যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় কিছু প্রশ্ন

মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমান বিধ্বস্তের পর ফায়ার সার্ভিস ও সেনাবাহিনী উদ্ধারকাজে যোগ দেয়। ছবি: প্রবীর দাশ/স্টার

ঢাকার একটি স্কুলে সম্প্রতি একটি যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় কুর্মিটোলায় বিমানঘাঁটি পরিচালনা এবং সেখান থেকে প্রশিক্ষণ ফ্লাইট পরিচালনার যৌক্তিকতা নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন।

এই বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগ বা গণমাধ্যমে খুব বেশি আলোচিতও নয়।

দুর্ঘটনার পরদিন ঢাকার মূল বিমানবন্দরের পাশের এ কে খন্দকার বিমানঘাঁটি আবেগঘন বক্তব্যে বিমান বাহিনী প্রধান ঘাঁটিটির প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করেন। এরপর ২৮ জুলাই এক সংবাদ সম্মেলনে বিমান বাহিনীর দুইজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা ঢাকায় বিমানঘাঁটির প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন।

সরকার ২৭ জুলাই এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধান, ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানির পরিমাণ নিরূপণ এবং দায়িত্ব নির্ধারণ করতে নয় সদস্যের একটি তদন্ত কমিশন গঠন করে। কমিশনকে চার সপ্তাহের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।

বিমান বাহিনীর ব্যাখ্যা ও তদন্ত কমিশন গঠনের সিদ্ধান্ত কিছু প্রশ্নের জন্ম দেয়, যেগুলোর কোনো উত্তর মেলেনি এখনো পর্যন্ত। হয়তো সেই প্রশ্নগুলো আসলে উত্থাপিতই হয়নি, যার ফলে পাওয়া যায়নি উত্তরও।

বিমানঘাঁটি ও ফ্লাইট প্রশিক্ষণের প্রসঙ্গ দিয়েই শুরু করা যাক। বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খান বলেন, 'এটাই আমাদের প্রধান ঘাঁটি...এটাই আমাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এলাকা। সব ভিআইপি এখানে থাকেন, আমাদের অবকাঠামো এখানে, সংসদ ভবন এখানে। নিরাপত্তার বিষয় আছে। তাই এখানে একটি শক্তিশালী বিমানঘাঁটি থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।'

তার বক্তব্যের সারমর্ম হলো, ঢাকার আকাশসীমা রক্ষা করা বিমান বাহিনীর প্রধান দায়িত্ব। ২৮ জুলাই এয়ার অপারেশন্সের পরিচালক এয়ার কমোডর শহিদুল ইসলামও একই ধরনের বক্তব্য দেন। তিনি আরও বলেন, পৃথিবীর যেকোনো দেশের রাজধানীতে বিমানঘাঁটি অত্যাবশ্যক। জ্যেষ্ঠ এই কর্মকর্তা আরও বলেন, ফ্লাইট প্রশিক্ষণ একটি বিমানঘাঁটির অবিচ্ছেদ্য অংশ।

আশপাশের দেশগুলোর রাজধানীর দিকে নজর দিলে দেখা যায়, সেখানকার বিমানঘাঁটি বা এমনকি বিমানবন্দরগুলোও সাধারণত শহরের সীমানার বাইরেই থাকে। সেখানে কুর্মিটোলা সম্পূর্ণরূপে ঢাকা শহরের ভেতরে অবস্থিত। সংসদ ভবন থেকে এর দূরত্ব আট কিলোমিটারেরও কম।

উদাহরণস্বরূপ, হিন্দন এয়ার ফোর্স স্টেশন ভারতের লোকসভা ভবন থেকে প্রায় ১৬ কিলোমিটার দূরে, দিল্লি শহরের সীমানার বাইরে। তবে হিন্দন ঘাঁটি মূলত ভিআইপি মুভমেন্টের জন্য ব্যবহৃত হয়, যুদ্ধবিমান পরিচালনার জন্য নয়। যুদ্ধবিমান পরিচালনাকারী সবচেয়ে কাছের ঘাঁটি হলো অম্বালা, যা রাফাল যুদ্ধবিমানের ঘাঁটি। হরিয়ানার অম্বালায় অবস্থিত এই ঘাঁটি দিল্লি থেকে প্রায় ২০০ কিলোমিটার দূরে।

