শরৎ-এর জবা

অলঙ্করণ : সাদাত

১.

ভয়ঙ্কর আওয়াজ করে শান্তি কুটির নামের একটি বহুতল ভবনের ওপর থেকে সাদা টি-শার্ট, কালো জিন্সের প্যান্ট পরা ৩৭-৩৮ বছর বয়সের রনি পড়ে গেল। চার-পাঁচ সেকেন্ডের মধ্যে রনির নিথর দেহটার প্রায় চারদিকে ঘন লাল রক্ত ছড়িয়ে যেতে লাগল। সকাল তখন পৌনে বারোটার মতো হবে। চিত হয়ে পড়ে থাকা রনির মৃত দেহটার চোখ দুটো খোলা। পাশে ভিড় করে থাকা ভীত এবং উৎসুক জনতার কেউ কেউ রনির খোলা চোখ অনুসরণ করে ওপরের দিকে তাকিয়ে ঘটনাটা ঠিক কীভাবে ঘটল সেটা আন্দাজ করার চেষ্টা করছে এবং নানা ভালো-মন্দ মন্তব্য করছে।

২.

রনির অফিস কলিগ সোহেলের বারো তলার অ্যাপার্টমেন্টে সোহেলের প্রমোশন উপলক্ষে পার্টি হচ্ছে। অনেক অতিথি এসেছে সোহেলকে শুভেচ্ছা দিতে। অফিস কলিগের পাশাপাশি সোহেলের বন্ধুরাও পার্টিতে রয়েছে। ড্রইং রুমের ব্যালকনিতে রেলিংয়ের সামনে দাঁড়িয়ে, রনি ওপর থেকে রাতের ঢাকা দেখতে কত আলোকিত লাগে সেটা বলছে আর পাশে গায়ের সঙ্গে গা মিশিয়ে রেলিংয়ে হাত রেখে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে থাকা শর্মির রেশমি চুলে আলতো করে হাত বোলাচ্ছে। রুমের ভেতরে সোহেল বলছে ওর এক বন্ধুকে-

“হিংসা হয় রনিকে দেখলে, বিয়ের আগে সুন্দরী বান্ধবী, তারপর সুন্দরী বউ, এখন আবার সুন্দরীর সাথে পরকীয়া।”

সোহেলের বন্ধু না-সূচক মাথা নেড়ে বলল, “না দোস্ত, এসব ঠিক না, রনিকে ওর কর্মফল একদিন ঠিকই পেতে হবে, পৃথিবীতে ‘কারমা’ বলে একটি শব্দ আছে ভুলে যাস না।” অনেক গান-বাজনা আর খাওয়া-দাওয়ার সঙ্গে চলতে থাকল রাতের আড্ডা।

৩.

শান্তি কুটিরের কার পার্কিংয়ে গাড়ি থেকে নামল রনি আর রনির সহধর্মিণী বেলী। গত প্রায় সাত দিন ধরে বেলী শান্তি কুটিরে ওদের নতুন ভাড়া নেয়া ফ্ল্যাটটি সুন্দর করে সাজিয়েছে। আজকে থেকে ওরা স্থায়ীভাবে বসবাস করা শুরু করল। রনি আর বেলী দু’জনেরই পছন্দ ছিল সি৪ ফ্ল্যাটটি। কিন্তু অনেকেই বলল, কী জানি ঝামেলা আছে ওই ফ্ল্যাটে। এর আগে দু’বার দুটো পরিবার ভাড়া নিয়ে চার-পাঁচ মাসের বেশি থাকতে পারেনি। পানি, গ্যাস সংক্রান্ত কী জানি জটিলতা আছে। ঠিক পরিষ্কার করে কেউ বলল না বা বলতে পারল না। অগত্যা রনি ও বেলীকে ওদের দ্বিতীয় পছন্দের ই৩ ফ্ল্যাটই ভাড়া নিতে হলো।

৪.

সকাল সাতটা পঁয়ত্রিশ। বেলীদের ফ্ল্যাটে নতুন ছুটা বুয়া এসে কলিংবেল চাপল। দরজা খুলল বেলী। দরজার সামনে নিচে পড়ে থাকা খবরের কাগজটা তুলতে তুলতে পাশের সি৩ ফ্ল্যাটের দরজা খোলার শব্দ পেয়ে সেদিকে তাকাল বেলী আর নতুন বুয়াকে ভেতরে যেতে বলল। পাশের ফ্ল্যাট থেকে পাট পাট করে শাড়ি পরা, মেকআপ করা, চুল পেছনে টেনে খোঁপা করা এক মহিলা হাতে ব্যাগ আর চাবি নিয়ে বের হলো। বেলী বলল, ‘গুডমর্নিং, আমরা এই ফ্ল্যাটে নতুন এসেছি।’ রোকেয়া স্মিত হেসে বলল, ‘হ্যাঁ, জানি, একদিন আসবেন চা খেতে। আমি, আমার কর্তা আর আমার ছোট ভাই থাকি। চলি অফিসে যেতে হবে। আসবেন কিন্তু- বলে দরজার দিকে ঘুরে চাবি দিয়ে তালা দিতে দিতে বলল, ‘আপনি কিছু করেন? আচ্ছা আপনার নামটাই তো জানা হলো না।’ বেলী বলল, ‘আমার নাম বেলী, আপনার?’ ‘আমি রোকেয়া, Nice meeting U’ বলল, রোকেয়া। বেলী হাতের পেপারটাতে চোখ বুলাতে বুলাতে বলল, ‘Same Here, নাহ, আমি কিছু করি না। শুধু ফুল গাছ লাগাই আর যত্ন নিই’ বলেই হাসল। ফুল আমার ভীষণ প্রিয়, আমার কয়েকটা টব দেখি কিছুক্ষণ পর ছাদে নিয়ে যাব। বুয়াও আছে, সাহায্য করতে পারবে। রোকেয়াকে কেমন বিচলিত দেখাল, বেলীর এই কথা শোনার পর। লিফটের কলিং বোতাম চেপে বলল, ‘বেলী, ছাদে না যাওয়াই ভালো, এই ভবনের কেউ ছাদে যায় না। ছাদে যাওয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না বোধহয়।’ লিফটের দরজা খোলার পর রোকেয়া ভেতরে ঢুকে পড়ল। বেলী ঠিক বুঝতে পারল না রোকেয়ার কথা। সিঁড়ি দিয়ে ওপরের দিকে তাকাল। ওপরে দুটো ফ্ল্যাট বি৪, সি৪। সি৪ সেই ফ্ল্যাটটা যেটা পছন্দ হওয়া সত্ত্বেও নিতে পারেনি ওরা। তারপর ছাদ। ছাদে কেন যাওয়া যাবে না এটা মাথায় ঢুকল না বেলীর। ভাবল গিয়ে দেখবে নাকি একবার কী আছে ছাদে, পরে চিন্তা করল, নাহ, নতুন বুয়া কাজ করছে, থাক। অন্য সময় যাওয়া যাবে। ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল বেলী।

৫.

রাতে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিয়ে লাইট বন্ধ করে শুয়ে পড়ল রনি আর বেলী। রনি ডান দিকে কাত হয়ে শুয়ে বেলীকে বলল, ওর পিঠটা একটু চুলকে দিতে। বেলী রনির হালকা ফতুয়াটা উঠিয়ে পিঠে নখ দিয়ে আস্তে আস্তে যত্ন নিয়ে ভালোবাসা দিয়ে চুলকে দিতে লাগল। হঠাৎ বেলীর সকালে রোকেয়ার বলা কথাটা মনে পড়ল। রনিকে বলল, ‘শোন, আজকে সকালে না পাশের ফ্ল্যাটের ভদ্রমহিলার সঙ্গে পরিচয় হলো, ভালোই মনে হলো- মিশুক আছে। কিন্তু উনার একটা কথা আমি বুঝতে পারলাম না। রনির প্রায় ঘুম চলে এসেছে। তন্দ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কী কথা? উনি আমাকে এই ভবনের ছাদে যেতে নিষেধ করলেন, আমি বলেছিলাম, আমার ফুল গাছের টবগুলো রাখতে যাব ছাদে, তখন উনি যেতে বারণ করলেন। কেন বল তো?’ বলল বেলী। রনি আবারো ঘুমের ঘোরে কথা জড়িয়ে জড়িয়ে বলতে থাকল, ‘হয়তো রেলিং নেই, দুর্ঘটনা ঘটতে পারে, নিরাপদ নয়, সেই জন্যই হয়তো বারণ করেছে।’ বেলী বলল, তাই? তোমার তাই মনে হয়?’ রনি শুধু ‘হুম’ বলে ঘুমে অচেতন হয়ে গেল। বেলী রনির ফতুয়াটা নামিয়ে চিত হয়ে শুয়ে উপরে চলন্ত পাখাটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে জানালার পর্দার ফাঁক দিয়ে ঘরে ঢুকে পড়া রাস্তার ল্যাম্পের মৃদু আলো আর ধোঁয়াটে অন্ধকারের ঘূর্ণিপাক দেখতে দেখতে চোখটা বন্ধ করল। সঙ্গে সঙ্গে মনে হলো- অনেক পানি খাওয়া হয়েছে, টয়লেটে যেতে হবে। বিছানা থেকে উঠে টয়লেট কাম বাথরুমের লাইটটা জ্বালিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ল। হাতটা ধুয়ে তোয়ালেতে মুছতে যাবে এমন সময় পরিষ্কার একটা মেয়ের গলা শুনতে পেল বেলী। ‘উফ’ মাত্র দুই মিনিট হলো বাথরুমে ঢুকলাম, এত জ্বালাও না তুমি।’ রাত প্রায় একটা বাজে। সব নীরব চুপচাপ। সেজন্যই হয়তো ওপরতলার মেয়েটার কথা পরিষ্কার শোনা গেল। হয়তো নতুন বিয়ে হয়েছে, মনে মনে হাসল বেলী। তারপর গিয়ে রনিকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়ল।

৬.

