এক বাংলাদেশি যুবকের সিরিয়া যাওয়া ও ফিরে আসার গল্প

ধর্মীয় দায়িত্ব মনে করে সুন্নি মুসলমানদের হয়ে সিরিয়ায় যুদ্ধ করতে গিয়েছিলেন ডেসকোর প্রকৌশলী গাজী কামরুস সালাম সোহান। পাঁচ মাস সেখানে অবস্থানকালে আইএস এর কাছে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন, রাক্কা শহরে বিদ্যুৎ সংযোগ পুনঃস্থাপনে কাজ করেছেন। কিন্তু প্রতিদ্বন্দ্বী মুসলিমদের হত্যা করার দৃশ্য দেখে মোহভঙ্গ ঘটে সোহানের। আইএস এর কর্মকাণ্ডে ক্ষুব্ধ হয়ে তিনি দেশে ফিরে আসেন। দেশে ফিরেই গোয়েন্দা সংস্থার কাছে ধরা পড়েন তিনি। দেড় বছর একটি নির্জন কক্ষে থাকার পর গত নভেম্বরে তাকে আটক দেখায় র‌্যাব। বর্তমানে কারাগারে থাকা সোহান গোয়েন্দাদের জানিয়েছেন সিরিয়ার অভিজ্ঞতা, কী করে সেখানে গেলেন, কারা নিয়ে গেল, কারা অর্থ দিল, কীভাবে ফিরে এলেন।

মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজ থেকে ২০০৭ সালে এইচএসসি পাস করে গাজীপুরের ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি (আইইউটি) থেকে ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিকসে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেন সোহান। ২৭ বছর বয়সী এই প্রকৌশলী ২০১২ সালে এনার্জিপ্যাক ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানিতে ১০ মাস চাকরি করেন, পরে তিনি ডেসকোতে যোগ দেন।

২০১৬ সালের ১৭ নভেম্বর এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে র‍্যাব জানায় জঙ্গিবাদে যুক্ত থাকার অভিযোগে ১৬ নভেম্বর রাতে আদাবরের মোহাম্মদিয়া ক্যাফে থেকে সোহানকে আটক করা হয়।

সোহান বলেছেন, আইএস এর আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি ২০১৪ সালের ৯ ডিসেম্বর সিরিয়ার উদ্দেশ্য ঢাকা ত্যাগ করেন। আর ফিরে আসেন তার পরের বছর ১৬ মে। ২৬ মে তাকে আটক করা হয়। এরপর দেড় বছর ছিলেন আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে।

এক্স ক্যাডেট গ্রুপে জঙ্গিবাদের দীক্ষা

২০১৪ সালের জানুয়ারি মাসে ফেসবুকে “EX Cadets Islamic Learning Forum”এ যুক্ত হন সোহান। এই গ্রুপের এডমিন ছিলেন জাপান প্রবাসী সাইফুল্লাহ ওজাকি, যিনি সিলেট ক্যাডেট কলেজ থেকে ২০০১ সালে এইচএসসি পাশ করেন। জাপান থেকে ইউরোপ হয়ে সিরিয়া পাড়ি দিয়েছেন সাইফুল্লাহ ওজাকি। এই গ্রুপটিতে সাবেক ক্যাডেটরা ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ে লেখালেখি করতেন। ওজাকি লেখালেখি কম করতেন বরং আন্তর্জাতিক মিডিয়ার বিভিন্ন খবর ও ভিডিও এই গ্রুপে শেয়ার করতেন। এই গ্রুপের আরেকজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন আমিনুল ইসলাম বেগ। যিনি বরিশাল ক্যাডেট কলেজের ১৯৯৬-৯৭ ব্যাচের। ২৪ মে ২০১৫ রাতে রাজধানীর উত্তরার ১৪ নম্বর সেক্টরের ১১ নম্বর সড়কের একটি বাসা থেকে আমিনুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করা হয়। পুলিশের কাছে স্বীকার করেছেন তিনি সিরিয়ায় যোদ্ধা পাঠানোর কাজ করতেন।

