গাজীপুরের নির্বাচন ও একটি তালগাছ

ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দেওয়া যায় না। আকস্মিকভাবে এই ভয়ঙ্কর দুর্যোগের শিকার হয় মানুষ। গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনও ভূমিকম্প দ্বারা আক্রান্ত হলো। কেউ কিছু জানা- বোঝার আগে, নির্বাচনী কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেল। অথচ ২০১২ সাল থেকে পূর্বাভাস ছিল যে, এমন কিছু ঘটতে পারে।

ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দেওয়া যায় না। আকস্মিকভাবে এই ভয়ঙ্কর দুর্যোগের শিকার হয় মানুষ। গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনও ভূমিকম্প দ্বারা আক্রান্ত হলো। কেউ কিছু জানা- বোঝার আগে, নির্বাচনী কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেল। অথচ ২০১২ সাল থেকে পূর্বাভাস ছিল যে, এমন কিছু ঘটতে পারে। যাদের সতর্ক থাকার কথা, মানুষকে সতর্ক করার কথা, প্রতিরোধে কার্যকর উদ্যোগ বা ব্যবস্থা নেওয়ার কথা, তার কিছুই তারা করেননি। শুধু তাই নয়, পুরো বিষয়টি গোপন করে, মানুষকে বিপদে পড়তে সহায়তা করেছেন। গাজীপুর নির্বাচনের প্রেক্ষিতে বিষয়টি খতিয়ে দেখা যাক।

 

১. আদালতের যে নির্দেশনায় ৯ দিন আগে নির্বাচনের সকল কার্যক্রম স্থগিত হয়ে গেল, সে বিষয়ে আগে থেকে কেউ কিছু জানলেন না কেন? দায়িত্ব কার, অর্থাৎ কার জানার কথা ছিল?

আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ বলেছেন, ‘এটা আদালতের ব্যাপার। এর সঙ্গে সরকারের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। এখানে সরকারের কিছু করার নেই। আদালত যে কোনো সময় যে কোনো নির্দেশনা দিতে পারেন।’

‘নির্বাচন করে নির্বাচন কমিশন, সরকার নয়’- এই সাধারণ কথাটা বহুল ব্যবহৃত। যখন যারা ক্ষমতায় থাকেন, সেই ক্ষমতাসীনরাই কথাটা মূলত বলেন। এর যে আরও কিছু দিক আছে, তা বলেন না। যেমন বলা হচ্ছে না গাজীপুর নির্বাচনের ক্ষেত্রে।

২. স্থানীয় সরকার নির্বাচন করার দায়িত্ব শুধুই নির্বাচন কমিশনের নয়। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় এই নির্বাচনের সঙ্গে বড়ভাবে সম্পৃক্ত।

‘নির্বাচন করা যাবে বা করতে হবে’- স্থানীয় সরকারের নির্বাচনের ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নেন স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। তারপর নির্বাচন কমিশনকে তারা চিঠি দিয়ে জানান বা অনুরোধ করে নির্বাচনটি আয়োজনের। সীমানা চিহ্নিত- নির্ধারণ- পূনর্নিধারণের কাজটি করেন স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। এই কাজটি নির্বাচন কমিশন করেন না। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় চিঠি দিয়ে নির্বাচন কমিশনকে গাজীপুরে নির্বাচন করতে বলেছে। গাজীপুর সিটি করপোরেশনে সীমানা নিয়ে যে রিটের কারণে নির্বাচন স্থগিত হয়ে গেল, তা চলছে ২০১২ সাল থেকে। রিটকারী স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা এ বি এম আজহারুল ইসলাম প্রথম রিট করেছিলেন ২০১২ সালে, একটি টেলিভিশনকে নিজে তা বলেছেন। কোনো কোনো গণমাধ্যম বলছে, প্রথম রিট হয় ২০১৫ সালে। রিটের প্রেক্ষিতে আদালত দুইবার সমস্যা সমাধানের নির্দেশনা দিয়েছেন। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় সেই আলোকে সমস্যার সমাধান করেছে বললেও, ফাঁক রয়ে গেছে বা রেখে দেওয়া হয়েছিল।

যে কারণে আবার রিট করে স্থগিতের নির্দেশনা পাওয়া গেল।

এই ঘটনা খুব পরিষ্কারভাবে প্রমাণ করে, সীমানা নিয়ে যে বিরোধ আছে তা সাধারণ মানুষ না জানলেও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় জানতো।

স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় বিষয়টি জানতো না, তা বলার সুযোগ নেই। সুযোগ আছে প্রশ্ন তোলার যে, ফাঁক রেখে সমাধান করা হলো কেন-

ক. বিরোধপূর্ণ ছয়টি মৌজা গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের অন্তর্ভুক্ত, এই সিদ্ধান্ত দিয়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় সমস্যার সমাধান করেছে। নির্বাচন কমিশনকে নির্বাচন করতে বলেছে। কিন্তু নিয়মানুযায়ী ঢাকার জেলা প্রশাসনকে বিষয়টি অবহিত করা হয়নি। যা অবহিত করার কথা। রিটের যুক্তিতে এই বিষয়টিই তুলে ধরা হয়েছে। না বুঝে যদি এটা করে থাকে, তবে তা দিয়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের দুর্বলতা এবং ব্যর্থতার চিত্রই প্রকাশিত হয়।

