পাহাড়ে রক্তের খেলা

ইতিহাস লিখতে চাই না। বর্তমান সময়ে থাকতে চাই। পেছনে কিছুটা না ফিরলে আবার বিষয়টি বোঝানোও যায় না। ১৯৬০ সালে পাকিস্তানি শাসকেরা কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্প বানাতে গিয়ে পার্বত্য অঞ্চলবাসীর বঞ্চনার ইতিহাস রচনা করেছিল। কাপ্তাই বাঁধ পার্বত্য চট্টগ্রামের মোট আবাদি জমির ৪০ শতাংশ ডুবিয়ে দিয়েছিল। আগে সতর্ক করা হয়নি। জলবিদ্যুৎ প্রকল্প চালু হলে রাতের আঁধারে ডুবে যায় বহু পাহাড়ির ঘর-বাড়ি। অধিকারের দাবিতে আন্দোলনটা তখন থেকেই শুরু হয়। সেই আন্দোলনের নেতা ছিলেন এমএন লারমা।

স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান যখন সবাইকে বাঙালি বানানোর উদ্যোগ নিলো, তখন দ্বিতীয়বার বঞ্চনা শুরু হলো। চাকমা মারমারা পাহাড়ি, বাংলাদেশি স্বাধীন বাংলাদেশের মানুষ, কিন্তু তারা বাঙালি নয়। তার ভাষা-সংস্কৃতি-আচার-আচরণ জীবনবোধ সম্পূর্ণ আলাদা। স্বাধীন বাংলাদেশ তাদের সেই মর্যাদা দিতে রাজি ছিল না। ১৯৭৩ সালের গণপরিষদে এমএন লারমা অবিস্মরণীয় বক্তব্য রেখেছিলেন। আমি চাকমা, বাঙালি নই- বাংলাদেশের অধিবাসী, প্রতিবাদে ওয়াক আউট করেছিলেন।

স্বাধীন বাংলাদেশ পাহাড়িদের প্রতি সংবেদনশীলতা দেখাতে ব্যর্থ হয়। জিয়াউর রহমানের সময়ে সমতল থেকে বাঙালিদের পাহাড়ে নিয়ে, পাহাড়িদের জায়গা- জমি দখল করানো শুরু হয়। এরশাদের পুরো সময় এই ধারা অব্যাহত থাকে।

জনসংহতি সমিতির সশস্ত্র সংগঠন শান্তিবাহিনীর সঙ্গে, পার্বত্য চট্টগ্রামে যুদ্ধ চলে প্রায় ২৩ বছর। প্রাণ এবং সম্পদের ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ বিপুল। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির মধ্য দিয়ে যুদ্ধের অবসান ঘটে। শান্তির প্রত্যাশা জন্ম নিলেও, শান্তি আসে না। শান্তি যে আসেনি, কয়েক দিন আগে ঘটানো, ৬টি হত্যাকাণ্ড  তার প্রমাণ বহন করছে। কেন শান্তি ফিরল না, কেন এখনও রক্ত ঝরছে, তা নিয়ে কিছু কথা।

 

১.    আজ যখন লিখছি, কালো অক্ষরগুলো যেন লাল হয়ে যাচ্ছে। এই লাল রক্তের লাল, শক্তিমান চাকমার রক্ত। অফিসে বসে যখন শুনলাম রাঙামাটিতে একজন উপজেলা চেয়ারম্যানকে হত্যা করা হয়েছে, অবাক বা বিস্মিত হইনি। হত্যাকাণ্ড, অপহরণ তো পার্বত্য চট্টগ্রামে নিয়মিত বিষয়। ছবি দেখে বাকরুদ্ধ। শক্তিমান চাকমা, শক্তিমান দা! শক্তিমান চাকমার সঙ্গে পরিচয় ১৯৯৯ সাল থেকে। গহীন পার্বত্য চট্টগ্রামের দুর্গম অনেক জায়গায় ঘুরেছি তার সঙ্গে। তার হত্যাকাণ্ডের স্থান, নানিয়ারচরের প্রায় প্রতিটি অঙ্গনই চেনা- জানা। কলেজে পড়াশোনাকালীন ছাত্রলীগ করতেন। তারপর সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জনসংহতি সমিতির রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছিলেন। ২০০৭ সাল পর্যন্ত নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। ‘সংস্কার’র টোপ জাতীয় রাজনীতিকে যেমন কলুষিত করেছিল, পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক রাজনীতিকেও দুষিত করেছিল। জনসংহতি সমিতি ভেঙে একদল ‘সংস্কারবাদী’ জনসংহতি সমিতি (এমএন লারমা) গঠন করেছিলেন। শক্তিমান চাকমাও সেই দলে ছিলেন। তারপর থেকে যোগাযোগ প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ২০১৪ সালে উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হলেন। জেনেছি, কথা হয়নি। যতদূর মনে পড়ে একবার ফোন করেছিলেন, ধরিনি। ফোন ধরার আর কোনো সুযোগ না দিয়ে, চলে গেলেন চিরদিনের জন্যে। ফোন না ধরার কষ্টটা আজ একটু হলেও যন্ত্রণা দিচ্ছে।