২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আমিন বেগের সাথে ফেসবুক গ্রুপের মাধ্যমে যোগাযোগ করে সরাসরি সাক্ষাৎ করেন সোহান। ধানমন্ডি ৭ নম্বরের মসজিদে বসে সিরিয়ার যুদ্ধ নিয়ে তাদের আলাপ হয়। সোহান জানায়, ২০১১ থেকেই ইন্টারনেটের মাধ্যমে তিনি সিরিয়ার খবর রাখেন। সুন্নি মুসলিমদের ওপর সিরিয়ার সরকার যে অত্যাচার চালাচ্ছে তা তাকে ব্যথিত করে। সোহান বলেন, “আমি তাদের জন্য কিছু করতে চাই।“ আমিন বেগ জানায়, সিরিয়ার মানুষের জন্য কিছু করার একটাই পথ সেটা হল যুদ্ধ। “আপনি যদি যুদ্ধে যেতে চান তাহলে আমি সিরিয়া পাঠাতে পারি।” সোহানকে বললেন আমিন বেগ।

ওজাকির মাধ্যমে সিরিয়া পৌঁছানো

সোহান আমিন বেগের কাছে জানতে চান সিরিয়া কীভাবে যাবেন। বেগ জানান, জাপান প্রবাসী সাইফুল্লাহ ওজাকির সাথে সিরিয়ার যোগাযোগ আছে। আমিন বেগ তাকে ওজাকির জাপানের মোবাইল নম্বর দিয়ে বলেন রাতে ওজাকি আপনার সাথে যোগাযোগ করবেন। এরইমধ্যে ওজাকি সোহান সম্পর্কে বেগের কাছ থেকে অবহিত হন। ওজাকি সোহানকে সিরিয়ায় যুদ্ধে যেতে উৎসাহ দিতে থাকেন।

সোহান জানান, ২০১৪ সালের মাঝামাঝি সময়ে ওজাকি একবার বাংলাদেশে এসেছিলেন। উত্তরা ৭ সম্বর পার্কের পাশে একটি মসজিদে ওজাকির সাথে সোহানের আলোচনা হয়। ওজাকি জানান চার-পাঁচ দিনের জন্য তিনি দেশে এসেছেন। অক্টোবর মাসে ওজাকি সোহানকে জাপানের ভিসা নেওয়ার ব্যাপারে সহায়তা করেন। তার পরামর্শে মালয়েশিয়া ও জাপান ঘুরে আসেন সোহান। ওজাকি সোহানকে জানান তিনি ১১ ডিসেম্বরে তুরস্কে একটা সম্মেলনে এ যোগ দিবেন। সোহান যেন ৯ ডিসেম্বর টিকেট কেটে যাত্রা করেন। ওজাকি তাকে সিরিয়া পৌঁছে দিবেন বলে কথা দেন।

এক্স ক্যাডেটদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ

এরইমধ্যে ওজাকি চার জন ব্যক্তির কাছ থেকে কিছু টাকা সংগ্রহের জন্য সোহানকে অনুরোধ করেন। তুরস্ক পৌঁছে যেন টাকাগুলো তার হাতে দেয়া হয়। চার জন হলেন, আমিন বেগ, শামিম, সাঈদ ও জাকি। শামিম পাবনা ক্যাডেটের ছাত্র ছিলেন। শামিম ২২ হাজার টাকা দেন। জানতে চাইলে শামিম সোহানকে জানায় সিরিয়ায় শিশুদের সাহায্য করার জন্য ওজাকি টাকা দিতে বলেছেন। সাঈদ ছিলেন বরিশাল ক্যাডেট কলেজর, তিনি দেন ১০ হাজার টাকা, আর জাকি দেন পাঁচ হাজার টাকা। আমিন বেগ ৯ ডিসেম্বর রাতে তার গাড়িতে করে সোহানকে এয়ারপোর্ট পৌঁছে দেন। তিনি সোহানের হাতে দেড় লাখ টাকা দেন তুরস্ক নিয়ে যাবার জন্য।

