উৎস থেকে নিরন্তর

দেশভাগের পরের পাকিস্তান। পূর্ব এবং পশ্চিমে দুটি প্রদেশ নিয়ে পাকিস্তান নামের দেশটির জন্ম। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজশাহী অঞ্চলে জন্ম হয় এক ফুটফুটে মেয়ে শিশুর। বাচ্চাটি যত বড় হয়, তার দুরন্তপনা ততই বাড়ে। প্রকৃতির সঙ্গেই যেন তার একাত্মতা, সবুজের লীলাভূমি কেবলই যেন তাকে ডাকে। খাল-বিলের মাঝে দেখতে অদ্ভুত কিছু ফুলের দেখা পায় সে। বড়রা তাকে বলে এগুলো নাকি ফুল না, শামুকের ডিম, এখান থেকে হাজার হাজার শামুক বেরোবে। শুনে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায় দুরন্ত মেয়েটি।
Selina Hossain
কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন। ছবি: সংগৃহীত

দেশভাগের পরের পাকিস্তান। পূর্ব এবং পশ্চিমে দুটি প্রদেশ নিয়ে পাকিস্তান নামের দেশটির জন্ম। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজশাহী অঞ্চলে জন্ম হয় এক ফুটফুটে মেয়ে শিশুর। বাচ্চাটি যত বড় হয়, তার দুরন্তপনা ততই বাড়ে। প্রকৃতির সঙ্গেই যেন তার একাত্মতা, সবুজের লীলাভূমি কেবলই যেন তাকে ডাকে। খাল-বিলের মাঝে দেখতে অদ্ভুত কিছু ফুলের দেখা পায় সে। বড়রা তাকে বলে এগুলো নাকি ফুল না, শামুকের ডিম, এখান থেকে হাজার হাজার শামুক বেরোবে। শুনে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায় দুরন্ত মেয়েটি।

করতোয়া নদীর মাঝি ভীষণ মন কাড়ে তার। বড়দের নামিয়ে তারপর সে বাচ্চাদের নদী পার করে দেয়। বড়রা ওকে বলে, “ওরা কি তোমাকে টাকা দেবে?” শুনে মাঝি বলে, “ওদের কাছে তো আমি পয়সা চাই না, ওরা আমার ভবিষ্য, ওদের আমি বড় করতে চাই।” শুনে ভীষণ ভালো লাগে মেয়েটার।

বগুড়ার লতিফপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ে তখন মেয়েটি। ক্লাসের শিক্ষক তখন ছড়া পড়ান, ‘পাখি সব করে রব, রাতি পোহাইল, কাননে কুসুম কলি সকলই ফুটিল।’ তারপর তিনি বলেন, ‘তোরা সবাই কুসুম কলি, তোদের ফুটে উঠতে হবে।’ এমন করে আশপাশের সবাই মেয়েটাকে শেখায় কেমন করে মানুষ হতে হয়, কী করে ফুটে উঠতে হয়।

১৯৬৪ সালে মেয়েটি তখন রাজশাহী মহিলা কলেজে পড়াশোনা করে। রাজশাহীর কমিশনারের উদ্যোগে একটি গল্প লেখা প্রতিযোগিতায় গল্প পাঠায় সে, আর তার গল্পই প্রথম স্থান অধিকার করে! তারপর বিশ্ববিদ্যালয়ে ওঠার পর তার এক শিক্ষক তাকে বলেন বই প্রকাশ করতে। একটা বই থাকলে চাকরি পেতে অনেক সুবিধা হবে। মেয়েটি তখন বলে, “কে আমার বই প্রকাশ করবে?” শিক্ষক বলেন, “কেউ করবে না। বাবা-মায়ের কাছে যাও, টাকা নিয়ে আস। আমি একটা প্রেসের ব্যবস্থা করে দেব।”

একটা ভালো চাকরি পাওয়ার উদ্দেশ্যে মেয়েটি তার জীবনের প্রথম বই প্রকাশ করে ‘উস থেকে নিরন্তর’। এ বইয়ের সূত্রে মেয়েটি দুটি চাকরি পায়, একটি ছিল পাবলিক সার্ভিস কমিশনে- যেখানে ইন্টারভিউ বোর্ডে উপস্থিত ছিলেন মুনীর চৌধুরী; আরেকটি ছিল বাংলা একাডেমিতে- যেখানে ইন্টারভিউ বোর্ডে ছিলেন কবীর চৌধুরী, ড. এনামুল হক, আব্দুল্লাহ আল মুতী ও ড. নীলিমা ইব্রাহিম।