হালকা মেরুন রঙের তাঁতের শাড়ি, উপরে আড়াআড়ি চিকন চিকন সাদা লাইন টানা, কপালে ছোট কালো টিপ, কোমর পর্যন্ত রেশমি চুলগুলো খোলা, বাঁ ঘাড়ে কালো ব্লাউজের ওপর থেকে ঝুলছে কালো ব্যাগ। ডান হাতে দুটি বই। দুপুর প্রায় পৌনে ৩টা। শান্তি কুটিরের গেটের সামনে রিকশা থেকে নামল জবা। ভাড়া মিটিয়ে গেটের ভেতরে ঢুকে পড়ল। লিফটের সামনে যেতে যেতে অভ্যর্থনা কক্ষ থেকে মজিদ ডাক দিল, ‘আফা, ই৩ ফ্ল্যাটের যে নতুন ভাড়াটিয়া আইসে না, উনি আফনের কথা জিগাইতেছিল। জিগাইলো, আফনে কী করেন। লগে আর কে কে থাকে? কয়দিন ধইরা এইখানে থাকেন, আরো নানা কিছু।’ জবা ক্লান্তভাবে ‘হুম’ বলে লিফটের বোতাম টিপল। এবার মজিদ দৌড়ে জবার কাছে গেল। ‘আফা দেন ব্যাগটা আমার কাসে দেন।’ জবা বলল, ‘লাগবে না মজিদ’। মজিদ আবার বলল, ‘দেন না আফা, আফনের কষ্ট হইতেসে।’ ‘আমার কোনো কষ্ট হচ্ছে না মজিদ, তুমি গেট পাহারা দাও আর ডিউটি শেষ হলে ওপরে এসে বকশিশ নিয়ে যেও’ বলল জবা। মজিদ খুশি হয়ে ‘হ্যাঁ’ সূচক মাথা নাড়ল। ওপরে চলে গেল জবা লিফটে করে।

বাসায় ঢুকে খাওয়ার টেবিলের ওপর বইগুলো আর ব্যাগটা রেখে দরজা আটকাতেই ইন্টারকম বেজে উঠল। ‘উফ! নিশ্চিত মজিদ,’ বিরক্ত হয়ে ফোনটা ধরল জবা। ‘হ্যাঁ মজিদ বলো’, ওই পাশ থেকে বেলী বলল, ‘হ্যালো আমি বেলী, ই৩-তে নতুন এসেছি। আপনি নিশ্চয়ই জবা, মাত্র ফিরলেন না?’ ‘হ্যাঁ, মাত্র ফিরলাম।’ জবা অমায়িকভাবে উত্তর দিল। ‘ওহ ঠিক আছে, আপনি ফ্রেশ হন, পরে ফোন দিব’ বেলী বলল। ‘আচ্ছা ঠিক আছে, আমাদের দু’জনের নামই ফুলের নামে, ভালোই বন্ধুত্ব হবে আমাদের মনে হচ্ছে- রাখছি’ বলে জবা হেসে ইন্টারকম রেখে দিল। তারপর গজগজ করতে করতে বেডরুমে ঢুকল, ‘মজিদ তোর বকশিশ আজকে বাদ, তুই বেলীর চামচাগিরি কর।’ একটু পর আবার জবার রাগী গলা শোনা গেল, জবা কাকে যেন বকছে।’ দেখ আমি আগে গোসল করব, খাব, তারপর তোমার দুনিয়ার আলাপ শুনব, তার আগে একদম যন্ত্রণা করবে না।’ বলে জবা বাথরুমে ঢুকে পড়ল।

৭.

বেলী আর বেলীর বুয়া শিউলীর মা শান্তি কুটিরের ছাদে ফুলের টব নিচ্ছে। প্রায় দশটা টব ওঠানো হয়েছে। এর মধ্যে ছয়টাই বিভিন্ন রঙের গোলাপের গাছ। ছাদ থেকে একতলা নিচে নেমে হাঁপাতে হাঁপাতে সিঁড়িতে বসে  শিউলীর মা বলল, ‘আফাহ, আরো টপ উঠাইবেননি?’ ‘নাহ, ছাদটা তো ভালোই, তাই না শিউলীর মা, পরিষ্কার, ছিমছাম, রেলিংও তো আছে দেখলাম।’ ই৩ ফ্ল্যাটের খোলা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বলল বেলী। ‘জে আফা, বালাই আসে।’ ‘আসো ভেতরে চলে আসো’ শিউলীর মার উত্তরে বলল বেলী। ওরা ভেতরে ঢুকে দরজা আটকে দিল। ড্রইং রুমে পাখাটা ছেড়ে সোফায় বসে ওড়না দিয়ে কপাল আর ঘাড়ের ঘাম মুছতে মুছতে বেলী শিউলীর মাকে বলল, ‘চা বসাও তো শিউলীর মা, আমিও খাই, তুমিও খাও। মাইক্রোওয়েভের পাশে কাচের বয়ামে ঝাল টোস্ট আছে, নিয়ে আসো তো খাই।’ গরম চায়ে ঝাল টোস্ট ডুবিয়ে খেতে খেতে বেলী ভাবল, রোকেয়া কেন সেদিন ছাদ নিয়ে এমন কথা বলল। নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে। জবাকে জিজ্ঞেস করতে হবে। বেলী ভাবল জবার সঙ্গে দেখা করবে আজকে বিকেলে।

৮.

জবার সামনে এক গাদা পরীক্ষার খাতা। লালকালির কলম দিয়ে মার্কিং করছে জবা। এমন সময় ইন্টারকম বাজে। জবার মনে হয় এটা নিশ্চিত ওই নতুন ভাড়াটিয়া বেলী। জবা কলমের মুখ বন্ধ করে উঠে গিয়ে ফোন ধরে। ‘হ্যালো’- ‘হ্যালো, জবা, আমি বেলী, কেমন আছেন, ব্যস্ত?’ বলল, বেলী। ‘হ্যাঁ, আছি ভালোই, নাহ তেমন ব্যস্ত না, খাতা দেখছি।’ বেলী আবার বলল, ‘ওহ, নাহ ভাবছিলাম আড্ডা মারতে আসব। আমার কর্তা ঢাকার বাইরে গেছে তিন দিনের জন্য। আর এখানকার কারো সঙ্গে তেমন পরিচয় হয়নি, শুধু পাশের ফ্ল্যাটের রোকেয়ার সঙ্গে একদিন কথা হয়েছে। ওরাও বোধহয় দেশের বাইরে বেড়াতে গেছে সবাই মিলে, মজিদ বলল’ অপরাধীর হাসি হেসে বলল বেলী। জবা বলল, ‘কোনো অসুবিধা নেই, একা একা লাগলে চলে আসুন গল্প করি কিছুক্ষণ।’ ‘সত্যি?’ আবার জিজ্ঞেস করল বেলী লজ্জাভরা কণ্ঠ নিয়ে। ‘হ্যাঁ, সত্যি, আমি অপেক্ষা করছি, চলে আসুন।’

‘আচ্ছা, ঠিক আছে, জাস্ট ১৫ মিনিটের মধ্যে আসছি’, বলে বেলী ইন্টারকম রেখে রান্নাঘরের দিকে ছুটে গেল।

৯.