খ. জেনে- বুঝে কাজটি করে থাকলে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে কষ্ট হওয়ার কথা নয় যে, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় চেয়েছে নির্বাচনটি শেষ পর্যন্ত না হোক। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় তো সরকারেরই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়। একটি মন্ত্রণালয়ের কাজের মধ্য দিয়ে সামগ্রিকভাবে সরকারের মনোভাবেরই প্রতিফলন ঘটে।

২. এবার আসি নির্বাচন কমিশন প্রসঙ্গে। ‘আদালত নির্দেশনা দিয়েছে, তা আমাদের মানতে হবে। এখনই মন্তব্য করা যাবে না। আগে দেখি কী নির্দেশনা দিয়েছেন, তারপর ঠিক করতে হবে কী করব’- মোটামুটিভাবে এটাই প্রধান নির্বাচন কমিশনার নূরুল হুদার প্রতিক্রিয়া। বাংলাদেশের সংবিধান আটটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানকে তাদের ক্ষমতা এবং কার্যপরিধি সুনির্দিষ্টভাবে নির্ধারণ করে দিয়েছে। এর মধ্যে নির্বাচন কমিশন বিষয়ে সবচেয়ে সুনির্দিষ্ট ও স্পষ্ট করে বলে দেওয়া হয়েছে। সংবিধানের ১২৩, ১২৪ এবং ১২৫ ধারা এ বিষয়ে যা লেখা আছে, তা ব্যাখ্যা ছাড়াও পরিষ্কার করে বোঝা যায়। এই বোঝার জন্যে সংবিধান বিশেষজ্ঞ হওয়ার দরকার নেই, যে কোনো সাধারণজনও তা বুঝতে পারবেন।

 

১২৫(গ) ধারাটি হুবহু তুলে দিচ্ছি-

‘কোন আদালত, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হইয়াছে এইরূপ কোন নির্বাচনের বিষয়ে, নির্বাচন কমিশনকে যুক্তিসংগত নোটিশ ও শুনানির সুযোগ প্রদান না করিয়া, অন্তর্বর্তী বা অন্য কোনরূপে কোন আদেশ বা নির্দেশ প্রদান করিবেন না। ’

 

এই ধারার প্রেক্ষিতে বিশ্লেষণ-

ক. আদালত নির্বাচন কমিশনকে ‘যুক্তি সঙ্গত নোটিশ ও শুনানির সুযোগ প্রদান করিয়া’- নির্বাচন স্থগিতের নির্দেশ দিয়েছেন কিনা, নির্বাচন কমিশন তা বলতে পারেনি।

একজন নির্বাচন কমিশনার বলেছেন ‘জানা নেই, এখন কিছু বলতে পারছেন না’। প্রধান নির্বাচন কমিশনার যা বলেছেন তা দিয়েও বোঝা যায়, তিনিও এ বিষয়ে কিছু বলছেন না বা বলতে পারছেন না।

খ. ৬ মে রিট হয়েছে, শুনানি এবং স্থগিতের নির্দেশও ৬ মে দিয়েছেন আদালত, এই তথ্য সত্য হলে নির্বাচন কমিশনকে ‘যুক্তিসঙ্গত নোটিশ ও শুনানি’র সময় দেওয়া হয়নি। প্রশ্ন হলো নির্বাচন কমিশন তা জোর দিয়ে বলতে পারছে না কেন?

গ. গণমাধ্যমে আদালতের নির্দেশনা দেখে নির্বাচন কমিশন নির্বাচন স্থগিত করে দিয়েছেন। আদালত থেকে লিখিত কোনো নির্দেশনা পাননি। লিখিত আদেশ ছাড়া নির্বাচনের মত এত জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে নির্বাচন কমিশন। তর্কের খাতিরে যদি ধরে নেওয়া হয়, নির্বাচন স্থগিতের যে সংবাদ গণমাধ্যম তাৎক্ষনিকভাবে জানালো, তা যদি পুরোপুরি সঠিক না হয়ে থাকে, সেক্ষেত্রে কী হবে? নির্বাচন কমিশনের পরবর্তী কার্যক্রম কী হবে, তার জন্যে যদি লিখিত আদেশ প্রয়োজন হয়, নির্বাচনী কার্যক্রম স্থগিতের জন্যে লিখিত আদেশ প্রয়োজন হবে না? গণমাধ্যমের সংবাদের উপর ভিত্তি করে নির্বাচন কমিশন তার কার্যক্রম পরিচালনা করবে?

