মার খাওয়া, মরে যাওয়া, ঝলসানো পাখিদের প্রতি…

রাজধানীর উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ক্যাম্পাসে বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার পর ধ্বংসস্তূপের মধ্য পড়ে আছে এক শিক্ষার্থীর জুতা। ছবি: প্রথম আলো

প্রিয় বাচ্চারা,

তোমাদের সামনে নতমুখে দাঁড়ালাম; ক্ষমা চেয়ে। এই সস্তা মৃত্যুর দেশে তোমাদের ন্যূনতম নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারার লজ্জা আর তোমাদের শৈশব থেকে সমস্ত সবুজ ছিনতাইয়ের অপরাধ কাঁধে নিয়ে।

আমরা বড়রা তোমাদের মাথার ওপর দিয়ে উড়ে যাওয়া যুদ্ধবিমানকে জীবনের অংশ বলেই ধরে নিয়েছি। অথচ জানি, যুদ্ধবাণিজ্যের এই প্রবল কাঠামোগত বৈষম্যের দুনিয়ায় যতদিন অস্ত্রের কারখানা থাকবে; যুদ্ধবিমান আকাশে উড়বে; ততদিন পৃথিবীর কোনো শিশুই নিরাপদ নয়।

এই পোড়া দেশে আমরা নিজেদের 'সম্পূর্ণতার জন্য' তোমাদের পৃথিবীতে নিয়ে এসে ছেড়ে দিই এক অনিশ্চিত জীবনের রাস্তায়। কিন্তু তোমাদের রক্ষা করতে পারি না। তোমরাই বরং বড়দের তাবৎ অক্ষমতা আর না পারার গ্লানি ঢেকে দিয়ে বার বার আমাদের ঢাল হয়ে দাঁড়িয়ে যাও।

আমরা তোমাদের কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছি খেলার মাঠ। সজল পুকুর, বহমান নদী দখল করে সেখানে গড়ে তুলেছি আকাশচুম্বী বহুতল। তোমাদের জীবন আটকে দিয়েছি বর্গফুটে মাপা ফ্ল্যাটের চৌহদ্দিতে। নিজেরাই সব সামাজিক যূথবদ্ধতা ছিন্ন করে তোমাদের একাকীত্ব আর অবসাদের জন্য দায়ী করেছি তোমাদেরকেই।

আমরা তোমাদের ঠেলে দিয়েছি তীব্র প্রতিযোগিতার অসাম্য-গলদে ঠাসা এক শিক্ষাক্ষেত্রে। বছরের পর বছর একের পর এক নিরীক্ষার গিনিপিগ বানিয়েছি তোমাদের। পাঠ্যবইয়ের পাতায় পাতায় ভরে দিয়েছি পক্ষপাতের রাজনৈতিক ইতিহাসের বিষবাষ্প।

'দিন বদলের' হাওয়ায় বাম্পার ফলনের মতো বাম্পার 'এ প্লাসের' সেই ধারা গোত্তা খেল এবার এসএসসির ফলাফলে। দেখা গেল ছয় লাখের বেশি শিক্ষার্থী ফেল।

গণমাধ্যমে আসা খবর অনুসারে, গত ১০ জুলাই এই বিপর্যয়কর ফলাফল প্রকাশের প্রথম চার ঘণ্টাতেই ফেল করে কিংবা প্রত্যাশিত ফল না পেয়ে নিজেকে শেষ করে দিল অন্তত নয় শিক্ষার্থী।

অথচ এই দায় কার—তা নিয়ে একটু-আধটু প্রশ্ন উঠলেও সেই পালে হাওয়া লাগল না। ফলাফল ঘোষণার পর শিক্ষার্থীদের মানসিক যত্নের ব্যাপারটি উপেক্ষিতই থেকে গেল। কিন্তু আমরা জানলাম—চুয়াডাঙ্গার জীবননগর, চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ, গাজীপুরের শ্রীপুর, যশোরের পুলেরহাটসহ দেশের বিভিন্ন বিদ্যালয় ও মাদ্রাসা থেকে পরীক্ষার পর নেওয়া ব্যবহারিক পরীক্ষার নম্বর বোর্ডে পাঠানোই হয়নি!