 

২. ১৯৯৬ সালের শেখ হাসিনা সরকারের সাহসী সিদ্ধান্ত ছিল পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি। চুক্তির কারণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইউনেস্কো শান্তি পুরস্কারও পেয়েছিলেন। কিন্তু একটি পক্ষ কখনও চায়নি চুক্তির প্রেক্ষিতে শান্তি প্রতিষ্ঠা হোক। জাতীয় এবং আঞ্চলিক রাজনৈতিক চাপে চুক্তির বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে না পারলেও, পক্ষটি নীরব ছিল না। ১৯৯৭ সালেই চুক্তি বিরোধী ইউপিডিএফ গঠন করানো হয়। চুক্তির পর অস্ত্র জমা দিয়ে ফিরে আসা শান্তিবাহিনীর গেরিলারা একের পর এক হত্যাকাণ্ডের শিকার হতে থাকেন ইউপিডিএফের দ্বারা। কারা ইউপিডিএফ গঠন করলো, কারা তাদের দিয়ে হত্যাকাণ্ড ঘটায়,তথ্যগুলো পার্বত্য চট্টগ্রামে অজানা নয়। ইউপিডিএফের হাত থেকে বাঁচার জন্যে জনসংহতি সমিতির একটা অংশ আবার অস্ত্র তুলে নিলো। পাহাড়ে অপহরণ হত্যাকাণ্ড  চলতে থাকল। ইউপিডিএফের ভেতরে আবার বিরোধ বাধিয়ে দেওয়া হলো। ইউপিডিএফের এক নেতা বিদেশে গিয়ে রাজনৈতিক আশ্রয় নিলো। আরেকজন অপহরণ করে মুক্তিপণ এবং হত্যাকাণ্ড চালাতে থাকল ঢাকা এবং চট্টগ্রামে অবস্থান করে। তারপর কিছুদিন আগে ইউপিডিএফও ভাঙা হলো। ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক নামে আরেকটি দলের জন্ম দিয়েছে তারা, যারা চায় না চুক্তি বাস্তবায়ন হোক।

ইউপিডিএফ ভাঙার ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়েছে সংস্কার নামধারী জনসংহতি সমিতি( এমএন লারমা) গ্রুপকে।

এক দলকে দিয়ে আরেক দল ভাঙা- উপদল তৈরি সবই করছে, যারা চায় না চুক্তির মাধ্যমে পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা হোক। তাদের উদ্দেশ্য পাহাড়িদের নেতা জোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় (সন্তু লারমা) লারমার নেতৃত্ব প্রশ্নবিদ্ধ করা, দুর্বল করা। এক পক্ষ বা গ্রুপকে দিয়ে আরেক গ্রুপের নেতা কর্মীদের হত্যা করানোর খেলাধুলা চলছে পার্বত্য চট্টগ্রামে।

 

৩. শেখ হাসিনা সরকার যতটা সাহস নিয়ে চুক্তি করেছিল, বাস্তবায়নের প্রক্রিয়ায় সেই সাহসের পরিচয় দিতে পারেনি। বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় এসে চুক্তি বাস্তবায়নের কোনো উদ্যোগ নেয়নি। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুই বছর পার্বত্য চট্টগ্রামে নিপীড়ন আরও বেড়েছিল। ২০০৮’র নির্বাচনের আগে ১৪ দল প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, বিজয়ী হলে চুক্তি পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়ন করা হবে। বিজয়ী হলেও বাস্তবে চুক্তি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। পরিসংখ্যান দিয়ে বারবার বলা হচ্ছে ৭০ শতাংশ, ৮০ শতাংশ বা ৯০ শতাংশ বাস্তবায়ন করা হয়েছে। বাস্তব চিত্র যদিও এই পরিসংখ্যানের চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন। যেমন-

ক. চুক্তির প্রেক্ষিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ গঠিত হয়েছে। আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান সন্তু লারমা। কিন্তু আইন করে আঞ্চলিক পরিষদকে কার্যকর করা হয়নি।

খ. ‘ভূমি বিরোধ’ পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রধানতম সমস্যা। চুক্তির আগে যুদ্ধ পরিস্থিতিতে লক্ষাধিক পাহাড়ি ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। এই পাহাড়িদের জায়গা জমিগুলো সমতল থেকে নিয়ে যাওয়া বাঙালি যারা ‘সেটেলার’ হিসেবে পরিচিত, তাদের দিয়ে দখল করানো হয়। চুক্তির পর ফিরে আসা পাহাড়িরা তাদের আবাদি জমি ও বাড়ি ফিরে পায়নি। সম্প্রতি আইনগত সংস্কার সম্পন্ন হলেও, বাস্তবে কাজ দৃশ্যমান হয়নি এখনও।