‘কী মুশকিল বলুন তো। আচ্ছা আমার বাসায় কী পাউরুটি, পনির, ডিম নেই না কী? কী দরকার ছিল এত খাটুনি করবার?’ পনির আর ডিমের স্যান্ডউইচে কামড় বসাতে বসাতে বলল জবা। ‘আমার কর্তার ভীষণ প্রিয় এই নাশতার আইটেমটা। ও অফিস থেকে ফিরলে প্রায়ই এটা বানিয়ে দিই। ভাবলাম আপনার জন্য নিয়ে আসি, চা দিয়ে খাওয়া যাবে আর আরাম করে বসে গল্প করা যাবে। আচ্ছা আপনার সময় নষ্ট করছি না তো বেশি?’ বলল বেলী। ব্রাউন ব্রেডের স্যান্ডউইচে টমেটো কেচাপ লাগাতে লাগাতে জবা বলল, ‘আপনি আর সৌজন্যতা করবেন না দয়া করে, নইলে কিন্তু আমাদের বন্ধুত্ব বেশিদূর এগোবে না।’ দু’জনেই হেসে উঠল। জবা স্যান্ডউইচে শেষ কামড়টা বসিয়ে চায়ের জল আনতে উঠে গেল ডাইনিং টেবিলের পাশে একটা ছোট টেবিলের ওপর রাখা টি মেকারটার দিকে। ওই ছোট টেবিলেই রাখা আছে দুটো মগ, দুটো চায়ের চামচ, চিনির পট, একটা এয়ার টাইট কনটেইনার বিস্কুট রাখার আর বিভিন্ন ফ্লেভারের টি ব্যাগের প্যাকেট। মগে গরম পানি ঢালতে ঢালতে জবা জিজ্ঞেস করল, ‘গ্রিন টি, সিনেমান টি, ব্ল্যাক টি, দার্জিলিং টি, কেমোমাইল টি, কোনটা দেব? আর চিনি কতখানি?’ ‘ওরে বাবা, মনে হচ্ছে টি গার্ডেনে চলে এসেছি, এত রকম চা খান আপনারা? দিন আপনার পছন্দমতো একটা দিন আর চিনি খাব না, একটু মধু থাকলে দিতে পারেন।’

জবা বেলীর কথা শুনে একটু ভ্রুটা কুঁচকে কিছু একটা ভাবতে ভাবতে রান্নাঘরে ঢুকে কিচেন কেবিনেটে রাখা একটা কাচের পিরিচ আর মধুর কনটেইনারটা নিয়ে ডাইনিং রুমে এসে বেলীর মগে একটু মধু ঢেলে দিল। নিজের মগেও ঢালল, তারপর কেমোমাইল টির দুটো ব্যাগ দুই মগের গরম পানিতে চুবিয়ে দিল। ডাইনিং টেবিলের ওপরে দুটি চায়ের চামচ আর কাচের পিরিচটাও রাখল। ‘একটু মধুটা গুলিয়ে নেবেন চামচ দিয়ে আর টি ব্যাগটি একটু পর উঠিয়ে ফেলেন, নইলে বেশি কড়া মনে হবে। কেমোমাইল টি যদিও রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে খেতে হয় কিন্তু আমরা যেহেতু এখন রিল্যাক্স মুডে আড্ডা দিচ্ছি, তাই খাওয়া যেতেই পারে।’- বলে চামচ দিয়ে মধুটা গুলিয়ে টি ব্যাগটা পিরিচের ওপর উঠিয়ে রেখে গরম চায়ে চুমুক দিল জবা। ‘বাহ, দারুণ’ প্রথম চুমুকেই বলে উঠল বেলী। ‘আমার কর্তাকেও খাওয়াব একদিন আপনার হাতের এই রিল্যাক্সিং চা’ যোগ করল বেলী। ‘অ্যবশ্যই কর্তাকে নিয়ে আসবেন যেকোনো দিন।’ খুশি হয়ে বলল, জবা। ‘শুধু আমরা আসলেই হবে! বন্ধুত্ব বাড়ানোর জন্য তো আপনাদেরও যেতে হবে নিচতলায়, তাই না?’ বলেই বেলী খোলা চুলগুলো খোঁপা করতে লাগল। মনে হলো, সে জবাকে, চারপাশের পরিবেশটাকে আপন করে নিয়েছে। একটু বিব্রত হয়ে জবা বলল, ‘দেখুন, আপনি আসলে ভুল বুঝছেন, আমি একলাই থাকি এখানে। আমি একাই যাব আপনার বাড়ি বেড়াতে আর স্যান্ডউইচ খেতে।’ বলে একটু হেসে বিব্রতবোধটা আড়াল করল। বেলী বলল, ‘বাহ আমাকে বন্ধু বলে ডেকেছেন আর আপনার বন্ধু আপনার সঙ্গে থাকে এটা বলতে লজ্জা পাচ্ছেন। আমি কিন্তু ভীষণ রাগ করলাম’ বলে বাচ্চাদের মতো গোমড়া মুখ করে বসল বেলী। আবারো স্মিত হেসে জবা বলল, ‘আহা, রাগ করার মতো কী হলো, আপনাকে আমি সত্যি বলছি ভাই আমি একলাই থাকি। কোনো বন্ধু বা স্বামী নেই আমার।’ এটা শুনে বেলী মনে মনে ভাবল, তাহলে সেই রাতে যে দিব্যি জবা আর আরেকজনের গলা শুনলাম আমি, আর কথাবার্তাগুলো শুনে মোটেও বাপ-মেয়ে বা ভাই-বোনের কথা মনে হয়নি, কেন এই মেয়েটা মিথ্যা কথা বলছে? বোধহয় বিশ্বাস করতে পারছে না এখনো আমাকে। ভাবছে হয়তো আমি রনিকে বলে দেব আর তাতে রনি ওকে খারাপ ভাববে। আর আমাকে ওর সঙ্গে মিশতে মানা করবে। আহারে, কত চিন্তা করছে জবা এই সামান্য ব্যাপারটা নিয়ে। ওর বন্ধু ওর সঙ্গে দেখা করতে আসতেই পারে রাতের

বেলা। রনি বা আমি কি আর এত ছোট মনের নাকি যে ওকে ভুল বুঝব। বেলী এবার চেয়ারে পা উঠিয়ে আরাম করে হেলান দিয়ে বসতে বসতে বলল, ‘বুঝতে পেরেছি তুমি আমাকে এখনো বিশ্বাস করতে পারছো না আর তাই লুকাচ্ছ যে তোমার ভালোবাসার মানুষটা প্রায়ই তোমার সঙ্গে দেখা করতে আসে। ঠিক আছে, যখন আমাকে পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারবে আর আপন ভাববে তখন তোমাদের গল্প বলো আর তোমার উনার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিও।’ ‘বেলী শোন, আমার ভালোবাসার কোনো মানুষ নেই, সত্যি বলছি তোমাকে’ চেয়ার থেকে একটু সামনের দিকে ঝুঁকে বলল জবা। ‘তাই না? তাহলে রাতের বেলা কার সঙ্গে তুমি কথা বলো এত রোম্যান্টিক হয়ে শুনি একটু। এই রে! তুমি করে বলে ফেললাম আপনাকে।’ হেসে জবা বলল, ‘আমিও কিন্তু একটু আগে তুমি করেই বলেছি। এখন থেকে ‘তুমি’ই ফাইনাল।’ জোরে হেসে উঠল দু’জনেই, সম্মতিসূচক মাথা নাড়ল বেলী। ‘দেখো বেলী, তোমাকে আমি বলতেই পারি যে তুমি যার কণ্ঠ শুনেছো সে কে, কিন্তু তুমি বিশ্বাস করবে না আমার কথা আমি জানি।’ ‘এখানে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের কিছু নেই ভাই, তুমি যদি আমাকে বিশ্বাস করো, যদি বন্ধু মনে করো, তবে মনের কথা বলতে পারো খুলে।’ বলল বেলী, ‘অনেক বড় গল্প, পরে না হয় কোনো এক সময় বলব।’ জবা এড়িয়ে যেতে চাইল।’ না প্লিজ, আমার খাওয়া বদহজম হয়ে যাবে, তুমি এ রকম কোরো না জবা আমার সঙ্গে, তুমি বলো, সংক্ষেপে বলো, আমি বুঝে নেব’ আকুতি করল বেলী। ‘আচ্ছা ঠিক আছে, বেডরুমে চল, বলছি- আরাম করে শুয়ে-বসে গল্প করি।’ দু’জনেই খালি চায়ের মগ রেখে জবার বেডরুমের দিকে রওনা হলো। একটু পর জবা আবার রুম থেকে বের হয়ে ডাইনিং রুম থেকে বিস্কুটের কনটেইনারটা নিয়ে গেল আর খেয়াল করল যে, ডাইনিং টেবিলে রাখা মগ, চামচ, পিরিচ, বেলীর প্লাস্টিক বক্স কিছুই নেই, টেবিলও পরিষ্কার, কোনো পাউটির টুকরো নেই যেগুলো স্যান্ডউইচ খেতে গিয়ে টেবিলে পড়েছিল। আবার বেডরুমে ঢুকে গেল জবা বেলীকে সঙ্গ দিতে।

১০.

