকবে বহুগুণ। বিজয় যদি মাপকাঠি হয়, তাতেও তুলনা চলে না। আমেরিকা- ইরান খেলা হলে প্রায় সব বাঙালি থাকতো ইরানের পক্ষে। ২০০২ সালে দক্ষিণ কোরিয়া বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে পর্যন্ত খেলেছিল, তবু বাঙালি মনে তাদের অবস্থান জাপানেরও পরে। যদিও জাপানিরা এশিয়া কাপে সবচেয়ে বেশি চ্যাম্পিয়ন।

৫.

বাঙালি মন কিংবদন্তি আসক্ত। কিংবদন্তি দিয়ে আমরা বিশ্বসেরা হতে চাই।

যেমন, ফুটবলার সামাদকে বাঙালি জাদুকর উপাধি দিয়েছে। কিংবদন্তিতে সামাদ শুধু পৃথিবীর সর্বকালের সেরা ফুটবলারই নন, তার চেয়েও বেশি কিছু। এমন কিংবদন্তি পৃথিবীর আর কোনো ফুটবলারকে নিয়ে আছে বলে জানা যায় না। সামাদের শট গোল পোস্টের কয়েক ইঞ্চি উপর দিয়ে চলে গেল। গোল পোস্টের মাপ ঠিক নেই, চ্যালেঞ্জ করলেন সামাদ। মেপে দেখা গেল, গোল পোস্ট চার ইঞ্চি নিচু।

আরেক খেলায় সামাদের শট গোল পোস্টের পাশ দিয়ে চলে গেল। সামাদ চ্যালেঞ্জ করলেন। মেপে দেখা গেল গোল পোস্ট কয়েক ইঞ্চি ছোট।

সামাদের শটে এত জোর ছিল যে, বল ধরার পর গোলরক্ষক বলসহ গোল পোস্টে ঢুকে যেতেন। জমিদাররা সামাদকে তাদের দলে খেলানোর জন্যে নিয়ে যেতেন। মাঠে নামার সময় সামাদ জমিদারের কাছে জানতে চাইতেন, গোল কয়টি দেব? জমিদার হয়ত বলতেন তিন চারটি। সামাদ বল নিয়ে সারা মাঠে নৈপুণ্য দেখাতেন, গোল করতেন না। জমিদার চিন্তিত হয়ে পড়তেন। খেলা শেষ হওয়ার দশ পনেরো মিনিট আগে সামাদ পটাপট তিন চারটি গোল দিয়ে মাঠ ছাড়তেন। ইংল্যান্ডের কোনো কোনো বিখ্যাত ফুটবলার নাকি সামাদকে বিশ্ব সেরা হিসেবে স্বীকৃতিও দিয়েছেন। কে কোথায় বলেছেন, তার সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই।

বাস্তবতা বিবর্জিত এসব গল্প গ্রামে- গঞ্জে এখনও চালু আছে।

অবিশ্বাস্য কিংবদন্তি বাঙালি মনে বিশ্বাসযোগ্যতা পেয়েছে।

কিংবদন্তির সূত্র ধরেই বাঙালি মনে ল্যাটিন প্রেম জাগ্রত হয়েছে।

আবেগ বাঙালির পছন্দের বিষয়। ল্যাটিন ফুটবলে তা পুরো মাত্রায় আছে।

পেলে কিংবদন্তি সম্রাট। বাঙালি মনে যা স্থায়ী আসন করে নিয়েছিল। বাঙালির ল্যাটিন আমেরিকা প্রীতি মূলত পেলের কারণে। খেলা দেখে যতটা না, তার চেয়ে বহুগুণ বেশি গল্প শুনে। সত্য- অর্ধ সত্য গল্পগুলো কিংবদন্তির মর্যাদা পেয়েছে মুখে মুখে।

১৯৮৬ সালে হিমালয়সম পেলের অবস্থান নড়বড়ে করে দিলেন একজন ডিয়েগো ম্যারাডোনা। কে সেরা, পেলে না ম্যারাডোনা? তর্কটা সারা পৃথিবীতে আছে, বাঙালি মনে একটু বেশি আছে। বাঙালি মন অনেকটাই ঝুঁকে আছে ম্যারাডোনার দিকে। গল্পে শোনা পেলের চেয়ে, খেলা দেখে ম্যারাডোনার প্রতি ভালোবাসা অনেক গুণ বেশি। ম্যারাডোনার মধ্য দিয়ে ব্রাজিলের পাশাপাশি বাঙালি মন দখল নিয়েছে আর্জেন্টিনাও। ল্যাটিন প্রেম আরও তীব্র হয়েছে। ম্যারাডোনাদের দারিদ্র, বস্তি থেকে উঠে আসা, জীবন সংগ্রামের কিংবদন্তিতে বাঙালি মন আলোড়িত হয়েছে। কোথায় যেন নিজেদের সঙ্গে এক ধরণের মিল খুঁজে পেয়েছেন। সমর্থনের ক্ষেত্রে এটা হয়ত একটি কারণ। ইউরোপিয়ানদের জীবনে দারিদ্র নেই। বিস্ময়কর কিংবদন্তির গল্প নেই।

পরাজিত হলে পেশাদারিত্বের পরিচয় দিয়ে মাঠ ছাড়ে, চোখ দিয়ে পানি খুব কম ক্ষেত্রেই বের হয়। ম্যারাডোনা- মেসি- নেইমাররা পরাজিত হলে, নিজেরা কাঁদে- পুরো পৃথিবীকে কাঁদায়। ফুটবল তারা শুধু পা বা মাথা দিয়ে খেলেন না, হৃদয় দিয়েও খেলেন। ইউরোপিয়ানদের খেলায় হৃদয় বা আবেগের গুরুত্ব কম, বেশি পেশাদারিত্ব। খেলেন যন্ত্রের মত। যা সাধারণত বাঙালি মন স্পর্শ করে না।

ইউরোপের তারকাদের সঙ্গে বাঙালি মন নিজেদের কোনো মিল খুঁজে পায় না। তারা বহু দূরের কেউ, কাছের নয়- আপন নয়।

শ্রেণিগত অবস্থানে বাঙালি মন সব সময় নিপীড়িত- নির্যাতিতদের পক্ষে। আফ্রিকান কালোদের প্রতি বাঙালি মনের দরদ দৃশ্যমান হয় প্রতিটি বিশ্বকাপে। নিপীড়নের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে, কিছুটা ধর্মীয় কারণে, সমর্থন করে ইরান বা অন্য কোনো মুসলিম দেশকে।

রাজনীতিকে খেলা থেকে দূরে রাখার কথা বলা হয়। বাস্তবে খেলাকেও নিয়ন্ত্রণ করে রাজনীতি। একটু ভালো থাকার জন্যে আমেরিকা যেতে চাইলেও, বাঙালি মনে আমেরিকার প্রতি ভালোবাসাহীন বিদ্বেষও রাজনীতির কারণেই, খেলার কারণে নয়।

Comments

The Daily Star  | English
Who is Kalpana Chakma

Who is Kalpana Chakma?

As a “new” Bangladesh emerges, knowing who Kalpana Chakma is becomes crucial in understanding our shared history

4h ago