তুরস্ক হয়ে সিরিয়া

সোহান ৯ ডিসেম্বর তুরস্ক পৌঁছান। রাতে এয়ারপোর্টের পাশে একটা হোটেলে থাকেন। এয়ারপোর্ট থেকে একটা সিম কিনে ইন্টারনেট চালু করেন। পরদিন সকালে ওজাকি এয়ারপোর্টে নেমে স্কাইপে কল দেয়। সোহান তার কথামত এয়ারপোর্টে গেলে তাকে নিয়ে ইস্তাম্বুল থেকে হাতাই এয়ারপোর্টে যান। সেখান ওজাকি একজনকে ফোন দিলে তিনি গাড়ি নিয়ে এসে দুই জনকে নিয়ে তার বাড়িতে যান। তার নাম আবুবারা। সিরিয়ার নাগরিক, বড় হয়েছেন অস্ট্রেলিয়ায়, মূলত আইএস এর হয়ে দোভাষীর কাজ করেন তিনি। রাতে তার বাড়িতেই থাকেন ওজাকি আর সোহান। ঢাকা থেকে নিয়ে যাওয়া দুই লাখ টাকা ওজাকির হাতে তুলে দেন সোহান। পরদিন বিকেলে আবুবারা সোহানকে ছয়টা তার্কিস ফোন নাম্বার দেন। হাতাই থেকে গাজিয়ানটেপ যাওয়ার টিকেটও দেন। গাজিয়ানটেপ সিরিয়ার সীমান্তের কাছের একটি শহর। আবুবারা সোহানকে বলে দেন যে গাজিয়ানটেপ পৌঁছানোর পর ওই ছয়টা নম্বরের যে কোন একটাতে কাউকে পেলেই সে তাকে সিরিয়া নিয়ে যাবে। এখানে ওজাকি সোহানের নাম পাল্টে রাখেন আবু আব্দুল্লাহ। বিকেল সাড়ে ৩টায় আবুবারা আর ওজাকি সোহানকে বিদায় জানিয়ে বাসে উঠিয়ে দেয়। চার ঘণ্টা পর গাজিয়ানটেপ স্ট্যান্ডে নেমে ছয়টা নম্বরের প্রথমটায় ফোন দেন তিনি, কোন সাড়া মেলে না। দ্বিতীয় নম্বরটায় ফোন দিলে একজন ভাঙ্গা ইংরেজিতে কথা বলেন। “আমি আবু আব্দুল্লাহ পরিচয় দিলে সে আমাকে কোন একটি হোটেলে অবস্থান নিতে বলে।” জানান সোহান।