ইসলামাবাদের সবচেয়ে কাছের বিমানঘাঁটি হলো নূর খান, যা পার্শ্ববর্তী শহর রাওয়ালপিন্ডিতে অবস্থিত এবং পাকিস্তানের সংসদ ভবন থেকে প্রায় ১৩ কিলোমিটার দূরে। শ্রীলঙ্কার কাটুনায়েকে বিমানঘাঁটি বান্দারনায়েক আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সঙ্গেই, যা কলম্বো শহরের সীমার বাইরে এবং সংসদ ভবন থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে।

মার্কিন কংগ্রেস ভবন থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে, ওয়াশিংটন ডিসির পার্শ্ববর্তী রাজ্য মেরিল্যান্ডে অবস্থিত অ্যান্ড্রুজ বিমানঘাঁটি। লন্ডনের শহরসীমার বাইরে অবস্থিত নর্থহোল্ট বিমানঘাঁটি, যা হাউস অব কমন্স থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে। মস্কো শহর থেকে ৬০ কিলোমিটার দূরে কুবিনকা বিমানঘাঁটি, যদিও এটি 'বৃহত্তর মস্কো'র অন্তর্ভুক্ত।

ঢাকা শহরে বিমানঘাঁটি থাকার কৌশলগত ও কার্যকর প্রয়োজনীয়তা হয়তো ভিন্ন এবং তাই এটি অন্যান্য শহরের সঙ্গে তুলনীয় নয়—তবুও এ বিষয়ে এখনো কোনো স্পষ্ট ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি। কেন প্রশিক্ষণ ফ্লাইট অন্য স্থান থেকে পরিচালনা করা সম্ভব নয়, সেই বিষয়েও কোনো ব্যাখ্যা দেয়নি বিমান বাহিনী।

অন্যদিক থেকে বলা যায়, এফ-৭ যুদ্ধবিমান শব্দের দ্বিগুণ গতিতে উড়তে পারে। ঘণ্টায় এর গতি প্রায় ২৪৬৫ কিলোমিটার। যদি এটি ঘণ্টায় ১২০০ কিলোমিটার গতিতেও উড়ে, তাহলে আরিয়াল বিলে অবস্থিত কোনো ঘাঁটি থেকে মাত্র দুই মিনিটের মধ্যে এবং যশোর ঘাঁটি থেকে সাত মিনিটের মধ্যে ঢাকায় পৌঁছানো সম্ভব।

তবে এটাও ঠিক, বিমানঘাঁটি প্রতিষ্ঠার সময় উত্তরায় এত ঘনবসতি ছিল না। সেসময় বিমানবন্দরটি মূল শহরের সীমার বাইরেই ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে ঢাকার বিস্তার ঘটেছে এবং বিমানবন্দরটি এখন পুরোপুরি শহরের মধ্যে।

তাই বিমানবন্দর এলাকায় বাসাবাড়ি ও স্কুলের পরিকল্পনার অনুমোদন দেওয়ার সময় নগর কর্তৃপক্ষ কেন সতর্কতা অবলম্বন করেনি, সেটি অবশ্যই খতিয়ে দেখা উচিত। এটি মনে রাখাও জরুরি যে, এমনকি যদি বিমানঘাঁটি সরানো হয়, তবুও বিমানবন্দর সেখানে থেকেই যাবে এবং যাত্রীবাহী বিমানের উড্ডয়নপথে শত শত ভবনও থেকেই যাবে।

তবে রাজধানীতে বিমানঘাঁটি সারা বিশ্বেই প্রচলিত—এমন বক্তব্য যখন বাস্তবতার সঙ্গে মেলে না, তখন তা জনমনে দ্বিধা সৃষ্টি করে।

বিমান বাহিনী প্রধান বলেছিলেন, 'একটি শক্তিশালী বিমান বাহিনী আমাদের সার্বভৌমত্বের জন্য অত্যাবশ্যক। গুজব ছড়িয়ে তাদের দুর্বল করবেন না।' একটি বিকল্প বিমানঘাঁটির সম্ভাবনা অনুসন্ধান কোনোভাবেই বিমান বাহিনীকে দুর্বল করার চেষ্টা নয়। তবে বিমান বাহিনীর দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা যখন অতিরঞ্জিত বক্তব্য দেন, তখন তা সশস্ত্র বাহিনীর একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশের বিশ্বাসযোগ্যতা ক্ষুণ্ণ করে এবং এর ভিত্তিকে দুর্বল করে তোলে।

