বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পশ্চিমবঙ্গের গ্রাম জয়ের রেকর্ড মমতার

তৃণমূল কংগ্রেস প্রধান ও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। ছবি: এএফপি

চলমান পঞ্চায়েত নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের ক্ষমতাসীন দল তৃণমূল কংগ্রেস বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রাজ্যটির গ্রামীণ সরকারের প্রায় ৩৪ শতাংশ আসনে জয় নিশ্চিত করেছে। ভোটের আগে বিপুল এই জয় নিশ্চিতে তৃণমূল উচ্ছ্বসিত হলেও প্রবল সমালোচনার মুখেও পড়েছে মমতা ব্যানার্জির দলটি।

বিরোধীদের বক্তব্য, গণতান্ত্রিক পরিবেশ নষ্ট করে বিরোধিহীন ভোট করার যে চ্যালেঞ্জ দিয়েছিল তৃণমূল কংগ্রেস বিনা, প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এমন জয়ের রেকর্ড সেটাই প্রমাণ করে।

যদিও সরকারি দল তৃণমূল কংগ্রেসের পাল্টা বক্তব্য, বিরোধীদের সমর্থন নেই। রাজ্য জুড়ে যে উন্নয়ন হয়েছে; মানুষ নেই উন্নয়নের পক্ষে থাকবেন, আছেন এবং ছিলেনও।

প্রসঙ্গত, আগামী ১৪ মে পশ্চিমবঙ্গের স্থানীয় সরকার অর্থাৎ পঞ্চায়েত ভোট গ্রহণ করা হবে। এর একদিন পর পুনর্ভোট এবং ১৭ মে ভোটের ফলাফল প্রকাশ। মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারে শেষ দিন ছিল ২৭ এপ্রিল।

নির্বাচন কমিশনের সর্বশেষ মনোনয়নপত্র যাচাই বাছাইয়ের ফল বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গের ২৩ জেলার তিন স্তর বিশিষ্ট স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে ৫৮ হাজার ৬৯২ আসনের মধ্যে বিনা লড়াইয়ে ২০ হাজার ৭৬ আসনে জয় নিশ্চিত করেছে তৃণমূল কংগ্রেস।

পৃথক বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, গ্রাম সরাকারের সর্বনিম্ন ধাপ অর্থাৎ গ্রাম পঞ্চায়েতের ৪৮ হাজার ৬৫০টি আসনের মধ্যে তৃণমূলের বিরুদ্ধে ১৬ হাজার ৮১৪ আসনে বিরোধীদের কোনো প্রার্থীই নেই।

একইভাবে দ্বিতীয় ধাপ পঞ্চায়েত সমিতিতে ৩ হাজার ৫৯টি আসনেও প্রার্থী নেই বিরোধীদের। এখানে মোট আসনের সংখ্যা ৯ হাজার ২১৭।

তিন স্তরের সবচেয়ে উঁচু ধাপ হচ্ছে ‘জেলা পরিষদ’। ৮২৫ আসনের মধ্যে তৃণমূলের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নেই ২০৩টি আসনে।

সব মিলিয়ে মোট ২০ হাজার ৭৬টি আসনের তৃণমূল এককভাবে দাঁড়িয়ে বিনা নির্বাচনেই দখল পেলে স্থানীয় সরকারের।

রাজনৈতিক বিশ্লেষণে ফিরে তাকালে দেখা যাচ্ছে, ২০১১ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত এই পাঁচ বছরে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তৃণমূলের শাসনে পৌরসভা নির্বাচন, বিধানসভা উপ-নির্বাচন, স্কুল কিংবা বাজার কমিটির নির্বাচনগুলোতেও প্রায় এককভাবে তৃণমূলের দখলে গিয়েছিল।

সারদা-নারদার অর্থনৈতিক কেলেঙ্কারির পর ২০১৬ সালে বিধানসভা নির্বাচনে মমতা ব্যানার্জির দলের ক্ষমতায় টিকে থাকা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছিল বৈকি। কিন্তু ফলাফল প্রকাশের পর দেখা গেল, ২০১১ সালের চেয়েও বেশি ভোটে দ্বিতীয়বারের মতো মসনদে বসেছেন এক সময়ের ‘অগ্নিকন্যা’ মমতা ব্যানার্জি।

