ছোট, দক্ষ, পরিকল্পিত সরকার কী করতে পারে

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন
জাতীয় সংসদ ভবন। ছবি: স্টার ফাইল ফটো

আট মাস পরে নির্বাচিত যেই সরকারই ক্ষমতায় আসবে, তাদেরকে অনেকগুলো চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়তে হবে। সে কারণে এখন থেকেই দক্ষ সরকার-যন্ত্র নিয়ে কথা বলা প্রয়োজন। দক্ষ মানে যে সরকার তার 'অপারেটিং কস্ট' কমিয়ে আনবে। তো, সরকার কীভাবে তার 'অপারেটিং কস্ট' কমাতে পারে?

আমরা যখন 'সরকারকে ছোট করে আনা' কথাটা শুনি, তখন অনেকেই ভাবি, এই বুঝি সরকারকে দুর্বল করে ফেলা বা তার ক্ষমতা কমিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আসলে তা নয়। সরকারকে ছোট করে আনার মানে হলো—সরকার যেন অপ্রয়োজনীয় কাজগুলো না করে, জনগণের ঘাড়ে অকারণ খরচের বোঝা না চাপায়, আর সবকিছু নিজের হাতে না রেখে প্রয়োজন অনুযায়ী শুধু মূল দায়িত্বগুলোই পালন করে।

সরকার তো আসলে আমাদেরই, তাই না? আমরা যারা ট্যাক্স দেই—ছোট দোকানি, বেসরকারি চাকরিজীবী, উদ্যোক্তা, গার্মেন্টস শ্রমিক—সবাই মিলে একেকটা সরকারি অফিস, প্রকল্প, চাকরি, তাদের পেনশন আর বিশাল বিশাল সরকারি বিল্ডিং তৈরি করছি। এখন প্রশ্ন হলো, এই বিনিয়োগের রিটার্ন কী আসছে? মানুষ কি সত্যিই সেই পরিষেবা পাচ্ছে যেটার জন্য টাকা যাচ্ছে?

একটা দেশ যতই বড় হোক না কেন, সরকারের ক্ষমতা সীমিত। আর সেই সীমিত ক্ষমতা নিয়ে যদি সরকার সব করতে চায়—রেলওয়ে চালাবে, ব্যাংক চালাবে, দোকান খুলবে, অ্যাপ বানাবে, বীমা করবে, এমনকি রাস্তার ধরে গাছও লাগাবে। তাহলে দেখা যাবে, একদিকে ব্যর্থতা বাড়ছে, অন্যদিকে জনগণের ট্যাক্সের টাকাও অপচয় হচ্ছে। বেসিক আলাপ, সরকারের কাজ কী হতে পারে?

সরকারের কাজ হলো নীতি তৈরি করা, আইন বানানো, নাগরিকদের সার্ভিস দেওয়া, আর নির্যাতিত দুর্বলদের পাশে দাঁড়ানো। কিন্তু সরকার যদি নিজেই ব্যবসায় নেমে পড়ে, তাহলে সে বিচারক, খেলোয়াড় আর রেফারি—সব একসঙ্গে হয়ে যায়। এতে করে ন্যায্য প্রতিযোগিতা নষ্ট হয়, প্রাইভেট উদ্যোক্তারা নিরুৎসাহিত হয়, আর শেষমেশ বাজারে গতি থাকে না। সরকার যদি নিজে নির্যাতন করে, তাহলে মানুষ আস্থা হারায় সরকারে।

চলুন একটু রিয়েল লাইফ উদাহরণ দেই। ধরুন সরকার নিজে একটা মোবাইল অ্যাপ বানালো, যাতে কৃষকরা ফসলের দাম জানতে পারে। দারুণ উদ্যোগ, সন্দেহ নেই। কিন্তু অ্যাপটা ঠিকমতো চলে না, ইউজার ইন্টারফেস কঠিন, আর তথ্য আপডেট হয় না। অথচ একই জিনিস যদি কোনো দক্ষ স্টার্টআপকে করার সুযোগ দেওয়া হতো, তারাই হয়তো একই কাজটা আধা খরচে, আরও ভালোভাবে করতো।

তাহলে সরকার কী করবে? সরকার শুধু বলবে—'আমরা এই ধরনের অ্যাপ দরকার মনে করছি, তোমরা বানাও, আমরা গাইড করব, রেগুলেশন দেবো, আর নিরাপত্তা নিশ্চিত করব'। এইভাবেই হওয়া উচিত। সরকার পলিসি দেবে, অথচ বাস্তবায়নটা হবে জনগণ বা প্রাইভেট সেক্টরর মাধ্যমে। এতে শুধু খরচ কমে না, গুণগত মানও বাড়ে। পাশাপাশি, এমপ্লয়মেন্ট বাড়ে।

