যুক্তরাষ্ট্র-চীনের শুল্কযুদ্ধের খেসারত দিচ্ছে বাংলাদেশ

ট্রাম্প প্রশাসনের শুল্ক নীতির আওতায় সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়েছে এশিয়ার ছোট দেশগুলো, বিশেষ করে বাংলাদেশে। এই শুল্ক আরোপে ওয়াশিংটনের আনুষ্ঠানিক যুক্তি ছিল—এসব দেশ যুক্তরাষ্ট্রে যে পরিমাণ পণ্য রপ্তানি করে, আমদানি করে তার চেয়ে কম। ট্রাম্প প্রশাসনের দাবি, এই 'অন্যায্য বাণিজ্য ঘাটতি' কমাতে বাড়তি শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত।
তবে বিশ্লেষকরা এই ঘাটতির হিসাব ব্যবহার করার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তারা বলছেন, এই শুল্ক আরোপ আসলে চীনকে শাস্তি দেওয়ার একটি বৃহত্তর ভূ-রাজনৈতিক কৌশলের অজুহাত মাত্র। যুক্তরাষ্ট্র এমন দেশগুলোকেই লক্ষ্যবস্তু করেছে, যারা চীনের ওপর নির্ভরশীল বা চীন থেকে বিনিয়োগ পেয়ে থাকে।
বাণিজ্য আলোচনার সঙ্গে সম্পৃক্ত কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বাংলাদেশ ওয়াশিংটনের চাপের মধ্যে আছে। চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য সম্পর্ক কমাতে চায় যুক্তরাষ্ট্র।
ওয়াশিংটনের চাপ ঢাকাকে প্রায় অসম্ভব সিদ্ধান্তের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। কারণ বাংলাদেশকে তার সবচেয়ে বড় ক্রেতা ও সবচেয়ে বড় সরবরাহকারীর দেশের মধ্যে একটিকে বেছে নিতে হচ্ছে। ফলে বাংলাদেশ সরাসরি যুক্তরাষ্ট্র-চীন বাণিজ্য যুদ্ধের প্রভাবের মধ্যে পড়েছে।
কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বাংলাদেশি পণ্যের ওপর ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছেন। কারণ এদেশে তৈরি বেশিরভাগ পণ্যে চীনা কাঁচামাল ব্যবহার করা হয়। তারা বলেছেন, এই পদক্ষেপ চীনের অর্থনৈতিক প্রভাব মোকাবিলায় ওয়াশিংটনের একটি বৃহত্তর কৌশলের প্রতিফলন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে চীন থেকে ১৬ দশমিক ৬৩ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করেছে বাংলাদেশ, যা মোট আমদানি ব্যয়ের ২৬ দশমিক ৪ শতাংশ। এই আমদানির ৮০ শতাংশের বেশি তৈরি পোশাক খাতের কাঁচামাল—যেমন কাপড়, রাসায়নিক ও আনুষঙ্গিক পণ্য।
এই নির্ভরশীলতাই বাণিজ্য লড়াইয়ের মূল কারণ। যুক্তরাষ্ট্র কঠোর 'রুলস অব অরিজিনের (আরওও)' প্রস্তাব করছে। এতে মার্কিন বাজারে প্রবেশের জন্য বাংলাদেশি পণ্যে ৪০ শতাংশ স্থানীয় মূল্য সংযোজন প্রয়োজন হবে।
বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান গত সপ্তাহে স্বীকার করেন, রুলস অব অরিজিনের এই প্রস্তাব বাংলাদেশের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
সবচেয়ে বেশি চাপের মুখে পড়েছে ওভেন পোশাক খাত, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানির একটি বড় অংশ। শিল্প সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করা ট্রাউজার ও শার্টজাতীয় পোশাক তৈরির প্রয়োজনীয় ওভেন কাপড়ের প্রায় ৭০ শতাংশই চীন থেকে আমদানি করা হয়।
এর বিপরীতে নিটওয়্যার খাত তুলনামূলকভাবে কম চীননির্ভর। কারণ স্থানীয় সুতা উৎপাদনকারীরা প্রায় ৯০ শতাংশ কাঁচামাল সরবরাহ করতে সক্ষম।
এই তথ্য ওভেন খাতের দুর্বলতা সামনে এনেছে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ থেকে ৪ দশমিক ৬২ বিলিয়ন ডলারের ওভেন পোশাক আমদানি করেছে, যেখানে নিটওয়্যার খাতের পরিমাণ ছিল ২ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার।
পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান মাসরুর রিয়াজ বলেন, 'যুক্তরাষ্ট্রের মূল্য সংযোজন শর্তাবলী এতটাই কঠোর যে, বাংলাদেশের পক্ষে তা মানা প্রায় অসম্ভব।'
বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের সাবেক সদস্য মোস্তফা আবিদ খান একই কথা বলেন। তার ভাষ্য, উচ্চ মূল্য সংযোজনের এই দাবি বাংলাদেশের ওভেন খাতের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করবে।
ওয়াশিংটনের দাবির পরিধি মূল্য সংযোজনের বাইরেও আছে। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে তাদের শুল্কব্যবস্থায় মার্কিন ভূরাজনৈতিক স্বার্থ অনুযায়ী পুনর্গঠনের জন্য চাপ দিচ্ছে। যেখানে যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত দেশগুলোর জন্য কম শুল্ক এবং অন্য দেশের জন্য বেশি শুল্ক প্রস্তাব করা হয়েছে।
এটি সরাসরি বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার মোস্ট ফেভার্ড নেশন (এমএফএন) নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এই নীতিতে সব সদস্য দেশের জন্য সমান শুল্ক হার প্রয়োগের মাধ্যমে বৈষম্যহীন বাণিজ্য নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে।
এই কঠিন প্রস্তাবনার মুখে ঢাকা সমঝোতার কৌশল নিয়েছে। কঠোর আরওও বা শুল্ক সামঞ্জস্যে একমত হতে না পেরে, বাংলাদেশি আলোচকরা পরিবর্তে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রপ্তানি ঘাটতি কমাতে মার্কিন পণ্যের আমদানি বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছেন। মার্কিন আলোচকদের আকৃষ্ট করতে ঢাকা ছাড়ের একটি প্যাকেজ অফার করেছে। যার মধ্যে রয়েছে বেশি পরিমাণে মার্কিন এলএনজি, তুলা, সয়াবিন ও বোয়িং বিমানের অর্ডার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি।
আলোচনাগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও বিনিয়োগ-সংক্রান্ত উদ্বেগও প্রতিফলন দেখা গেছে। বাংলাদেশি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রের আলোচকরা মার্কিন বিনিয়োগের নিরাপত্তার আশ্বাস চেয়েছেন ও বাংলাদেশে চীনা পুঁজির প্রবাহ বৃদ্ধির বিষয়টি তুলে ধরেছেন। তারা স্থানীয় শিল্প খাতে চীনা মালিকানার বৃদ্ধি, নীতিনির্ধারণ, মেধাস্বত্ব আইন এবং শ্রম অধিকারের দুর্বলতার কথাও উল্লেখ করেন।
শিল্প নেতারা সম্ভাব্য বিপদের ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। গার্মেন্টস রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান ইভিন্স গ্রুপের চেয়ারম্যান আনোয়ার-উল-আলম চৌধুরী বলেন, 'চীনা কাপড় দিয়ে তৈরি পণ্যে ৪০ শতাংশ মূল্য সংযোজনের প্রয়োজনীয়তা পূরণ করা প্রায় অসম্ভব।'
এছাড়াও 'ট্রান্সশিপমেন্ট' শুল্ক আরোপের আশঙ্কাও বাড়ছে। তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, ট্রাম্প প্রশাসন চীন থেকে বাংলাদেশ হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়া যেকোনো পণ্যকে ট্রান্সশিপমেন্ট বলে ধরে নিতে পারে। যেমনটা তারা ভিয়েতনামের বেলায় করেছে।
এদিকে ওয়াশিংটনে দ্বিতীয় রাউন্ডের বৈঠক চলছে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশের পোশাক শিল্প মার্কিন বাজারে এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখে পড়েছে।
বাংলাদেশ গার্মেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) সভাপতি মাহমুদ হাসান খান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে জরুরি সাক্ষাতের জন্য অনুরোধ জানিয়েছেন। যেন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনার জন্য লবিস্ট নিয়োগের বিষয়টি তুলে ধরা যায়।
মাসরুর রিয়াজ বলেন, 'এই আলোচনা কেবল বাণিজ্য বা অর্থনৈতিক নয়, বরং আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও কৌশলের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কারণ বাংলাদেশ চাইলেও রাতারাতি চীনা পণ্যের ওপর নির্ভরতা শেষ করতে পারবে না।'
Comments