পরদিন সকাল ১১ টায় ওই ব্যক্তি সোহানকে ফোন দেয় এবং হোটেলের ঠিকানা নিয়ে ৩০ মিনিটের মধ্যে গাড়ি নিয়ে চলে আসে। সে ছিল একজন তার্কিস। সে তার গাড়িতে করে যাত্রা করে। এক পর্যায়ে হাইওয়েতে উঠে রাস্তার পাশে একটা ট্যাক্সিতে তুলে দেয় সোহানকে। “আমি বসেই দেখি পেছনের সিটে একটা পরিবার। জানতে চাইলে তারা বলল তুর্কিস্তান থেকে এসেছে। স্বামী স্ত্রী ও চার বাচ্চা।” হাইওয়ে ধরে ৫০-৬০ মিনিট চলার পর ট্যাক্সি থামে। সেখানে তিন-চারটা গাড়ি ও ১৫-২০ জন বিদেশি দাঁড়িয়ে ছিলেন। কথা বলে জানা গেল তারা মরক্কো, জর্ডান, মিশর, সৌদি আরব, লিবিয়া, ইরান থেকে এসেছেন। সোহান জানান, কিছুক্ষণ পর তাদের ১৫-১৬ জনকে একটা মাইক্রোবাসে তোলা হয়। মাইক্রোবাসে কোন সিট ছিল না। হাইওয়ে ছেড়ে মাটির রাস্তা দিয়ে লুকিয়ে গাড়ি চলে পাঁচ মিনিট। এরপর সবাই নেমে গাড়ির সামনে যিনি বসে ছিলেন তিনি তাকে অনুসরণ করে জোরে হাঁটতে বা দৌড়াতে বলেন। “আমরা ১৫ মিনিট জোরে হেটে, দৌড়ে মাটির ভাঙ্গা রাস্তা পার হয়ে বর্ডার ক্রস করি।” সিরিয়ায় ঢুকেই দেখা যায় চার-পাঁচটা হাইলাস্ক পিকআপ। ১০-১২ জন অস্ত্র হাতে সেনা পোশাকে দাঁড়ানো, তবে সবার পোশাক এক নয়। সোহানসহ ২০ জনে দাঁড়ালে তারা বিভিন্ন গ্রুপের নাম ধরে ডাকতে থাকে। সেখানে মোট চারটা গ্রুপ অর্থাৎ জাবহাত আল নুসরা, আইএস, ইসলামিক ফ্রন্ট ও আহরার-আল শাম এর লোক ছিল। “তাদের একজন জানতে চাইল আমি কোন গ্রুপের। আমি বললাম গ্রুপ জানা নেই। তবে ওজাকি আমার নাম দিয়েছেন আবু আব্দুল্লাহ। আমি সেই লোকের হাতে একটা কাগজ দেখালাম। লোকটি কাগজ চেক করে আমাকে একটি জিপে তুলে দেয়।”

“আমাদের চার-পাঁচ জনকে একটা গ্রামের ভেতর নেওয়া হয়। দোতলা একটা বাসায় রাখা হয়। সেখানে বিভিন্ন দেশ থেকে আসা আরও ৯-১০জন আগে থেকেই ছিলো। বাসায় ঢুকার সাথে সাথেই আমাদের লাগেজ ও শরীর চেক করা হয়। আমাদের সকলের পাসপোর্ট, ক্যামেরা, মোবাইল, ট্যাবসহ সকল ইলেক্ট্রনিক্স তারা রেখে দেয়। জানতে চাইলে বলে অনেকেই পাসপোর্ট নিয়ে পরবর্তীতে দেশে ফেরত চলে গেছে। আর কেউ কেউ ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস দিয়ে গোয়েন্দার কাজ করে। তাই এগুলো ব্যবহার নিষিদ্ধ।”

অবশেষে রাক্কা শহরে

পরদিন সকাল ৯টায় একটা মাইক্রোবাসে সোহানসহ আট-নয় জনকে তুলে দেয়া হয়। সোহান নিজেকে রাক্কা শহরে আবিষ্কার করেন। পথের মাঝে তাদের ডিটেইল নোট নেয় একজন। রাক্কায় যাওয়ার পর নিজ নিজ পেশা অনুযায়ী তাদের বণ্টন করা হয়। সোহানকে ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রধানের অধীনে ১০তলা একটি ভবনে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ওই বিভাগীয় প্রধান মিশরের লোক। তার ছদ্ম নাম আবু ইয়াজিদ। তিনি জানান, পরিচয় গোপন রাখা আর ছদ্ম নাম ব্যবহারের আদেশ আছে। ইয়াজিদ সোহাগের ডিটেইল নেয় এবং জানতে চায় কোন গ্রুপের। “আমি বলি ওজাকি সব ঠিক করে রেখেছে, আমি জানি না।” ইয়জিদ রাক্কা শহরের বর্ণনা দেন। জানান বাসার আল আসাদের বাহিনী এখানকার পাওয়ার স্টেশন গুলোতে বিমান হামলা করে ধ্বংস করে দিয়েছে। তাই পাওয়ার সাপ্লাই খারাপ। সারিদিন তিন-চার ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকে। সে জানায় পাওয়ার স্টেশনগুলো পুনর্নির্মাণের কাজ করতে হবে। এরপর সে আমাকে একটা মেসে পাঠিয়ে দিয়ে জানায় প্রতি সপ্তাহের খাদ্য সরবরাহ বাজেট হিসেবে বাসায় পৌঁছে যাবে। রান্না করে খেতে হবে। সে আরও বলে দেয় বাসার বাইরে বেশি ঘোরাফেরা নিষেধ।