৩. সংবিধান নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা কতটা সংহত করে দিয়েছে, তা বোঝার জন্যে ১২৫(ক) অনুচ্ছেদটিও দেখে নেওয়া যেতে পারে-

 

‘এই সংবিধানের ১২৪ অনুচ্ছেদের অধীন প্রণীত বা প্রণীত বলিয়া বিবেচিত নির্বাচনী এলাকার সীমা নির্ধারণ, কিংবা অনুরূপ নির্বাচনী এলাকার জন্য আসন-বণ্টন সম্পর্কিত যে কোন আইনের বৈধতা সম্পর্কে আদালতে প্রশ্ন উত্থাপন করা যাইবে না। ’

 

নির্বাচন কমিশন আইনি বিবেচনায় এতটা শক্তিশালী হওয়ার পরও, তাদের কার্যক্রম এত নাজুক কেন? তার মানে কী ব্যক্তির দৃঢ়তাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ ? আইনি ভিত্তি একটি প্রতিষ্ঠানকে যত শক্তিশালীই করে দিক না কেন, যিনি বা যারা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করবেন- তার বা তাদের সাহস- দৃঢ়তা না থাকলে, তা জনস্বার্থের কোনো কাজে আসে না।

৪. রাষ্ট্রের অ্যাটর্নি জেনারেল জনস্বার্থে বাংলাদেশের যে কোনো আদালতে মামলা পরিচালনা করতে পারেন। সংবিধান অনুযায়ী ‘যুক্তিসঙ্গত নোটিশ ও শুনানির সময়’ না দিয়ে যদি নির্দেশনা দেওয়া হয়ে থাকে, যে কোনো সময় প্রতিকার চাইতে আদালতে যেতে পারেন অ্যাটর্নি জেনারেল। এক্ষেত্রে তা না করে , লিখিত আদেশ পাওয়ার জন্যে অপেক্ষার কথা বলেছেন। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের স্থগিত হয়ে যাওয়া নির্বাচন প্রসঙ্গেও একই কথা বলেছিলেন। নির্বাচন কমিশন এখন যা বলছে, তখনও ঠিক তাই বলেছিল। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন অনুষ্ঠানের জটিলতা অবসানের জন্যে তারা কিছু করছেন, তেমন কিছু জানা যায়নি। চুপচাপ বসে আছেন। গাজীপুরের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম কিছু করবেন, বিশ্বাস করা যায় না। প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় নির্বাচন কমিশন সেই বিশ্বাসযোগ্যতা আরও একবার নষ্ট করেছেন।

জাতীয় নির্বাচন নিয়ে গণমাধ্যমের সঙ্গে যে সংলাপের আয়োজন করেছিল নির্বাচন কমিশন, সেখানে বলেছিলাম ‘সীমানা নির্ধারণ বিষয়ক জটিলতাকে কাজে লাগিয়ে নির্বাচন স্থগিতের বহু নজীর আছে। বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে, জটিলতা ছাড়া নির্বাচন অনুষ্ঠানের দিকে মনোযোগ দেওয়া দরকার।’

সীমানা নির্ধারণ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের অতিরিক্ত আগ্রহের প্রেক্ষিতে কথাগুলো বলেছিলাম। যদিও গাজীপুরের নির্বাচনী সীমানা নির্ধারণ করেছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। তবে এখানে যে একটা জটিলতা আছে, তা অবশ্যই নির্বাচন কমিশনের জানা থাকা দরকার ছিল তফসিল ঘোষণার আগেই। এবং নির্বাচন কমিশনেরও বিশেষ ক্ষমতা আছে এক্ষেত্রে ভূমিকা রাখার। যা নির্বাচন কমিশন করেনি।

নির্বাচন কমিশন তার কর্ম দিয়ে নিজে বিতর্কিত হয়েছে, নিজের অযোগ্যতা- অদক্ষতা প্রমাণ করেছে। আওয়ামী লীগের নিজের প্রার্থী জিততে নাও পারে, সরকার সেকারণে নির্বাচন হোক চায় না- এমন প্রচারণাকে ভিত্তি দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। শক্ত এবং নিরপেক্ষ অবস্থান নিয়ে এই নির্বাচন কমিশনের পক্ষে জাতীয় নির্বাচন করা সম্ভব কিনা, সেই প্রশ্ন সামনের দিনগুলোতে বড়ভাবে সামনে আসবে।

৫. একটি তালগাছের গল্প।

তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে সবাইকে ছাড়িয়ে যায় আকাশের দিকে। সে আরও উপরে উঠতে চায়, পাখির মত উড়তে চায়।

ঝড়ের সময় তালগাছের পাখায় যত জোরে বাতাস লাগে, সে মনে করে তত জোরে সে উড়ছে। চিলের মতো উড়ে উঠে যাচ্ছে, আকাশের উপরের আকাশে। ঝড় থেমে গেলে তালগাছটি  বুঝতে পারে, পাখাগুলো ক্ষত- বিক্ষত হয়েছে। সে যেখানে ছিল, সেখানেই রয়ে গেছে কিছু ক্ষত ধারণ করে।

বাংলাদেশের গণতন্ত্র এবং নির্বাচন, ঠিক সেই তালগাছটির মতো।

Comments

The Daily Star  | English

Govt servants must submit wealth statements by November

Government servants will need to submit their wealth statements every year, instead of every five years as they were previously required

52m ago