প্রিয় পাখিরা,

২০১৮ সালে গাড়িচাপায় সহপাঠীর মৃত্যুতে ক্ষুব্ধ তোমরা নেমে এলে রাজপথে। কোমলমতি তোমরাই জায়গায় জায়গায় লিখে দিলে, 'রাষ্ট্র সংস্কারের কাজ চলছে'। এক পর্যায়ে ফ্যাসিস্ট হাসিনার পুলিশ আর পোষা হেলমেটবাহিনী তোমাদের বেদম পিটিয়ে রাস্তাছাড়া করল। অনিরাপদ সড়ক, অনিরাপদই থেকে গেল।

এর ছয় বছরের মাথায় সেই তোমাদের বিরুদ্ধেই যুদ্ধ ঘোষণা করলেন হাসিনা। রাষ্ট্রীয় বাহিনীর হাতে, রাষ্ট্রের টাকায় কেনা গুলি খেয়ে মরলে তোমরা। বন্ধু-ভাই-বোনের লাশ কাঁধে নিয়ে পালিয়ে বেড়ালে এখানে-ওখানে। তোমাদের কারও হাত হারালো, কারও পা। কারও কারও নিভে গেল চোখের আলো। পতন হলো হাসিনার।

কিন্তু তোমাদের রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে, পরিবর্তনের ডাক তুলে যারা রাজনীতিতে আসলো, ক্ষমতায় বসল যে অন্তবর্তী সরকার, তারাও তোমাদের ভাষা বুঝল না। কিছুদিন যেতে না যেতেই সবকিছু চলতে শুরু করল সেই আগের ধারাতেই।

প্রিয় ফুলগুলো,

চব্বিশে তোমাদের সেই ট্রমা কাটানোর দায় আমরা বড়রা কেউ নিইনি। উল্টো নিষ্পাপ বুকে ধেয়ে আসা বুলেটের ক্ষত শুকাতে না শুকাতেই তোমাদের ওপর আছড়ে পড়ল আস্ত এক যুদ্ধবিমান। জেট ফুয়েলের আগুনে অঙ্গার হলো, মোমের মতো গলে গেল ছোট্ট সব প্রাণ। কিছুদিন আগেই তোমরা যারা সঙ্গীর গুলিবিদ্ধ লাশ কাঁধে নিয়েছিলে, সেই তোমাদের ছোট্ট কাঁধে এবার উঠল বন্ধুর ঝলসানো দেহ।

অথচ এমনটা তো হওয়ার কথা ছিল না। যুদ্ধবিমানের বদলে তোমাদের আকাশজুড়ে থাকার কথা ছিল পাখির ঝাঁক কিংবা চঞ্চল প্রজাপতি অথবা ফড়িংয়ের মাতামাতি।

এখন প্রশ্ন উঠেছে—ঢাকার মতো এমন জনবহুল শহরে যুদ্ধবিমানের মহড়ার যৌক্তিকতা নিয়ে। কিন্তু এই প্রশ্ন কেউ করছে না যে—বাংলাদেশ নামের ছোট্ট এ ভূখণ্ডে এমন কোন এলাকা আছে যেখানে জনবসতি কিংবা প্রাণপ্রকৃতির সংসার নেই?

জানা যায়, মধুপুর শালবনে 'রাজবাড়ি' নামের এক প্রাচীন মান্দি গ্রাম উচ্ছেদ করে বিমান বাহিনীর ফায়ারিং রেঞ্জ স্থাপন করা হয়েছে। এক্ষেত্রে সংরক্ষিত শালবনের ওই রেঞ্জের বন্যপ্রাণী ও প্রাণবৈচিত্র্যের কী কোনো মূল্যই নেই?