আর একটা বড় ভুল যেটা সরকার করে, সেটা হলো—বিভিন্ন প্রকল্প বানিয়ে নিজের দপ্তরের ভেতরেই সব সমাধান খোঁজা। এতে যেমন নতুন উদ্ভাবনের জায়গা কমে যায়, তেমনি কর্মচারীদের ওপর অপ্রয়োজনীয় চাপ পড়ে। এর পরিবর্তে যদি অটোমেশন, আউটসোর্সিং আর পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) ব্যবহারের দিকে ঝোঁক দেওয়া হয়, তাহলে কম খরচে বেশি কাজ করা সম্ভব হয়।

আরেকটা উদাহরণ দিই। ধরুন সরকার নিজে এয়ারলাইন চালাচ্ছে, আবার এয়ারপোর্ট ম্যানেজমেন্ট প্রকল্পও করছে। এসব জায়গায় সরকার আসলে প্রতিযোগিতায় নেই, কারণ তারা লোকসান দিলেও টিকে যায়—কারণ জনগণের টাকা তো আছে। কিন্তু একটা প্রাইভেট কোম্পানি যদি এই সেক্টরে ঢুকে, তাকে প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকতে হয়। ফলে সে পণ্যের মান বাড়ায়, খরচ কমায়, আর নতুন উদ্ভাবনে মন দেয়। তখনই একটা হেলদি ইকোনমি তৈরি হয়।

সরকারকে ছোট করতে গেলে কী করতে হবে?

প্রথমত, সরকারি দপ্তরগুলোর মধ্যে কে কোন কাজ করবে, তার একটা পরিষ্কার লাইন টানতে হবে। অনেক সময় দেখা যায়, দুই-তিনটা দপ্তর একই ধরনের কাজ করছে, অথচ কাউকেই পুরো দায়িত্বটা দেওয়া হয়নি। এতে করে দায় এড়ানোর প্রবণতা বাড়ে, আর সিদ্ধান্ত আসে না।

দ্বিতীয়ত, যেখানে বেসরকারি উদ্যোগ ভালো কাজ করছে, সেখানে সরকারকে একটা 'এনাবলার' বা সহায়ক ভূমিকায় চলে যেতে হবে। রাস্তাঘাট-ট্যাক্স ম্যানেজমেন্ট, আইন-কানুন ঠিক রাখা, সবার জন্য তথ্য সংগ্রহ, নীতিমালাকে ঠিকমতো চলতে দেওয়া—এই জিনিসগুলো নিশ্চিত করে সরকার যদি ব্যবসার পরিবেশ ভালো রাখে, তাহলেই যথেষ্ট।

তৃতীয়ত, ডিজিটাল গভর্ন্যান্স আনতে হবে—যেখানে নাগরিক নিজেই অনলাইনে আবেদন করতে পারে, সরকারি ফর্ম পূরণ করতে পারে, অভিযোগ জানাতে পারে। এতে করে অফিসিয়াল কাজ কমে, টাকার অপচয় কমে, আর স্বচ্ছতা বাড়ে। এখানেই সরকারের খরচ কমে আসবে প্রায় ৪০ ভাগ।

সরকার ছোট হওয়া মানে জনগণের ট্যাক্স কমে যাওয়া। সরকার যদি অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প না করে, কর্মচারী নিয়োগে লাগাম টানে, বাজেট খরচে জবাবদিহিতা আনে, তাহলে সে টাকা আর আমাদের কাছ থেকে বারবার নিয়ে যেতে হবে না।

একটা ছোট, দক্ষ, পরিকল্পিত সরকার—যে নিজের সীমা জানে, নিজের দায়িত্ব বুঝে—তাই-ই হলো উন্নত রাষ্ট্রের চাবিকাঠি। সরকার যখন নিজের জায়গায় থাকে, তখনই মানুষ তার কাজকে সম্মান করে। এবং ঠিক তখনই, সরকার আর নাগরিকের সম্পর্কটা হয় বিশ্বাস আর সহযোগিতার, যেখানে ট্যাক্স দেওয়াটাও এক ধরনের গর্ব হয়ে দাঁড়ায়।

রকিবুল হাসান: টেলিকম ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাবিষয়ক লেখক এবং লিংক-থ্রি টেকনোলজিস লিমিটেডের চিফ টেকনোলজি অফিসার

Comments

The Daily Star  | English

Hamas responds to Gaza ceasefire proposal, it's 'positive': Palestinian official

US President Donald Trump earlier announced a "final proposal" for a 60-day ceasefire in the nearly 21-month-old war between Israel and Hamas, stating he anticipated a reply from the parties in coming hours

31m ago