জবা তার নিজের বিছানায় পিঠের পেছনে বালিশ রেখে আধশোয়া হয়ে বসেছে। আর বেলী কোলে বালিশ নিয়ে আরাম করে জবার দিকে মুখ করে বসেছে আগ্রহ নিয়ে গল্প শুনবে বলে। জবা শুরু করল, ‘স্কুলে আজকাল যা চাপ যাচ্ছে, ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পড়ি বাসায় ফেরার পর। বাচ্চাদের পরীক্ষা চলছে তো। আরো কিছুদিন থাকবে এই চাপটা, পরীক্ষার খাতা দেখা শেষ হয়ে গেলে কিছুদিন একটু রিলাক্স করতে পারব। তবে তোমার সঙ্গে গল্প করতে ভালোই লাগছে, এনজয় করছি ব্যাপারটা আমি।’ ‘আমারও খুব ভালো লাগছে, তোমাকে আমার খুব আপন লাগছে, তুমি অনেক ভালো, বন্ধুসুলভ’ বলল বেলী। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আবার বলল, ‘তুমি কোথায় পড়াও?’ জবা উত্তরে বলল, ‘এই তো, দুই রোড পরেই যে স্কুলটা আছে না, ‘বেসিক নলেজ’ ওখানে, ক্লাস  ফোর, ফাইভ, সিক্স-এর বাচ্চাদের পড়াই গত প্রায় দেড় বছর ধরে। তুমি কিছু করছ না কেন বেলী?’ ‘করি তো, রান্না করি, ঘর গোছাই, বারান্দায়, ছাদে ছোট বাগান করি, সময় ভালোই কেটে যায় আমার। বলো তোমার গল্প বলো শুনি। তোমার উনার কথা খুব জানতে ইচ্ছা হচ্ছে। আচ্ছা আচ্ছা দাঁড়াও, আগে বল তো, ছাদে কী আছে এই অ্যাপার্টমেন্টের? একজন পরিচিত আমায় ছাদে যেতে বারণ করেছিল। বলেছিল, কী জানি সমস্যা আছে, ছাদে না যাওয়াই ভালো’ বলল বেলী। জবা রহস্যময় হাসি হেসে বলল, ‘ছাদে আমি আর আমার উনি মাঝে মাঝে হাওয়া খেতে যাই, তাই হয়তো তোমায় ভয় দেখিয়েছে।’ বলে জবা চোখ বন্ধ করল। তারপর কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। জবার মনে হলো, সে তার সব অতীত দেখতে পাচ্ছে, পরিষ্কার জলজ্যান্ত হয়ে উঠছে যেন সব পোড়ো স্মৃতিগুলো।

১১.

‘তিন বছর আগের কথা। আমার স্বামীর নাম ছিল জব্বার। আমাকে খুবই অত্যাচার করত, টাকা-পয়সা দিত না ঠিকমতো, ব্যবসার কাজে ঢাকার বাইরে গেলে, বাসার বহু পুরনো কেয়ারটেকারকে আমার হাতখরচের টাকা, বাজারের টাকা দিয়ে যেত। কেয়ারটেকার মিন্টু প্রচুর মদ খেতো। মাঝে মধ্যেই আমার জন্য দিয়ে যাওয়া টাকা সে তার মদের পেছনে খরচ করত। জব্বার একটুও ভালোবাসত না, একটুও শ্রদ্ধা করত না আমাকে। শুধু শুধুই সন্দেহ করত, মারধরও করত। অনেকেই বলত, জব্বারের তুলনায় আমি দেখতে অনেক বেশি ভালো ছিলাম আর ওর চেয়ে বয়সও কম ছিল অনেক তাই জব্বার এমন অস্বাভাবিক আচরণ করত। কী করব, আমার সহ্য করা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। মা-বাবা কেউ নেই, আমি ছোট থাকতেই মারা গেছে, প্রথমে নানা-নানী, পরে এক মামার কাছে বড় হই। নিজের চেষ্টায় এইচএসসি পর্যন্ত পড়েছি। মামার ব্যবসার পার্টনার ছিল জব্বার, এভাবেই আমার বিয়েটা হয় আমার লোভী মামা-মামীর বুদ্ধিতে। জব্বারের এক সৎ ছোট ভাই ছিল, জামাল, জব্বারের তুলনায় অনেক ভালো, মার্জিত, শিক্ষিত। জব্বারই জামালকে পড়াশোনা করিয়ে বড় করেছে। কারণ জব্বারের বাবা জামালের মাকে বিয়ে করেছিল সম্পত্তির কারণে, মহিলা বিধবা ছিলেন কিন্তু অনেক সহায়-সম্পত্তির মালিক ছিলেন। জামাল এসব কাহিনী জানত বলেই, জব্বারকে সবাই ঠিক যতখানি ভয় পেত, ততখানি ভয় সে পেত না, আবার বড় ভাইকে অসম্মানও করত না। জব্বার বেশ বয়স্ক এক ডাইনি ধরনের মহিলার সঙ্গে জামালের বিয়ে দিয়েছিল আমাদের বিয়েরও আরো তিন বছর আগে। আমার প্রতি জব্বারের অবহেলা জামাল একদমই ভালো চোখে দেখত না। আমার প্রতি জামাল সমব্যথিত ছিল আর ভাইয়ের প্রতি বিরক্ত কারণ তার নিজের বিবাহিত জীবনও খুব একটা সুখের ছিল না। জব্বার আমার সঙ্গে যত খারাপ আচরণই করুক না কেন, যতই আমাকে হেয় করুক না কেন, আমি সংসারের সব কাজ নিপুণ হাতে করতাম আর লক্ষ্য রাখতাম জব্বাবের দেখভালে যেন কোনো কমতি না হয়। অনেক সহজ-সরল ছিলাম আমি, মনোযোগ দিয়ে স্বামী-সংসারের যত্ন নিতাম দিনের পর দিন অপমানিত হওয়ার পরও।’

১২.

আমরা যে বাড়িতে থাকতাম, সেটা বেশ বড় ছিল। সামনে ছিল উঠানের মতো খোলা জায়গা আর তার পেছনে তিনতলা বাড়ি। বাড়ির সামনের দিকে লম্বা, বড় বারান্দা। আমার খুব ভালো লাগত ওই বারান্দায় বসে দোলনায় দোল খেতে। জামাল আমাকে একটা দোলনা কিনে দিয়েছিল। বৃষ্টির দুপুরে খুব মন খারাপ থাকলে যখন দোলনায় দুলতাম আর বৃষ্টির আলতো ঝাপটা মুখে-গায়ে এসে পড়ত, মনটা এক নিমিষেই ফুরফুরে হযে যেত।’

১৩.

তিনতলা বাড়ির ছাদে একটা রুমে থাকত মিন্টু। খুব অল্প সময়ই ওকে বাইরের গেটের সামনে একটা কাঠের টুলে বসে গেট পাহারা দিতে দেখা যেত। যদিও ওর আসল এবং প্রধান কাজই ছিল এটা, তবুও বেশিরভাগ সময়েই ঝিমাত মিন্টু। ওই বাড়ির দ্বিতীয় তলায় ভাড়া থাকত শরৎ। ডাক্তারি পড়ত। ওর বাবা মাসে মাসে দেশ থেকে টাকা পাঠাত। গ্রামে শরৎদের অবস্থা বেশ ভালোই ছিল। দেখতে ভারি সুন্দর ছিল শরৎ। বয়সে আমার চেয়ে চার বছরের বড়। ওকে ভীষণ ভালো লাগত আমার। ওর সামনে গেলে কেমন একটা ঘোরের মধ্যে ঢুকে যেতাম আমি, অনেকক্ষণ লেগে যেত সেই ঘোর কাটতে। ধীরে ধীরে শরৎ আমাকে পছন্দ করা শুরু করল। সুযোগ পেলেই সে দেশ, আবহাওয়া, স্বাস্থ্য নিয়ে নানা কথা বলার অজুহাতে আমার কাছে আসার চেষ্টা করত। আমারও ভালো লাগত কিন্তু কখনই আমি প্রশ্রয় দিতাম না। বরং কাজের কথা বলে যত দ্রুত সম্ভব চলে যেতাম। আমি ভেজা কাপড় নাড়তে গেলে ছাদে বা সিঁড়িতে আমাদের দেখা হতো। এভাবে দুই-তিন মাস চলার পর মিন্টুর চোখে ধরা পড়ে বিষয়টা। জব্বারের কান পর্যন্ত পৌঁছাতে বেশি সময় লাগে না। অকথ্য ভাষায় গালাগালি, মারামারি কিছুই বাদ রাখেনি জব্বার। আমার ভীষণ মন খারাপ হয়। আমি প্রতিজ্ঞা করি, আর কোনোদিন শরৎ-এর সঙ্গে কথা বলব না। শরৎ বহু চেষ্টা করেও আমার সঙ্গে তখন আর কথা বলতে পারে না। ঠিক এক মাস পর জব্বারের টিবি হয়। আমি সব ভুলে গিয়ে মন-প্রাণ দিয়ে জব্বারের সেবা করি। জব্বার আস্তে আস্তে সুস্থ হয়ে ওঠে। রাত-দিন পরিশ্রমের পরও জব্বারের মন পাই না আমি। কিছুদিন পর দুর্ভাগ্যবশ্যত আমারও টিবি হয়। কিন্তু আমাকে দেখার কেউ ছিল না। আমি খুব দুর্বল হয়ে পড়ি। এই অবস্থায়  আমাকে রেখে জব্বার তার ব্যবসার কাজে চট্টগ্রাম চলে যায় দুই মাসের জন্য। টাকা-পয়সাও সব যথারীতি দিয়ে যায় মিন্টুর কাছে। একদিন আমি খুব অসুস্থ বোধ করছিলাম আর ভীষণ মৃত্যুভয় হচ্ছিল আমার। সাহায্যের জন্য জামালকে ফোন করেছিলাম, কিন্তু ওর মোবাইলটা বন্ধ ছিল তখন। দরজা খুলে সিঁড়ি বেয়ে শরৎ-এর রুমে যেতে চাচ্ছিলাম। কিন্তু পেরে উঠছিলাম না। এত দুর্বল আর অসহায় লাগছিল নিজেকে বলে বোঝাতে পারব না। সিঁড়িতেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলি আমি। পরদিন সকালে নিজের বিছানায় নিজেকে আবিষ্কার করি। একটা পরিচিত ফ্লেভারের চায়ের গন্ধ পাই। পাশে তাকিয়ে দেখি বসে চা খাচ্ছে শরৎ। সারাদিন নানা ধরনের ফ্লেভারের চা একসঙ্গে মিশিয়ে একটা অদ্ভুত ফ্লেভার তৈরি করে খেত শরৎ। ওর মুখ দেখেই বুঝি নির্ঘুম সারারাত এখানেই কেটেছে। পরে ওর মুখে শুনি, সিঁড়িতে অজ্ঞান অবস্থায় আমাকে পেয়ে কোলে করে এনে বিছানায় শুইয়ে দিয়েছিল। শরৎ আমার সেবা-যত্ন করা শুরু করে। আর ওই সময় মিন্টু সারাদিন মাতলামি করত। আর আমাদের নিয়ে আবোল-তাবোল সব কথা বলত। ধীরে ধীরে আমাকে সেবা করে ওষুধ খাইয়ে সারিয়ে তোলে শরৎ। আমাদের দু’জনের মধ্যেই চাওয়া ছিল। কিন্তু প্রয়োজন ছাড়া কখনই কেউ কাউকে স্পর্শ করিনি আমরা।