গ. আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে স্থানীয়দের ক্ষমতায়নের বিষয়টি নিশ্চিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

ঘ. অস্ত্র জমা দিয়ে ফিরে আসা শান্তিবাহিনীর গেরিলাদের পুনর্বাসনের কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

ঙ. দল, উপদল, তৈরি করা হয়েছে। সন্ত্রাস-চাঁদাবাজি-অপহরণ চলছে অবাধে। শক্তিমান চাকমা ও আরও পাঁচ জন যেভাবে হত্যাকাণ্ডের  শিকার হলেন, এমন হত্যাকাণ্ড এবং অপহরণ পাহাড়ে খুবই স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে।

 

৪. আগে ছিল শান্তিবাহিনী। জনসংহতি সমিতির সশস্ত্র সংগঠন। তাদের যুদ্ধ চলতো বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর সঙ্গে। সেই যুদ্ধের অবসান হয়েছে ১৯৯৭ সালের চুক্তির মাধ্যমে। এখন শান্তিবাহিনী নেই। নামে-বেনামে অনেক দল উপদল-গ্রুপ তৈরি হয়েছে। চাঁদাবাজি-অপহরণ-হত্যাকাণ্ড ঘটানোই এসব গ্রুপের কাজ। চুক্তি বিরোধী পক্ষটি এসব সন্ত্রাসী গ্রুপ তৈরি করিয়েছে। আগে পার্বত্য চট্টগ্রামে সংরক্ষিত বনাঞ্চল, গহীন জঙ্গল ছিল। ছিল শত বছরের পুরনো গাছ। এই জঙ্গল ছিল শান্তিবাহিনীর আশ্রয়স্থান। শান্তিবাহিনীর অনুমতি নিয়ে অর্থ দিয়ে চোরাচালানীরা গাছ কাটতো। জঙ্গল যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, তাদের লুকানোর জায়গা যাতে অক্ষুণ্ণ থাকে, ইচ্ছেমতো গাছ কাটতে দেওয়া হতো না। চুক্তির পর এসব জঙ্গলে যাওয়ার সুযোগ হয়েছে। দিনের বেলাও রাতের মতো অন্ধকার সেই জঙ্গল। চুক্তির পরের পাঁচ-ছয় বছরে সেই জঙ্গল কেটে পরিষ্কার করে ফেলা হয়েছে। বড় কোনো গাছ নেই বললেই চলে। স্থানীয় সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর সঙ্গে যোগ হয়েছে, মিয়ানমারের সন্ত্রাসী গ্রুপগুলো। কখনও স্থানীয় একটি সন্ত্রাসী গ্রুপ অপহরণ করে, দিয়ে দেয় মিয়ানমারের সন্ত্রাসী গ্রুপের হাতে। দীর্ঘ সময় দেন দরবার করে, মুক্তিপণের বিনিময়ে মুক্তি মেলে। মুক্তিপণ না দিলে অপহৃত ব্যক্তি আর ফিরে আসে না। হারিয়ে যায় পার্বত্য চট্টগ্রামের জঙ্গলে। চুক্তি বা বাস্তবায়ন বিরোধীরা নিয়ন্ত্রণ করে এসব অপহরণ ও মুক্তিপণের বিষয়গুলো।

 

৫. পাহাড়ে রক্তের খেলা বন্ধ বা পরিস্থিতি উত্তরণের পথ কী? সহজ কোনো পথ নেই। পরিস্থিতি দিন দিন জটিল থেকে জটিলতর করে ফেলা হয়েছে। চুক্তির বাস্তবায়ন ছাড়া পরিস্থিতি উন্নয়নের কোনো সম্ভাবনা নেই। পাহাড়ি নেতা সন্তু লারমা এখনও বেঁচে আছেন, সক্রিয় আছেন। তিনি পাহাড়িদের পরীক্ষিত নেতা- অভিভাবক।

পার্বত্য চট্টগ্রামবাসীর পক্ষে, বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে তিনিই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিলেন।

তাকে বিতর্কিত করার প্রক্রিয়া বন্ধ করা দরকার। সন্তু লারমার অবর্তমানে পাহাড়ে সহিংসতা আরও বাড়বে। বাংলাদেশের স্বার্থেই চুক্তির বাস্তবায়ন করা অপরিহার্য। প্রয়োজন রাজনৈতিক সরকারের সাহসী সিদ্ধান্ত। পরিসংখ্যানের লুকোচুরি নয়।

Comments

The Daily Star  | English
US dollar price rises

Explanations sought from 13 banks for higher dollar rate

BB issued letters on Dec 19 and the deadline for explanation ends today

2h ago