এই বাসায় একমাসে দুবার সোহানকে প্রকৌশল বিভাগ সাক্ষাৎকার নেয়। প্রথমবার সাক্ষাৎকার নেন একজন সিরিয়ান বয়স্ক লোক। তিনি একজন ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার। তিনি শহরে পাওয়ার সাপ্লাইয়ের কাজ করেন। দ্বিতীয়বার সাক্ষাৎকার নেন একজন মিশরিয়, তিনি ইলেক্ট্রনিক্স নিয়ে কাজ করেন। এজন্য তিনি বেশিক্ষণ সাক্ষাৎকার নেননি।

রাক্কা শহরে এই এক মাসে আবু ইয়াজিদের অনুমতি নিয়ে পাশের মার্কেট থেকে তাদেরই দোকান থেকে একটা মোবাইল কেনেন। রাক্কা শহরে কোন মোবাইল নেটওয়ার্ক নেই তবে ওয়াইফাই ইন্টারনেট ব্যবহার করা যায় এমন কিছু দোকান আছে। সেখানে সোহান একটি দোকানে ওজাকির সাথে স্কাইপে যোগাযোগ করে রাক্কা শহরের অবস্থা জানান।

এক মাস পর আবু ইয়াজিদ সোহানকে তার অফিসে ডাকেন। সোহান যে মেসে থাকতেন সেখানে আরও ছয়-সাত জন ইঞ্জিনিয়ার ছিলো। দুই জন পাকিস্তানি, দুই জন সৌদি, এক জন মিশর, এক জন তিউনিশিয়ার। আবু ইয়াজিদ জানায় কাজ শুরুর আগে ইসলামের ওপর জ্ঞান বাড়ানোর একটা প্রশিক্ষণ নিতে হবে। এজন্য রাক্কা থেকে আরও এক সপ্তাহ পর মানবিজ শহরে পাঠানো হবে।

জানুয়ারি মাসেই রাক্কাতে বসে সোহান তার বন্ধু নজিবুল্লাহ আনসারির সাথেও যোগাযোগ করেন। আনসারিও রাজশাহি ক্যাডেট কলেজে পড়েছেন। মেরিন ইঞ্জিনিয়ার আনসারির সাথে আমিন বেগ ও ওজাকিরও যোগাযোগ ছিল। আনসারি জানান তিনি জাপানে ঘুরতে গেছেন ওজাকির ওখানে, সেখান থেকে তুরস্ক যাবেন। জানুয়ারির শেষ দিকে তিনি জানান তুরস্ক পৌঁছে গেছেন এখন সিরিয়া যেতে আগ্রহী। ওজাকি তাকে সিরিয়া পাঠাবে। এরপর দেড় মাস চেষ্টা করেও তার কোন হদিস পাওয়া যায়নি। ওজাকির সাথেও তার কোন যোগাযোগ হয়নি।