১৪.

অনেকদিন পার হয়ে যায় এভাবে। প্রায় দুই মাস। আমি ভাবতে লাগলাম জব্বারের কথা, কেমন মানুষ, কেমন স্বামী, যাকে আমি রাত-দিন না ঘুমিয়ে না খেয়ে সেবা করে সুস্থ করে তুললাম, সে আমাকে অসুস্থ অবস্থায় ফেলে চলে গেল। একটা ফোন করে কোনো খবর নিল না। আমার খুব কষ্ট হয়। মনে হয় কী লাভ এখানে থেকে। ভালোবাসা নেই, সম্মান নেই, মায়া নেই, আমি নিঃস্ব এই পরিবারে। আসলে আমি এই পরিবারের, এই বাড়ির কোনো অংশই নই। শুধুমাত্র ঘটনাক্রমে আমার এখানে থাকা বা অবস্থান। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম জব্বার ফেরার আগে আমি বাসা ছেড়ে চলে যাব কাউকে কিছু না বলে। আমি দুটি হাত ব্যাগে কিছু কাপড় আর প্রয়োজনীয় টুকটাক কিছু জিনিস ভরে ঘর থেকে বের হয়ে যাই। শরৎ ওই সময় ওর রুমের জানালা দিয়ে আমাকে যেতে দেখে। জানালার সামনেই ওর পড়ার টেবিল ছিল। ও ওখানে বসেই পড়ত। শরৎ দৌড়ে নিচে এসে আমার হাত ধরে টান দিয়ে আমাকে নিয়ে নিচতলায় আমার ঘরে ঢুকে দরজা আটকে দেয়। আমাকে জিজ্ঞেস করে আমি ব্যাগ নিয়ে কোথায় যাচ্ছি। উত্তরে আমি কোনো কথা বলি না। চুপ করে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকি ব্যাগগুলো শক্ত করে ধরে। শরৎ আমার হাত থেকে ব্যাগগুলো কেড়ে নিয়ে ছুড়ে ফেলে আর একনাগাড়ে বলতে থাকে, আমি কেন এত অকৃতজ্ঞ, কীভাবে আমি ওকে কিছু না বলে এভাবে পালিয়ে যাচ্ছি, আমি কেন একবারও ওর কথা ভাবলাম না, ও ওর পড়ার টাকা খরচ করে আমাকে ওষুধ কিনে খাইয়েছে, পরীক্ষা না দিয়ে আমাকে সেবা করে সুস্থ করে তুলেছে, অথচ আমি স্বার্থপরের মতো শুধু নিজের কথা ভেবে কীভাবে পালিয়ে যাচ্ছিলাম ওকে কিছু না বলে। আমি যখন এরপরও নির্বাক হয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিলাম, তখন শরৎ আমার দুই কাঁধে ধরে জোরে ঝাঁকি দিয়ে ওকে উত্তর দিতে বলে। আমি তখন এক নিমিষে কান্নায় ভেঙে পড়ি আর চিৎকার দিয়ে বলি, ‘কারণ আমি তোমাকে প্রচন্ড ভালোবাসি শরৎ, প্রচন্ড ভালোবাসি।’

১৫.

শরৎ আর আমি, আমি আর শরৎ, একটা স্বপ্নময়, মোহময় পৃথিবীতে প্রবেশ করলাম আমরা। সেই পৃথিবীতে আমরা ছাড়া আর কারো অস্তিত্ব নেই। একে অপরের ভালোবাসার প্রশ্রয় দিলাম আমরা। সিদ্ধান্ত নিলাম এখান থেকে চলে যাব। একটা নতুন বাসায় উঠলাম আমরা। স্বামী-স্ত্রীর পরিচয়ে থাকতে শুরু করলাম। শরৎ সবসময় বিয়ের কথা বলত কিন্তু আমি চাইতাম আগে জব্বারকে ডিভোর্স দিতে। ডিভোর্সের কাগজও পাঠাই আমি। কিন্তু জব্বার জানায় সে ডিভোর্স দেবে না আমাকে। শরৎ একদিন কোথা থেকে খবর নিয়ে আসে যে, জামাল জব্বারকে অনেক বকাবকি করেছে আমাকে অসুস্থ অবস্থায় ফেলে রেখে যাওয়ার জন্য আর জব্বারকে নাকি বুঝিয়েছে আমাকে ডিভোর্স দিয়ে দেয়ার জন্য। জামাল সব সময়ই আমাকে সহযোগিতা করত। তবে এই ব্যাপারেও যে সাহায্য করবে সেটা ভাবিনি। হয়তো নিজেকে স্বাধীনতা দিতে পারছিল না বলে আমাকে পরাধীনতার শিকল থেকে মুক্তি দিতে চাইছিল। হয়তো আমাকে স্বাধীন করে দিতে পারলে ওর নিজের একটু অপ্রাপ্তির দুঃখটা কমত, তাই হয়তো সহযোগিতা করছিল আমাকে আড়াল থেকে।

১৬.

শরৎ সব সময়ই আমাকে বলত বিয়ের কাগজের কোনো মূল্য ওর কাছে নেই। আমি সারাজীবন ওকে এভাবে ভালোবাসলেই ওর চলত কিন্তু সামাজিক আর ধর্মীয় দায়বদ্ধতা থেকে আমাদের বিয়ে করতেই হবে। এক বছর পর যখন শরৎ-এর ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হবে, তখন শরৎ আমাকে ওর গ্রামের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে পরিবারের সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবে আর আমাকে বিয়ে করবে। ততদিনে জব্বার ডিভোর্স দিক বা না দিক।

১৭.