১৯৭০ সালের ভয়াবহ জলোচ্ছ্বাসে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় ত্রাণ নিয়ে যাওয়ার সময় মানুষের দুর্দশা দেখে সে আরেকটি উপন্যাস লেখে ‘জলোচ্ছ্বাস’ নামে। এবার আর চাকরি পাওয়ার উদ্দেশ্যে না, সাহিত্য সৃষ্টির লক্ষ্যেই বইটি লেখা হয়। এর আগে অবশ্য তার আরেকটি বই বের হয়- নাম ‘উত্তর সারথি’।

মুক্তিযুদ্ধের সময় সেই মেয়েটি তখন অনেক বড় হয়ে গেছে। রাজশাহীতে তার বাবা-মায়ের বাড়িতে বিহারিরা হামলা চালিয়ে সব তছনছ করে দেয়, এমনকি বাবা-মাকে মেরে ফেলার উপক্রম করে! ভাগ্যক্রমে তারা বেঁচে গিয়ে ঢাকায় মেয়ের বাড়িতে চলে আসেন। মেয়েটি তখন বাংলা একাডেমিতে চাকরি করে। একদিন ফেরার পথে তার সামনেই সরদার ফজলুল করিমকে ধরে নিয়ে জেলে পুরে দেওয়া হলো। প্রথমে মেয়েটির খুব কষ্ট হলেও পরে বুদ্ধিজীবী হত্যা শুরু হওয়ার পর তার মনে হয়- তিনি জেলে থেকেই ভালো হয়েছে, বাইরে থাকলে হয়তো তাকেও ধরে নিয়ে গিয়ে মেরে ফেলা হতো।

সায়েন্স ল্যাবরেটরির কোয়ার্টারে মেয়েটির প্রতিবেশী ছিলেন ড. সিদ্দিক নামে এক ভদ্রলোক যিনি সুইডেনে গিয়েছিলেন পিএইচডি করার জন্য। সেখানে এক সুইডিশ ভদ্রমহিলাকে বিয়ে করেন তিনি। ভদ্রমহিলা ধর্মান্তরিত হয়ে তার সঙ্গে এদেশে চলে আসেন। জামায়াতের লোকেরা যখন পশ্চিম পাকিস্তানের পক্ষে ধর্মকে ব্যবহার করে লিফলেট বিলি করছিল, তখন সেই ভদ্রলোক বললেন, “আমার স্ত্রী আমাকে ভালোবেসে তার ধর্ম ত্যাগ করে মুসলমান হয়ে আমাকে বিয়ে করেছিল। কিন্তু আপনাদের মতো মুসলমানদের কাজকর্ম দেখে সে এখন ধর্মত্যাগ করতে চায়।” সেই ভদ্রলোককে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় তার বাড়ি থেকে। তার লাশটিও আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।

‘ললনা’ পত্রিকায় তখন মেয়েটি পাকিস্তানের দোসরদের বিরুদ্ধে লেখালেখি করে। একদিন তাকে খুঁজতে আসে তারা, ওই পত্রিকার সম্পাদক আখতার হোসেন মেয়েটির ঠিকানা না দেওয়ায় তাকেই তুলে নিয়ে হত্যা করা হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর কবি সুফিয়া কামাল মেয়েটিকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলেন, “তুমি বেঁচে আছো! আমি তো ভেবেছিলাম তোমাকে মেরে ফেলেছে!”

এভাবেই জীবনের নানান চড়াই-উতরাই পার হয়ে আজ এতোগুলো বছর ধরে বাংলা সাহিত্যের প্রথম সারির একজন লেখিকা হিসেবে নিজের নাম উজ্জ্বল করে রেখেছে করতোয়া নদীর ধারে দুরন্তপনা করে বেড়ানো সেই মেয়েটি। সাহিত্যের প্রায় প্রতিটি অঙ্গনে তার পদচারণায় সে অর্জন করেছে অসংখ্য পুরস্কার। বাংলা একাডেমি পুরস্কার, রবীন্দ্রস্মৃতি পুরস্কার, স্বাধীনতা পদক, সার্ক সাহিত্য পুরস্কারসহ দেশের সর্বোচ্চ সম্মাননা একুশে পদকও প্রদান করা হয়েছে তাকে। সেই দুরন্ত মেয়েটিই আপনাদের প্রিয় কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন।

অনুলিখনে জোবায়ের আহমেদ

Comments

The Daily Star  | English
Bangladesh per capita foreign debt 2024

Per capita foreign debt more than doubles in eight years

Per capita foreign debt of Bangladesh more than doubled in the last eight years, according to official data, as economists attribute the hike to unplanned foreign-funded projects and corruption, ultimately ballooning the liability on low-income people, including the extremely poor.

13h ago