প্রশিক্ষণের জন্য মানবিজ শহরে

জানুয়ারির শেষে সোহানসহ আরও ছয়-সাত জনকে মানবিজ শহরে পাঠানো হয়। রাক্কা থেকে তিন ঘণ্টার পথ। যে বাসায় তাদের নেওয়া হয় সেখানে আগে থেকেই ৬০-৭০ জন তুর্কিস্থানি অবস্থান করছিলেন। তারা জানায় ২০ দিন ধরে ইসলামী জ্ঞান বাড়ানোর প্রশিক্ষণ শুরু করেছে। তাদের কোর্স শেষ হতে আরও ১৫ দিন লাগবে। এরপর সোহানদের কোর্স শুরু হবে। এরমধ্যে বাসার বাইরে যাওয়া নিষেধ। ১৫ দিন পর তারা চলে গেলে সোহানদের সাত জনের ইনজার্চ সিরিয়ান আবু মারিয়া বলল সে আরবি পারে। সোহান ও দুই পাকিস্তানি ছাড়া সবাই আরবি পারতো। “আমরা তিন জন রয়ে গেলাম। বাকিদের কোর্স শুরু হয়ে যায়। আমাদের কিছুদিন অপেক্ষা করতে বলা হয়। কারণ আমাদের জন্য দোভাষী দরকার। আরও ১২-১৩ দিন অপেক্ষা করলাম। আবু মারিয়া জানালো মানবিজ শহরে কোন ইংরেজি অনুবাদক নেই। তবে রাক্কা শহরে একজন আছে। এজন্য আমাদের রাক্কা শহরে ১০ দিন পর ফেরত পাঠানো হয়।”

আবার রাক্কায়

রাক্কায় সোহান আবু ইয়াজিদের সাথে আবার দেখা করেন। তিনি জানান তিন দিনের মধ্যে প্রশিক্ষণ শুরু হবে। মার্চের শুরুতে কোর্স শুরু হয়, শিক্ষক ছিলেন তিউনিসিয়ার এক ব্যক্তি। নাম আবু হাজর। এক মাস ক্লাস হয় একটা বাসার ভেতর। সারিদিনে দুই-তিন ঘণ্টা ক্লাস হতো। বাসার বাইরে যাওয়া নিষেধ। শুধু শুক্রবারে বাইরে যাওয়া যেত। কোর্সের বিষয়বস্তু ছিল তাওহিদ, শিরক, কুফর, ঈমান, ঈমান নষ্ট হওয়ার ১০ কারণ, লা ইলাহা ইল্লালাহর ৭টি শর্ত, এবং সিরিয়া যুদ্ধরত সকল গ্রুপের অবস্থান। এপ্রিলে কোর্স শেষ হয়। “ক্লাস চলাকালে আমি শিক্ষককে প্রশ্ন করি সিরিয়াতে যুদ্ধরত অন্য গ্রুপগুলোর সাথে আইএস এর সম্পর্ক কী? অন্য গ্রুপগুলতেও মুসলিম যোদ্ধা। তারাও তো নির্যাতিত মুসলিমদের সাথে যুদ্ধ করছে।”

শিক্ষক জানায় আইএস এর মতাদর্শের সাথে অন্য গ্রুপগুলোর মিল নেই। আইএস চায় যতটুকু এলাকা দখলে আছে সেগুলো প্রতিরক্ষা করা এবং আরও এলাকা দখল করে আন্তর্জাতিক এলাকা বাড়ানো। এজন্য মুসলিম হত্যা করাও পরোয়া করে না। সোহান জানায় “এ কথা শোনার পর আমি ধাক্কা খাই। এসেছি সুন্নি নির্যাতিত মুসলিমের হয়ে যুদ্ধ করতে। অথচ আইএস নিজেও মুসলিম হত্যা করে।”