তিন মাস পার হয়ে যায়, কিছুটা টাকা-পয়সার অভাবে পড়ে শরৎ, নতুন বাসার জিনিসপত্র, দু’জনের খাওয়া-পরা, আমার ওষুধ, সব মিলিয়ে শরৎ-এর বাবা ওর পড়ালেখার খরচ আর থাকা-খাওয়া বাবদ যা টাকা পাঠাত সব খুব দ্রুত শেষ হয়ে যাচ্ছিল। শরৎ খুব একটা বুঝতে দিত না আমাকে এই ব্যাপারটা। এমনি একদিন খুব সুন্দর ঝলমলে রোদ উঠেছিল, শরৎকাল ছিল, হালকা নীল আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছিল খন্ড-বিখন্ড শুভ্র সাদা মেঘ, শরৎ ওর ক্লাস থেকে ফিরে আমাকে দেখে বলল, টিবি সেরে যাওয়ার পর নাকি সবচেয়ে সুন্দর লাগছিল আমাকে ওইদিন। আমরা দু’জনে বাইরে ঘুরতে বের হই। ফুটপাত ধরে হাঁটাতে হাঁটতে আমরা একটা স্যান্ডেলের দোকানের সামনে এসে থামি। আমি ভেতরে ঢুকে একজোড়া স্যান্ডেল পছন্দ করি। কিন্তু শরৎ বলল, ওই দোকানের কোনো স্যান্ডেল কেনার মতো টাকাই ওর কাছে নেই। আমার একটু মনটা খারাপ হয়। আমি বের হয়ে পাশে একটা শাড়ির দোকানে ঢুকি। একটা বেশ সস্তা শাড়ি কিনতে চাই। কিন্তু তখনো শরৎ বলে, এত টাকা ওর কাছে নেই। আমি জানি না কেন, আমার ভীষণ রাগ হয়। আমি রাগ করে দোকান থেকে বের হয়ে যাই কোনো কথা না বলে। শরৎ খুব বিব্রত হয়ে আমার পিছু পিছু বের হয়ে রাস্তায় আসে। শরৎ আমাকে বলে, পাশের রোডেই নাকি ওর এক ধনী কিন্তু খুব কাছের বন্ধুর বাসা, বন্ধুর কাছে গিয়ে ইনিয়ে-বিনিয়ে চাইলে হয়তো কিছু টাকা ধার পাওয়া যেতে পারে। আমাকে শাড়ির দোকানের ভেতর থাকতে বলে শরৎ ছুটে চলে গেল। আমি আর কোনো দোকানের ভেতর ঢুকি না। দোকানগুলোর সামনে হাঁটাহাঁটি করতে থাকি। অনেকক্ষণ হয়ে যায় শরৎ আর ফেরে না। আজেবাজে লোকজন বাজে মন্তব্য করতে থাকে। হঠাৎ একটা ট্যাক্সি এসে আমার পাশে দাঁড়ায় আর ট্যাক্সির ভেতরে বসা যাত্রীটা আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘কত?’ আমি ভয় পেয়ে শাড়ির দোকানটার ভেতর দৌড় দিয়ে ঢুকে পড়ি। তখনই শরৎ আসে, আমি রেগে গিয়ে নিচুস্বরে বলি, ‘এতক্ষণ লাগে আসতে, পাওয়া গেল কিছু?’ ‘নাহ্ বন্ধু বাসায় নেই, কোনো লাভ হলো না গিয়ে।’ হাঁপাতে হাঁপাতে বলল শরৎ। মানুষের মন বড় অদ্ভুত। কখন যে কী চায়, কখন যে কাকে ভালোবাসে, কখন যে কার ওপর রাগ হয়, কেনইবা রাগ হয়, রেগে গেলে কী সব অযৌক্তিক শিশুতোষ কা- করে, মন সেটা নিজেও বোঝে না। আমি প্রচ- খারাপ আচরণ করি শরৎ-এর সঙ্গে, ও খুব কষ্ট পায়। শরৎ দোকান থেকে বের হয়ে হাঁটা শুরু করে, আমিও দোকান থেকে বের হয়ে উল্টো দিকে হাঁটতে থাকি। কয়েক মিনিট পর আবার ওই ট্যাক্সি আসে আর একই কথা জিজ্ঞেস করে। ‘কত?’ আমি লোকটাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কোথায় যাবেন?’ লোকটা খুশিতে ট্যাক্সি থেকে নেমে এসে আমার ওঠার জন্য অপেক্ষা করে, আমিও সঙ্গে সঙ্গে গাড়িতে উঠে পড়ি। ট্যাক্সি ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট দিতে না দিতেই লোকটা আমাকে জড়িয়ে ধরে। আমার গালে, গলায়, বুকে চুমু খেতে শুরু করে। আমি চিৎকার দিতে থাকি জোরে জোরে। ট্যাক্সি ড্রাইভার ভয়ে গাড়ি থেকে বের হয়ে যায় ইঞ্জিন স্টার্ট রেখেই। কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমার চিৎকারে কোথা থেকে বেশ সাত-আটজন মানুষ জড়ো হয়ে যায় গাড়ির আশপাশে। আমি দ্রুত গাড়ি থেকে বের হয়ে যাই, তারপর জড়ো হওয়া মানুষগুলোকে কাঁদো কাঁদো  গলায় বলতে থাকি, ‘অসভ্য এ লোকটা জোর করে আমাকে...।’

পাবলিক বড়ই ভয়ঙ্কর বস্তু, স্রোততের মতো, জোয়ার-ভাটার সূত্রে চলে। সবাই ওই লোকটাকে মারধর শুরু করে। সত্যি কথা বলতে দোষ তো আমারও ছিল। লোকটা আমাকে উদ্দেশ করে বলতে থাকে, ‘কত টাকা লাগবে আপা আপনার। টাকা নিয়ে আমারে বাঁচান।’ ততক্ষণে শরৎ ওই ট্যাক্সির সামনে ঘটনাস্থলে চলে আসে। আমরা দু’জনেই পরিস্থিতি থেকে ভাগতে ওই ট্যাক্সিতে উঠে বসি। শরৎ আমাকে জিজ্ঞেস করে, ‘কী হয়েছিল জবা, আমি তো কিছুই বুঝলাম না, ওই লোকটা কি কিছু করেছে তোমার সঙ্গে, কে লোকটা, তুমি চেনো?’ আমি কোনো কথা বলি না কিন্তু টের পাই কিছু একটা লাগছে আমার পায়ে। ততক্ষণে গাড়ি চলতে শুরু করেছে। হাত দিয়ে জিনিসটা ধরতেই বুঝি মানিব্যাগ। লোকটার মানি ব্যাগ পড়ে গেছে পাবলিকের টানাহেঁচড়ায়। আমি শরৎকে দেখাই। শরৎ ড্রাইভাকে বলে ট্যাক্সি থামিয়ে লোকটাকে গিয়ে দিয়ে আসতে। ড্রাইভার টাকা ভর্তি মানিব্যাগটা নিয়ে কিছুক্ষণ পর ফিরে আসে। বলে কেউ নেই আগের জায়গায়, লোকটা বোধহয় ভেগে গেছে। ড্রাইভার গাড়িতে উঠে বসে, আমি ড্রাইভারকে বলি, ‘মানিব্যাগে যত টাকা আছে সব আপনার, যেখানে খুশি ঘোরান আমাদের। ড্রাইভার খুশি হয়। কিছুক্ষণ আমরা সবাই চুপচাপ থাকি। গাড়ি ট্রাফিক সিগন্যালে থামে। ড্রাইভার ফুল বিক্রির বাচ্চাদের কিছু টাকা দিয়ে বলে ওদের কাছে যত ফুল আছে সব আমাকে দিয়ে দিতে। খোলা জানালা দিয়ে এক গাদা ফুল এসে আমার কোলে পড়ে। আমি কোল থেকে ফুলের অঞ্জলি নিয়ে শুঁকতে নাকের কাছে আনি। শরৎ নীরবতা ভেঙে বলে, ‘এসব ফুল কবরস্থান থেকে আসে।’ আমি কবরস্থানের কথা শুনে একটুও বিচলিত হই না বরং খুশি হই যে, শরৎ রাগ ভেঙে স্বাভাবিক হয়ে কথা বলেছে। হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হয়। শরৎকালের বৃষ্টি আমার ভীষণ প্রিয়। দেখে মনে হয় আকাশ থেকে হীরার টুকরো পড়ছে। আমার হঠাৎ খুব ভালো লাগে। সব মন খারাপ উড়ে চলে যায় বৃষ্টিভেজা আকাশে। ড্রাইভারকে বলি গাড়ি থামাতে। গাড়ি থেকে নেমে রাস্তা পার হয়ে আইল্যান্ডের ওপর উঠি আমি। বৃষ্টি আরো বাড়ে। ভিজতে ভিজতে দেখি ড্রাইভার আর শরৎও রাস্তার অন্যপাশে থামানো গাড়িটা থেকে নেমে ভিজতে শুরু করেছে। বৃষ্টির জন্য কারো চেহারা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে না। আমি চিৎকার দিয়ে শরৎকে বললাম, আমার কাছে আসার জন্য। বৃষ্টির শব্দে প্রথমে শরৎ বুঝতে পারেনি আমার কথা, পরে আমি হাত দিয়ে ইশারা করাতে ও বুঝতে পেরে দৌড় দেয় আমার দিকে। আমি দেখি একটা খুব দ্রুতগতিতে চলা গাড়ি এসে শরৎকে ধাক্কা দেয় আর শরৎ প্রায় ২০ ফুট দূরে গিয়ে ছিটকে পড়ে।

১৮.