সুষ্ঠু-অবাধ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দল গঠনের মাত্র ১৩ বছরের মধ্যে প্রায় তিন দশকের শক্ত বামফ্রন্টের মতো রাজনৈতিক জোটকে কার্যত খড়কুটোর মতো উড়িয়ে দিয়ে ক্ষমতায় গিয়েছিল তৃণমূল কংগ্রেস। সেটাও একটা রেকর্ড ছিল।

তবে এবার তৃণমূল কংগ্রেস রেকর্ড গড়ল বিনা-ভোটে। বলা ভালো, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় তৃণমূলের ঘরে পঞ্চায়েত নির্বাচনে জয়ের রেকর্ড ঢুকে পড়ল।

রাজ্যের মোট পঞ্চায়েত আসনের প্রায় ৩৪ শতাংশ আসনেই তৃণমূলের বিরুদ্ধে বিরোধী দলের কোনও প্রার্থী না থাকায় এই জয়ে নিশ্চিত হয়েছে টিম তৃণমূল কংগ্রেসের। যদিও বিরোধী বিজেপি, বামফ্রন্ট কিংবা কংগ্রেসের অভিযোগ মনোনয়নপত্র জমা দিতে দেওয়া হয়নি আসনগুলোতে। তৃণমূল ভয়ভীতি, সন্ত্রাস, গুলি ও খুনের পরিবেশ তৈরি করে গণতন্ত্রকে হত্যা করেছে।

২৮ এপ্রিল রাজ্য জুড়ে মনোনয়ন প্রত্যাহারের শেষ দিন ধার্য ছিল। বিভিন্ন জেলায় তৃণমূল বিরোধী অধিকাংশ বিজেপি-কংগ্রেস এবং বামফ্রন্টের প্রার্থীরা সেদিনই মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করেন।

তৃণমূলের এমন বিতর্কিত জয়ে রাজ্যের সবচেয়ে নজরকাড়া জেলা ‘বীরভূম’। লাল রঙের মাটি থাকলেও ওই জেলায় রাজনৈতিক লাল-অর্থাৎ বামদের অস্তিত্ব নেই। একইভাবে অস্তিত্ব নেই কংগ্রেসেরও। তবে বিজেপি সেখানে বরাবরই সক্রিয় ছিল। এবার সেই বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেমেছিলেন ওই জেলার তৃণমূল সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল। বছর জুড়ে নানা বেফাঁস মন্তব্য, বিরোধীদের ওপর হামলা-জুলুমের জন্য আলোচিত অনুব্রত মণ্ডল যদিও মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির স্নেহের পাত্র বলেই পরিচিত।

আর সেই মমতার সৈনিকের সামনে দাঁড়াতে পারেনি ভরতের কেন্দ্রের শাসক দল বিজেপি। মনোনয়ন জমা নিয়ে ওই জেলায় সবচেয়ে বেশি রাজনৈতিক সংঘর্ষ ও খুনের ঘটনা ঘটেছে। আর সে কারণেই ওই জেলায় সবচেয়ে বেশি আসনে তৃণমূল কংগ্রেস বিনা লড়াইয়ে জয় নিশ্চিত করেছে।

দেখা যাচ্ছে, জেলা পরিষদের ৪২টি আসনের মধ্যে সবগুলো আসনেই বিনা লড়াইয়ে তৃণমূলের ঘাস-ফুল জয় পেয়েছে। অর্থাৎ এই আসন গুলোতে কোনো নির্বাচনই হচ্ছে না।

মুর্শিদাবাদে জেলা পরিষদের ৭০টি আসনের মধ্যে ৪৮টি আসনেও একইভাবে লড়াই-হীন জয় পেয়েছে তৃণমূল। এই জেলাতেও বিজেপি, কংগ্রেস এবং বামফ্রন্টের প্রার্থীদের ওপর হামলা, মামলা ও সন্ত্রাস চালানোর অভিযোগ রয়েছে তৃণমূলের বিরুদ্ধে।

একই দৃশ্য বাঁকুড়া জেলার ক্ষেত্রেও। সেখানে ৪৬টি জেলা পরিষদের আসনের মধ্যে ৩১টি আসনেই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় মমতার দলের জয় পেল।

নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা গিয়েছে, মনোনয়নপত্র যাচাই বাছাইয়ের পর জেলা পরিষদের ৮২৫টি আসনে বিজেপি ৭৮২ জন প্রার্থী দেয়। ওই আসনের বিপরীতে এক হাজার প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে শাসক দল তৃণমূলের।

স্থানীয় সরকারের দ্বিতীয় স্তর পঞ্চায়েত সমিতির ৯ হাজার ২১৭ আসনের বিপরীতে বিজেপি ৬ হাজার ১৪৯ জন, সিপিএম ৪ হাজার ৪০০ জন, কংগ্রেস ১ হাজার ৭৪ জন এবং তৃণমূল সব আসনের প্রার্থী দিয়েছে।

আর তিন স্তরের সব শেষ স্তর ‘গ্রাম পঞ্চায়েত’-এ ৪৮ হাজার ৬৫০টি আসনের মধ্যে তৃণমূল সব আসনে প্রার্থী দিলেও বিজেপি দিয়েছে ২৭ হাজার ৯৩৫, বামফ্রন্ট দিয়েছে ২০ হাজার ৩১৯ এবং কংগ্রেসের ৭ হাজার ৩১৩ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।

তৃণমূলের মহাসচিব ও রাজ্যটির শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে এই ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, দেখুন ২০০৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচন থেকেই তৃণমূলের প্রতি গ্রামীণ পশ্চিমবঙ্গ সমর্থন জানিয়ে আসছে। এর আগে গ্রামের চিত্র এবং ২০০৮ সালের পর গ্রামের চিত্রটা ঘুরে দেখলেই বুঝা যাবে, গ্রামের কি পরিমাণ উন্নয়ন হয়েছে। গ্রামের মানুষ এই উন্নয়নকেই সমর্থন করছেন।

বিরোধীদের অভিযোগ নিয়ে ওই নেতা বলেন, আসলে বিরোধীদের পায়ের তলা মাটি নেই। বামফ্রন্ট, কংগ্রেস আর বিজেপি এখন একই গাছেরই ফল। সবাই মিলে সরকারের বিরুদ্ধে বলছে। কিন্তু মানুষ এইসব কানে তুলছেন না।

পার্থ চট্টোপাধ্যায় আশা প্রকাশ করেন ভোটের যেখানে লড়াই হচ্ছে সেখানেও তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থীরাই জয় পাবেন। এবার জয়ের রেকর্ড গড়বে তৃণমূল কংগ্রেস।

বামফ্রন্ট নেতা বিমান বসু দ্য ডেইলি স্টারকে বললেন, বিরোধীরা তো প্রার্থী দিতেই পারেনি। যেখানে প্রার্থী নেই সেখানে জয় শব্দটিই ভুল। যদি লড়াই হতো, তবে জয় নিয়ে কথা হতো। তৃণমূল মনোনয়ন জমা দিতে দিলেই বিরোধীদের শক্তি পরীক্ষা হতো। এটা জয় নয়, গণতন্ত্র হত্যা।

প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীর ভাষায়, এটা প্রহসন। বিরোধীদের হত্যা, মারধর, হুমকি-মামলা দিয়ে মনোনয়ন জমা দিতে দেয়নি তৃণমূল। ওদের এটাই টার্গেট ছিল বিরোধী শূন্য রাজ্য। আর এই বিনা লড়াইয়ে জয়ের রেকর্ড প্রমাণ করে দিচ্ছে আসলেই ওরা গণতন্ত্রকে মানে না।

বিজেপি রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষের অভিযোগ, ভোটের বিজেপির সবচেয়ে বেশি নেতা-কর্মী খুন হয়েছেন, আহত হয়েছেন। বিজেপির নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হয়েছে। পুলিশ পাঠিয়ে শাসানো হচ্ছে। দলের গুণ্ডা দিয়ে বাড়ি বাড়ি হুমকি দেওয়া হচ্ছে। যাতে বিজেপির কোনো প্রার্থী মনোনয়ন জমা দিতে না পারে। তবুও আমরা এইসব হুমকি উপেক্ষা করে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছি। ১৪ মে যদি মানুষ ভোট দিতে পারেন, তবে বিজেপির কি শক্তি সেটা তৃণমূল টের পাবে।

Comments

The Daily Star  | English

Dhaka condemns desecration of national flag in Kolkata

Condemns violent protests outside its Deputy High Commission in Kolkata

1h ago