এরই মধ্যে একদিন সকালে রাক্কা শহরে বিমান হামলা হয়। ঘণ্টাখানেক পর খবর পাওয়া যায় একটা প্লেন থেকে জর্ডানের পাইলট গুলি লেগে প্যারাসুট নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে আইএস এর হাতে ধরা পড়েছে। রাক্কা শহরে রাস্তায় পার্কের কাছে বড় বড় প্রজেক্টর আছে। সেখানে আইএসএর কর্মকাণ্ডের নানা ভিডিও দেখানো হয়। তিন দিন পর দেখা গেল জর্ডানের সেই পাইলটকে পুড়িয়ে হত্যা করা হলো। “আমি ভেঙ্গে পড়ি। আমার মোহভঙ্গ ঘটে। আইএসের কাজ যে প্রকৃত ইসলামের কাজ নয় সেটা বুঝতে পেরে পরিবাবের কথা বেশি মনে পড়ে। এরই মধ্যে বিভিন্ন লোকজনের সাথে কথা হয়, তাদের দুর্দশাও আমাকে আহত করে।”

তিন বাঙালির সাথে সাক্ষাৎ

সিরিয়াতে তিন জন বাঙালির সাথে পরিচয় হয়। আবু ইসমাইল, সে ফিনল্যান্ড থেকে এসে রাক্কায় হাসপাতালে ফিজিওথেরাপির কাজ করে। আবু হাফসা সে আইটি ইঞ্জিনিয়ার, অস্ট্রেলিয়া থেকে গেছে। আইটি বিভাগে কাজ করে। আবু বিলাল সেও অস্ট্রেলিয়া থেকে গেছে। সে সরাসরি যুদ্ধ করে।

স্কাইপে বিয়ে, দেশে ফেরার সিদ্ধান্ত

এপ্রিলে মির্জাপুর ক্যাডেটের বন্ধু সিফাতের ( মুস্তাফিজুর রহমান সিফাত, র‌্যাব-৪ গত বছর ৯ আগস্ট কর্তৃক আটক, ওয়েবপেজ আত-তামকীনের প্রধান এডমিন) সাথে যোগাযোগ হয়। তার স্ত্রীর সাথেও কথা হয়। তাদের মধ্যে তালাক হয়ে গেলে ২৬ এপ্রিল স্কাইপে সিফাতের আগের স্ত্রীকে সোহান বিয়ে করেন।

এরপর আবু ইয়াজিদ জানায় শারীরিক প্রশিক্ষণ শুরু হবে। “কিন্তু আমি দেশে ফেরার দিনগুণি।” সোহান জানান।

৮ মে মাসের সোহান রাক্কা শহরে বর্ডার এডমিন অফিসে গিয়ে দুই দিনের জন্য পাসপোর্ট চান। তারা দিতে অস্বীকৃতি জানায়। অন্যরা জমিজমার হিসাব, ব্যাংক থেকে টাকা তোলার নানা কারণ দেখিয়ে অল্প সময়ের জন্য পাসপোর্ট তুলে আবার ফেরতও দেয়। সোহানও ১১ মে জমির কাজের অজুহাতে তিন ঘণ্টার জন্য ফটোকপি করার নামে আবার পাসপোর্ট চান। ১২ মে তারা তাকে যেতে বলে। তখন পাসপোর্ট দিয়ে, একটা ফরমে সই নেয়, ওই ফরমে তার সম্পর্কে ডিটেইল লেখা ছিল।

আবার সিরিয়া বর্ডার পারি দেয়া, ধরা পরা

পাসপোর্ট পেয়েই সোহান একটা মার্কেটে গিয়ে জিন্স, টি শাট ও ছোট ব্যাগ কিনেন। ট্যাক্সি নিয়ে রাক্কা শহরের শেষ প্রান্তে চলে যান। স্থানীয় সিরিয়ানরা তুরস্কের সীমান্ত দিয়ে খাবারসহ নানকিছু সাপ্লাই করতো। তিনি ট্যাক্সি থেকে নেমে ট্রাকে উঠেন, যেটি টিস্যু পেপার আনার কাজ করতো। “আমি যেহেতু ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে ছিলাম তাই আমাকে আইডি কার্ড দিয়েছিল।” ওই ট্রাকটি রাক্কা থেকে তালআবিয়াদ নামের শহরে চার ঘণ্টা পর রাত সাড়ে ৯টায় পৌঁছায়। পথে তিন বার আইএসের লোকারা চেক করে। সেখানে পৌঁছে দেখা যায় দূরে তুরস্কের পতাকা উড়ছে। সেটি তুরস্কেরই একটি শহর। তিনি একটি খাবারের দোকানে সাড়ে ১২টা পর্যন্ত অপেক্ষা করেন।