শরৎ আমাকে একা করে দিয়ে চলে যায়। আমি উদ্ভ্রান্তের মতো কিছুদিন একই কাপড়ে খালি পায়ে, একা রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াতে থাকি উদ্দেশ্যহীনভাবে। এক পর্যায়ে ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পড়ি আমি, ভাবি আমিও শরৎ-এর কাছে চলে যাব। বাসার ছাদে উঠি, দেখি ছাদের দরজায় তালা ঝুলছে। নিচে গিয়ে দারোয়ানের কাছ থেকে চাবি নিয়ে আবার ছাদে যাই, ঘোরের মধ্যে আচ্ছন্ন ছিলাম আমি, চোখটা বন্ধ করে একটা বড় প্রশ্বাস নিয়ে শরৎ-এর চেহারাটা মনে করে বুকভরা একগাদা অতৃপ্ত ভালোবাসা নিয়ে লাফ দিই ছাদের ওপর থেকে। কিন্তু কে যেন তখনই আমার হাত ধরে টান দেয়। পেছনে তাকিয়ে দেখি কেউ নেই। বিস্ময় জাগে, সারা ছাদ খুঁজে দেখি কেউ নেই, দুই-তিন মিনিট পর দারোয়ান মজিদ ছাদে আসে, বলে কে জানি এসেছে দেখা করতে আমার সঙ্গে। আমি নিচে যাই, দেখি জামাল একজন উকিল পাঠিয়েছে আমার কাছে, জানতে পারি এক মাস আগে হার্ট অ্যাটাক করে জব্বার মারা গেছে, নিয়মানুযায়ী জব্বারের সব সম্পত্তির মালিক আমি। সেসব কাগজপত্র আর দলিল নিয়েই লোকটা এসেছে। হঠাৎ লক্ষ্য করলাম, টেবিলে কাগজপত্রের পাশে কিছু জবা ফুল, জবা আমার প্রিয় ফুল। লোকটাকে জিজ্ঞেস করলাম, তিনি ফুল নিয়ে এসেছেন কি না? উনি না-সূচক মাথা নাড়লেন। সব কেমন গুলিয়ে যাচ্ছিল আমার। কী হচ্ছে বুঝতে পারছিলাম না, জামালের পাঠানো উকিলের সঙ্গে কাজ সেরে ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুম থেকে উঠলাম প্রায় একদিন পর। সবকিছু পুনরায় মনে করার চেষ্টা করলাম যে কী কী ঘটেছিল তার আগের দিন, কিছুতেই ছাদের সেই হাতের টান আর জবা ফুলের হিসাবটা মেলাতে পারছিলাম না। আমার বিশ্রামের প্রয়োজন ভেবে আবার শুয়ে পড়লাম এক গ্লাস গরম দুধ আর একটা কলা খেয়ে। ঘুম থেকে উঠে জামালকে ফোন দিয়ে জব্বাবের কথা জানলাম আর ওকে ধন্যবাদ দিলাম আমার পাশে থাকার জন্য। তবে শরৎ-এর খরবটা আর ওকে জানালাম না। ফোন রেখে দিলাম। ঘুমের সময়, খাওয়ার সময়, কাজ করার সময় কিসের যেন একটা অস্তিত্ব টের পেতাম আমি। আমি জানি না পৃথিবীতে আর কারো সাথে কি এমন হয়েছে কিনা যা আমার সঙ্গে ঘটেছে।

১৯.

চোখ খোলে জবা, বেলী মন্ত্রমুগ্ধের মতো গল্প শুনছে অপলক নয়নে, মুখটা কিছুটা খোলা বিস্ময়ে, ভ্রু দেখে বোঝা যাচ্ছে ভীষণ চিন্তিত সে একই সঙ্গে। জোরে একটা প্রশ্বাস নেয় জবা, তারপর নিঃশ্বাস ছাড়তে ছাড়তে বলে, ‘এই হলো আমার গল্প।’ বেলী অনেকক্ষণ কোনো কথা বলতে পারে না। পাঁচ-ছয় মিনিট পর জিজ্ঞেস করে, ‘তোমরা কী এই বাসাতেই থাকতে?’ জবা বলে, ‘হ্যাঁ, এই সেই বাসা, যদিও ওই সময় এই বাসাটা আমাদের জন্য ব্যয়বহুল ছিল, তাও ওই মুহূর্তে আমরা এটাতেই উঠেছিলাম, কারণ এই শান্তি কুটিরের মালিক শরৎ-এর এক স্যার, একজন বিখ্যাত ডাক্তার, আর উনি শরৎকে নিজের ছেলের মতো ভালোবাসতেন, খুব প্রিয় ছাত্র ছিল শরৎ উনার, ভাড়া নিতেন না আমাদের কাছ থেকে, এখনও নেন না।’ এই সেই বাসা শোনার পর বেলীর গা ছমছম করে ওঠে। বেলী আবারো ভয়ে ভয়ে খুব নিচুস্বরে জিজ্ঞেস করে, ‘জবা ফুল আর হাত ধরে টান কে দিয়েছিল তোমাকে? হেসে বলল জবা, ‘আমার শরৎ।’

২০.

বেলী দরজা খুলে অপেক্ষা করছে। কিছুক্ষণ পর মজিদ এসে রনির লাগেজগুলো ওপরে দিয়ে গেল। সাধারণত রনি যখন অফিসিয়াল ট্যুর থেকে ফিরে আসে, তখন বেলী সুন্দর কাপড় পরে, বেশ চড়া মেকআপ নিয়ে চুল সেট করে রেডি হয়ে রনির জন্য অপেক্ষা করে। কিন্তু এবার সবকিছুই আছে। তবে তুলনামূলকভাবে কিছুটা কম। রনি ঘরে ঢুকেই বিষয়টা খেয়াল করল। ‘কী ব্যাপার বেলা, কী হয়েছে, শরীর খারাপ না মন?’ ‘নাহ্ আমি ঠিক আছি, তোমার কাজ হয়েছে ঠিকমতো সব?’ কিছুটা যেন অন্যমনস্কভাবে জিজ্ঞেস করল বেলী। ‘হ্যাঁ, সব কাজ হয়েছে ঠিকমতোই।’ ক্লান্ত কণ্ঠে দরজার সামনে রাখা ডিভানটায় বসে জুতা-মোজা খুলতে খুলতে বলল রনি। ‘তুমি গোসল করে নাও, লাঞ্চ করব একসঙ্গে’ বলে বেলী রান্নাঘরের দিকে চলে গেল। রনি খুবই অবাক হলো। অন্য সময় হলে বেলী রনির ব্যাগগুলো আগে খুলত আর আহ্লাদ করে করে জিজ্ঞেস করত তার জন্য এবার কী কী কিনে এনেছে রনি বাইরে থেকে, যে কয়দিন রনি ছিল না, সে কয়দিন কী কী উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেছে সব রসিয়ে রসিয়ে বলত রনিকে। সব মিলিয়ে আধ ঘণ্টা রনির সঙ্গে জমিয়ে গল্প করে তারপর ছাড়ত রনিকে ফ্রেশ হওয়ার জন্য। রনি পরিষ্কার বুঝতে পারল কিছু একটা হয়েছে বেলীর। ভাবল, খেতে খেতে জিজ্ঞেস করবে বেলীকে। লাঞ্চ করার সময় বেশ চুপচাপ থাকল বেলী। রনি নানা প্রশ্ন করা সত্ত্বেও তেমন কিছুই বলল না সে। রাতে ভীষণভাবে চাপ দিতে শুরু করল রনি। জোর করতে লাগল বলার জন্য যে কেন এমন অদ্ভুত আচরণ করছে বেলী। বেশ সময় নিয়ে আস্তে-ধীরে বেলী সব জানাল রনিকে। রনি খুব মন দিয়ে সব শুনল এবং পুরো ব্যাপারটাই হেসে হালকাভাবে উড়িয়ে দিল আর বেলীকে একটু বকল, বোকার মতো এসব আজেবাজে অসম্ভব কাহিনী বিশ্বাস করার জন্য। জবার সঙ্গে খুব একটা বেশি মেলামেশা করতেও নিষেধ করল আর বলল, এই ধরনের বেপরোয়া মেয়েরা নিজের স্বার্থের জন্য যে কোনো কাজ করতে পারে, বেশি ওই বাসায় গেলে দেখা যাবে বেলীকেও কী না কীর মধ্যে ফাঁসিয়ে দিয়েছে। বেলীর রনির প্রতি প্রবল বিশ্বাস আর আস্থা, সে এক নিমিষেই সম্পূর্ণ পাল্টে গেল আর কী বোকা আর সহজ-সরল সে, এটা ভেবে রনির সঙ্গে হাসাহাসি করতে লাগল। সাথে সাথে জবাকেও গালমন্দ করতে লাগল স্বার্থপর, আত্মকেন্দ্রিক, মিথ্যাবাদী, চরিত্রহীন বলে। আর রনির বুদ্ধির প্রশংসা করতে লাগল বিগলিত কণ্ঠে। রাত গভীর হতে থাকল। নিবিড় অন্ধকারে তলিয়ে যেতে লাগল রনি-বেলীর নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের ছন্দ।

২১.