তবে কুর্মিটোলায় বিমানঘাঁটি রাখা কিংবা প্রশিক্ষণ পরিচালনা—এই সিদ্ধান্ত প্রতিরক্ষা বাহিনীর এখতিয়ারের মধ্যে পড়ে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে তাদের কৌশলগত ও কার্যকর অগ্রাধিকার পুনর্মূল্যায়নের জন্য সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের একত্রিত হয়ে কাজ করা আশাব্যঞ্জক হবে।

এবার সরকার গঠিত তদন্ত কমিশনের বিষয়ে আসা যাক। সরকারি প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, নয় সদস্যবিশিষ্ট  কমিশন বিমান বিধ্বস্তের পরিপ্রেক্ষিত, কারণ, দায়দায়িত্ব ও ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ এবং ঘটনা–সংশ্লিষ্ট অপরাপর বিষয় চিহ্নিত করবে। সাবেক সচিব একেএম জাফর উল্লাহ খানের নেতৃত্বে গঠিত এই কমিশনে রয়েছেন একজন অবসরপ্রাপ্ত এয়ার ভাইস মার্শাল, তিনটি মন্ত্রণালয়ের তিনজন অতিরিক্ত সচিব, ঢাকা বিভাগের কমিশনার, একজন নগর পরিকল্পনাবিদ এবং বুয়েটের যান্ত্রিক প্রকৌশল বিভাগের একজন অধ্যাপক। যদিও এফ-৭ জেটের বেশ কয়েকটি দুর্ঘটনা ঘটেছে, তবুও এই কমিশনে বিমান নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের কোনো প্রতিনিধি নেই। মনে পড়ে, ভারতের আহমেদাবাদে সাম্প্রতিক একটি দুর্ঘটনার তদন্তে তারা বোয়িং কর্মকর্তাদের অন্তর্ভুক্ত করেছিল।

লক্ষ্য করা যায়, এই কমিটিতে কোনো অ্যাভিয়েশন বিশেষজ্ঞ, বিমান প্রকৌশলী বা কোনো ধরনের কারিগরি দক্ষতাসম্পন্ন ব্যক্তি নেই। তাহলে এই কমিটি কীভাবে দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধান করবে? সম্ভবত, বিমান বাহিনী একটি পৃথক তদন্ত করবে এবং নিরাপত্তার স্বার্থে সেই তদন্তের ফলাফল জনসমক্ষে প্রকাশ নাও করতে পারে। গোপন তথ্য যাতে ফাঁস না হয়, সেজন্য এতে আপত্তি করারও কারণ নেই।

তবে সেক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকে এটি স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করা উচিত। তদন্ত কমিটি গঠন ছাড়া এখনো পর্যন্ত দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি, যা ভবিষ্যৎ ঝুঁকি কমাবে। এটি অন্তর্বর্তী সরকারের একটি দুর্বলতা।

দিয়াবাড়ি গোলচত্বরে অবস্থান নিয়ে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করছেন। ছবি: প্রবীর দাশ/স্টার

যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়ে অনেক প্রাণ ঝরে গেছে। স্কুলে থাকা শিশুদের প্রাণ। এ অবস্থায় এমন প্রত্যাশা নিশ্চয়ই অযৌক্তিক হবে না যে, সংশ্লিষ্ট সব পক্ষ আন্তরিকতা ও দায়িত্ববোধ নিয়ে বিষয়টি বিবেচনা করবে। কিন্তু যদি এর ব্যতিক্রম হয়, তাহলে যারা আমাদের ছেড়ে চলে গেল, সেটা তাদের স্মৃতির অপমানের শামিল।

তবে এখন পর্যন্ত যা দেখা যাচ্ছে, যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তার উদ্দেশ্য কেবল বুঝ দেওয়া, প্রকৃত সমাধান খোঁজা নয়।

 

Comments