প্রিয় জোনাকিরা,

মরে গিয়েও, মৃতপ্রায় থেকেও তোমাদের মুক্তি মেলেনি। তোমাদের অঙ্গার শবদেহ নিয়ে যখন গোরস্থানমুখী স্বজনেরা, হাসপাতালে যন্ত্রণাকাতর অন্যদের নিয়ে অনিশ্চিত অপেক্ষায় স্তব্ধ যখন তোমাদের বাবা-মা, তখনই সদলবলে দেখতে আসার নাম নিয়ে আমরা দেখলাম রাজনৈতিক দলগুলোর অরুচিকর লোক-দেখানো রাজনীতি। এক্ষেত্রে পুড়ে যাওয়া ছোট্ট দেহগুলোতে সংক্রমণের শঙ্কা কিংবা চিকিৎসায় বিঘ্ন ঘটার বিষয়টি কারও মাথায় এলো না।

এর পাশাপাশি বেঁচে যাওয়া ও পাগলপ্রায় স্বজনদের দুর্বলতম অবস্থার ছবি-ভিডিও প্রদর্শনের প্রতিযোগিতায় নামল গণমাধ্যমগুলো।

এদিকে তোমাদের হারানোর শোক যখন পাথর হয়ে চেপে বসেছে পুরো দেশের বুকের ওপর, তখনো চূড়ান্ত দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয় দিয়ে চলমান এইচএসসি পরীক্ষা পেছানোর ঘোষণা দিতে ইন্টেরিম রাত ৩টা বাজিয়ে দিলো। সকালে অনেক শিক্ষার্থী পরীক্ষা দিতে বেরিয়ে জানল সে কথা। ফলে সেদিন মঙ্গলবার নিভে যাওয়া কোমল প্রাণের স্মরণে রাষ্ট্রীয় শোকের দিনে দিয়াবাড়ির মাইলস্টোন ক্যাম্পাস থেকে নয় কিলোমিটার দূরে সচিবালয় এলাকা রণক্ষেত্র হল সংঘাতে। ক্যাম্পাসে অবরুদ্ধ হলেন দুই উপদেষ্টা।

আরেক পক্ষ সরব হলো লাশ গণনার রাজনীতিতে। তৈরি হলো লাশ গুমের গুজবের মচ্ছব। যেন লাশের সংখ্যা কিছু কম অথবা বেশি হলে কাঠামোগত এই হত্যাকাণ্ডের ওজন খানিকটা কমে কিংবা বেড়ে যায়।

এদেশে ন্যূনতম সংবেদনশীলতা তোমরা কার কাছ থেকে আশা করবে?

প্রিয় সোনামনিরা,

তোমাদের সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর কোনো উপায়ই আমাদের নেই। আমরা তোমাদের গভীর অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই দিতে পারিনি। ফড়িংয়ের মতো হেলিকপ্টার দেখে উদ্বেলিত হয় যে শিশুমন, গত জুলাই-আগস্টের পর থেকে তা অনেকের কাছে আতঙ্কের নাম। কারণ, গেল অভ্যুত্থানে এই হেলিকপ্টার থেকে ছোড়া বুলেটেই প্রাণ গিয়েছিল অনেকের। নিস্তার পায়নি আকাশ দেখতে ছাদে ওঠা রিয়া গোপের মতো শিশুরাও।

এ দফায় উত্তরার মাইলস্টোন ক্যাম্পাসে যুদ্ধবিমান আছড়ে পড়ার পর সেখানকার এক শিক্ষার্থী জানিয়েছে, সে তার প্রিয় খেলনা প্লেনগুলো নিয়ে আর খেলতে পারবে না।

এভাবে আমরা বড়রা তোমাদের কাছ থেকে সবকিছু কেড়ে নিচ্ছি। বড়দের লোভ-লাভ-প্রতিহিংসার যে জগৎ থেকে আলাদা হয়ে তোমরা নিজেদের কল্পনার আলাদা মহাজগৎ সাজিয়ে তোলো, সেখানেও আমরা হানা দিয়ে চলেছি ক্রমাগত। ভয় ছাড়া তোমাদের দেওয়ার মতো আর কিছুই নেই আমাদের।

বাচ্চারা, তোমরা কি আমাদের মাফ করবে?

 

মামুনুর রশীদ: জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক,  দ্য ডেইলি স্টার

Comments

The Daily Star  | English

US retailers lean on suppliers to absorb tariffs

Rather than absorbing the cost or immediately passing it on to consumers, many US apparel retailers and brands have turned to their suppliers in Bangladesh, demanding they share the pain

5h ago