“গভীর রাতে বের হই। শহর ফাঁকা। হঠাৎ একটি টহল দল আমার আইডি চেক করে। আইএসের বর্ডার গার্ড জানতে চায় এতরাতে বাইরে কেন, আমি বলি রাস্তা হারিয়ে ফেলেছিলাম, খুঁজে পেয়ে এখন বাসায় যাচ্ছি। এরপর আমি রাস্তা ছেড়ে পাশের ঝোপঝাড় দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে সীমান্তের দিকে এগুতে থাকি। ওপাশে তখন তুরস্কের সৈন্যরা সশস্ত্র পাহারায়। তারকাটার তিন স্তর। দুইটা সমান্তরাল একটা আড়াআড়ি। ঘণ্টা দুয়েক খুঁজে একটা সুবিধাজনক জায়গা বের করি। যেটা ছিল একটা চেকপোস্টের পরিত্যক্ত ঘর। তা ছিল দুই স্তর তারকাটার মাঝে। আমি লাফ দিয়ে ওই ঘরে ওঠে যাই। আরেক পাশে বের হলেই দুটি স্তর পার হয়ে যাই। কিন্তু তৃতীয় স্তর পার হওয়ার সময় পেঁচিয়ে যাই।” তিনজন তুর্কি সেনা দেখে ফেলে। তারা ধরে তাদের অফিসে নিয়ে যায়। সেখানে একজন মেজর ইংরেজিতে কথা বলে। পরদিন সকালে তারা তাকে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে। পুলিশ তদন্ত করে জেলে পাঠিয়ে দেয়। তিনদিন জেলে থাকার পর সোহানকে আজীবন তুরস্কে নিষিদ্ধ করে কাগজে সই নেয়। তিন দিন পর ১৫ মে পুলিশ তাকে টার্কিশ এয়ারলাইন্সের ফ্লাইটে তুলে দেয়। বিমানবন্দরে তাকে মার্ক করে রাখে। ১৬ মে ভোর ৪টায় ঢাকায় পৌঁছান সোহান। “আমার পাসপোর্টে ডিপোর্টেড সিল না দেয়ায় ঢাকা এয়ারপোর্টে কোন ঝামেলায় পড়ি নাই। সরাসরি বাসায় চলে যাই।”

ঢাকায় এসে আটক, দেড় বছর গুম

২০১৫ সালের ২৬ মে মে আগের কর্মস্থল ডেসকোতে যোগ দেয়ার জন্য আবেদনপত্র নিয়ে যান সোহান। “সেদিন সন্ধ্যায় অফিস থেকে নামার পর সাদা পোশাকধারী দুই জন পেছন থেকে আমাকে নাম ধরে ডাকে, হ্যান্ড শেক করতে করতেই একটা গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে মাথায় পিস্তল ঠেকায়, চোখ বেধে ফেলে। হাতকড়া পরায়। এভাবে তাদের কাছেই দেড় বছর একটা রুমে আটকা থাকি। বিভিন্ন সময় চোখ বেঁধে আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। দেড় বছর পর আমাকে বের করে র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে নিয়ে গিয়ে সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত করে আরও চার জনের সাথে।”

Click here to read the English version of this news

Comments

The Daily Star  | English

4 years could be maximum one can go before election: Yunus tells Al Jazeera

Says govt's intention is to hold election as early as possible

34m ago