শুক্রবার। সকাল সাড়ে ৯টা। রনি হালকা ঘুমে তন্দ্রাচ্ছন্ন। রনির কপালে বেলী আলতো করে চুমু খেয়ে কানের কাছে মুখ নিয়ে আস্তে আস্তে বলল, ‘আমি মাকে দেখতে যাব, ভাইয়া নিতে আসছে আধা ঘণ্টা পর। মায়ের শরীরটা ভালো না। তুমি কি যাবে আমাদের সঙ্গে?’ রনি চোখ বন্ধ করেই হালকা ঠোঁট নেড়ে বলল, ‘না বেলা, একদিন ছুটি পাই, ঘুমাব প্লিজ, তুমি যাও, রাতে গিয়ে নিয়ে আসব তোমাকে।’ বেলী নাছোড়বান্দা, আবার বলল, ‘তুমি গত ছয় মাসে একবারও যাওনি মায়ের বাসায়, আজকেও যেতে বলতাম না, কিন্তু মায়ের শরীরটা খুবই খারাপ, ভাইয়া ফোনে বলল, চলো না প্লিজ।’ রনি জানে, বেলী একবার কিছু চাইতে শুরু করলে সেটা না পাওয়া পর্যন্ত থামে না। অগত্যা রনি রাজি হয়ে বলল, ‘ঠিক আছে বেলা লাঞ্চে যাব, কিন্তু সন্ধ্যার মধ্যে তোমাকে নিয়ে ফিরে আসব।’ বেলী রনির শর্তে রাজি হয়ে আলমারি থেকে কাপড় বের করে বাথরুমে ঢুকে পড়ল গোসল করতে।

২২.

গোসল করে বাথরুম থেকে বের হলো রনি। সাদা টি-শার্ট আর কালো জিন্সের প্যান্ট পরা। বের হয়েই বিছানা থেকে মোবাইলটা নিয়ে শর্মীকে কল দিল। ‘বেবী আমি আসছি এক ঘণ্টার মধ্যে, বাসায় আছ?’ ওই পাশ থেমে শর্মী উত্তর দিল, ‘হ্যাঁ আছি, এসো, লাঞ্চ করবে তো?’ ‘না বেবী, আজকে লাঞ্চের দাওয়াত আছে, না গেলেই নয়। এক ঘণ্টা আমার বেবীটার সঙ্গে কোয়ালিটি টাইম স্পেন্ড করেই কেটে পড়ব। ‘একটু আহ্লাদ করে বলল রনি। শুক্রবার সকালে রনি পরোটা আর আলু দিয়ে মুরগি ভুনা খেতে পছন্দ করে। বেলী সকালে উঠে গরম গরম খাবার বানিয়ে রেখে গেছে টেবিলে রনির জন্য। রনি হটপট থেকে খাবার প্লেটে বেড়ে রান্নাঘরে গেল কফি বানাতে। হঠাৎ ওপর তলায় একটু আওয়াজ করে কিছু একটা পড়ল, রনি সিলিংয়ের দিকে তাকাল আর হাতে কফি মগ নিয়ে কিছু একটা ভাবতে ভাবতে ডাইনিং রুমে গিয়ে চেয়ার টেনে বসল।

২৩.

একটু আগে জবার হাত থেকে চুল শুকাতে গিয়ে হেয়ার ড্রায়ারটা পড়ে গিয়ে ঠিকমতো কাজ করছে না। একটু চলে আবার বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। জবা হালকা বাসন্তি রঙের সুতির শাড়ি পরেছে, হালকা আকাশি নীল পাড়। ভীষণ স্নিগ্ধ লাগছে আধা ভেজা চুলে ওকে। হঠাৎ কলিংবেল বাজে। জবা দরজা খুলে প্রশ্ন বোধক চাহনি নিয়ে তাকায়। ‘আমি রনি, বেলার হাজব্যান্ড, বিরক্ত করলাম?’ দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে বলে রনি।’ না, না, আসুন না, প্লিজ ভেতরে আসুন।’ বলল জবা। ড্রইংরুমে বসল ওরা দু’জন। জবা জিজ্ঞেস করল, ‘বেলী কী করছে?’ রনি বলল, ‘বেলা ওর মায়ের বাসায় গেছে। আমিও যাচ্ছিলাম, ভাবলাম আপনার সঙ্গে দেখা করে যাই- বেলা এত বলে আপনার কথা।’ জবা খুশি হয়ে একটু লজ্জা পেয়ে বলল, ‘হ্যাঁ এই ক’দিনেই আমরা অনেক ভালো বন্ধু হয়ে গেছি।’ ‘হ্যাঁ হ্যাঁ আপনারা ভালো বন্ধু, শুধু পার্থক্য হলো- আপনি চালাক-চতুর আর আমার বউটা বোকা।’ সঙ্গে সঙ্গে বলল রনি। জবা ঠিক বুঝল না রনির কথাটা। রনি আবার বলল, ‘নইলে আপনার সব গাঁজাখুরি গল্প বিশ্বাস করে উদাস হয়ে থাকত না আমার বোকা বউটা।’ এইবার আর বুঝতে বাকি থাকল না জবার পুরো বিষয়টি। রনির সম্পর্কেও একটা ধারণা হয়ে গেল জবার। লোকটা অত্যন্ত অভদ্র, খারাপ এবং ইতর শ্রেণির। জবা সঙ্গে সঙ্গে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আপনি যেতে পারেন, আমি ব্যস্ত। আপনাকে এন্টারটেইন করার সময় আমার নেই।’ ‘তা তো থাকবেই না, যখন অ্যাপার্টমেন্টের সবাইকে তোমার আসল ব্যবসার কথা বলে দেবো, তখন ঠিকই আমাকে এন্টারটেইন করার সময় তোমার হবে’ বলে সোফা থেকে উঠে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা জবার কোমর ধরে টান দিয়ে নিজের কাছে আনল রনি।’ তোমার মতো মেয়েদের খুব ভালোমতো জানা আছে জবা, তোমার যা লাগে আমি দেব, আমি তোমাকে চাই, বলো কী চাই তোমার? যাও কালই আমি তোমার নামে গাড়ি বুকিং দেব। তোমার জন্য আমার পক্ষ থেকে প্রথম উপহার।’ একনাগাড়ে বলল রনি কামুক কণ্ঠে। জবা ভীষণভাবে ছোটাতে চাইছে নিজেকে কিন্তু পারছে না। ‘দেখুন আপনি ভুল করছেন, কোথাও একটা ভুল বুঝেছেন আপনি বা হয়তো বেলী বোঝাতে ভুল করেছে। প্লিজ ছাড়ুন, এ রকম করবেন না।’ রনি এবার জবার খোলা চুলের নিচে ঘাড়ের দিকে হাত নিয়ে শক্ত করে ধরে চুমু খেতে যায়। জবা চিৎকার করে ওঠে। হঠাৎ রনি উড়ে গিয়ে পাশের সোফার মধ্যে উপুড় হয়ে পড়ে। বোকার মতো মুখ তুলে তাকায় রনি আর বোঝার চেষ্টা করে জবা এত শক্তি কীভাবে পেল। উঠে পড়ে রনি। ‘খুব শক্তি দেখানো হচ্ছে না?’ দাঁত খিঁচিয়ে এগিয়ে আসে রনি। দাঁড়া এবার দেখবি শক্তি কী জিনিস’ বলে জবার শাড়ির আঁচল ধরে টান দিতে যায়। এবার দেয়ালে গিয়ে ছিটকে পড়ে রনি। কপাল ফেটে রক্ত বের হতে থাকে। আবার রনি উড়ে এসে জবার পায়ের কাছে পড়ে। সোফার হাতলের কোনায় লেগে মাথা দিয়ে গল গল করে রক্ত পড়তে থাকে। কাঁদতে কাঁদতে জবা বলে, ‘ছেড়ে দাও শরৎ, ছেড়ে দাও, আর মেরো না, প্লিজ শরৎ, ছেড়ে দাও, ও মরে যাবে, প্লিজ শরৎ।’ রনি উড়ে গিয়ে বারান্দা থেকে নিচে পড়ে যায়। ‘শরৎ কী করলে এটা তুমি, কেন করলে শরৎ’ বলে চিৎকার দিয়ে কিছু একটা অদৃশ্য বস্তু ধরে ঝাঁকায় জবা। কিছুক্ষণ পর কিছু একটা জড়িয়ে ধরে জবা, একটা অদৃশ্য অবয়ব। আর কান্না জড়ানো কণ্ঠে বলতে থাকে, ‘আমিও অনেক ভালোবাসি, অনেক।’

২৪.

লোকজন ঘিরে রয়েছে রনির নিথর দেহ। খোলা চোখ দুটো কীভাবে যেন বন্ধ হয়ে গেল বা কেউ বন্ধ করে দিল।

লেখক কুসুম শিকদার; ছবি: শাহরিয়ার কবির হিমেল

Comments

The Daily Star  | English
Anti-Discrimination Students Movement

Students to launch political party by next February

Anti-Discrimination Student Movement and Jatiya Nagorik Committee will jointly lead the process

9h ago