আত্মরক্ষার অজুহাতে ইসরায়েলের হামলা, কী বলছে আন্তর্জাতিক আইন?

ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পর মঙ্গলবার তেল আবিবের কাছে একটি ভবন থেকে ধোঁয়া উঠতে দেখা যায়। ছবি: এএফপি

ইরানের বিরুদ্ধে বড় ধরনের সামরিক অভিযান শুরু করেছে ইসরায়েল। তাদের হামলার লক্ষ্যবস্তু হয়েছে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনা, বিজ্ঞানী এবং সামরিক নেতৃত্ব।

জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে একটি জরুরি বৈঠকে এই হামলার পক্ষে সাফাই গেয়েছেন ইসরায়েলি রাষ্ট্রদূত ড্যানি ড্যানন।

বৈঠকে তিনি একে 'নিবারণমূলক হামলা' হিসেবে আখ্যা দেন। তিনি দাবি করেন, এই হামলা চালানো হয়েছে 'সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য, উদ্দেশ্য এবং সবচেয়ে উন্নত গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে। তার মতে, এর লক্ষ্য ছিল ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি ধ্বংস করা, দেশটির 'সন্ত্রাস ও আগ্রাসনের' হোতাদের নির্মূল করা এবং ইসরায়েলকে ধ্বংস করার প্রকাশ্য হুমকি বাস্তবায়নের ক্ষমতা নষ্ট করে দেওয়া।

কিন্তু প্রশ্ন হলো, আত্মরক্ষা নিয়ে আন্তর্জাতিক আইন কী বলে? ইসরায়েলের এই যুদ্ধ কি আন্তর্জাতিক আইনে বৈধ?

আত্মরক্ষার অধিকার কখন বৈধ?

জাতিসংঘ সনদের ২.৪ অনুচ্ছেদে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে:

সকল সদস্য রাষ্ট্র তাদের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে এমন কোনো হুমকি বা বলপ্রয়োগ থেকে বিরত থাকবে, যা অন্য কোনো রাষ্ট্রের আঞ্চলিক অখণ্ডতা বা রাজনৈতিক স্বাধীনতার বিরুদ্ধে যায়, অথবা যেটা জাতিসংঘের উদ্দেশ্যের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ।

এই নিয়মের ব্যতিক্রম মাত্র দুটি: ১. যখন জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ শক্তি প্রয়োগের অনুমোদন দেয়। ২. যখন কোনো রাষ্ট্র আত্মরক্ষার্থে পদক্ষেপ নেয়।

সনদের ৫১ অনুচ্ছেদে এই 'একক বা যৌথ আত্মরক্ষার সহজাত অধিকার'-এর কথা বলা হয়েছে। নিরাপত্তা পরিষদ আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষায় ব্যবস্থা নেওয়ার আগপর্যন্ত এই অধিকার বলবৎ থাকে।

'আত্মরক্ষা' বলতে কী বোঝায়?

আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (আইসিজে) বরাবরই আত্মরক্ষার বিষয়টিকে সংকীর্ণ অর্থে ব্যাখ্যা করেছেন। যুক্তরাষ্ট্র, উগান্ডা বা ইসরায়েলের মতো দেশগুলো যখনই আত্মরক্ষার বিস্তৃত ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেছে, আদালত তা প্রত্যাখ্যান করেছেন।

তবে ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের হামলার পর সবকিছু বদলে যায়। নিরাপত্তা পরিষদ এক প্রস্তাবের মাধ্যমে জানায় যে, রাষ্ট্র নয় এমন কোনো গোষ্ঠীর (যেমন সন্ত্রাসী সংগঠন) হামলা মোকাবিলায়ও আত্মরক্ষার অধিকার প্রয়োগ করা যাবে। এই অধিকারের ভিত্তিতেই যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে সামরিক অভিযান শুরু করে।

এরপরই 'অগ্রিম আত্মরক্ষা' বা আসন্ন হামলা মোকাবিলার ধারণাটি জোরালো হয়। বিশ্লেষকদের মতে, এর শর্ত অত্যন্ত কঠিন। হুমকিটিকে অবশ্যই 'আসন্ন ও অবশ্যম্ভাবী' হতে হবে। অর্থাৎ, হামলা ঠেকাতে পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য সেটিই 'শেষ সুযোগ' হতে হবে।

২০০৫ সালে তৎকালীন জাতিসংঘ মহাসচিব কফি আনান এর একটি রূপরেখা দেন। তিনি বলেন, যদি কোনো হামলা আসন্ন হয়, অন্য কোনো উপায়ে তা ঠেকানো সম্ভব না হয় এবং গৃহীত পদক্ষেপটি যদি আনুপাতিক হয়, তবেই তা ৫১ অনুচ্ছেদের অধীনে আত্মরক্ষা হিসেবে গণ্য হবে।

'নিবারণমূলক' হামলার বিতর্ক

২০০২ সালে যুক্তরাষ্ট্র তাদের জাতীয় নিরাপত্তা কৌশলে 'প্রি-এম্পটিভ ডকট্রিন' বা 'আগাম নিবারণমূলক হামলা'র ধারণা নিয়ে আসে। তাদের যুক্তি ছিল, সন্ত্রাসবাদ ও গণবিধ্বংসী অস্ত্রের মতো নতুন হুমকি মোকাবিলায় হামলা হওয়ার আগেই শক্তি প্রয়োগ করা বৈধ।

কফি আনানসহ বহু বিশেষজ্ঞ এর বিরোধিতা করেন। তারা সতর্ক করে বলেন, এই ধারণা গৃহীত হলে তা শক্তি প্রয়োগের ওপর নিষেধাজ্ঞাকে দুর্বল করে দেবে। এর ফলে রাষ্ট্রগুলো অনুমাননির্ভর গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে একতরফা হামলা চালানোর লাইসেন্স পেয়ে যাবে।

আনান পরিষ্কারভাবে বলেন, যদি নিবারণমূলক হামলার পক্ষে যথেষ্ট যুক্তি ও প্রমাণ থাকে, তবে তা নিরাপত্তা পরিষদে উপস্থাপন করা উচিত। পরিষদ চাইলে অনুমোদন দিতে পারে। আর যদি অনুমোদন না দেয়, তার মানে হলো আলোচনা, দর-কষাকষি বা চাপ প্রয়োগের মতো বিকল্প পথ খোলা আছে। ইসরায়েল ইরানে হামলা চালানোর আগে ঠিক এই কাজটিই করেনি।

ইতিহাসের শিক্ষা ও বাস্তবতা

ইসরায়েলের ঘোষিত লক্ষ্য, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি ধ্বংস করা, যাতে দেশটি পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে না পারে। অর্থাৎ, এটি এমন একটি অস্ত্র দিয়ে ভবিষ্যতের কাল্পনিক হামলা ঠেকানোর চেষ্টা, যে অস্ত্র ইরানের কাছে এখনো নেই।

অতীতেও ইসরায়েল আত্মরক্ষার এমন বিস্তৃত ব্যাখ্যা দিয়েছে। ১৯৮১ সালে তারা বাগদাদের কাছে ইরাকের ওসিরাক পারমাণবিক চুল্লিতে বোমা হামলা চালায়। তখনও তাদের যুক্তি ছিল, পারমাণবিক শক্তিধর ইরাক একটি বড় হুমকি। নিরাপত্তা পরিষদ সেই হামলার নিন্দা জানিয়েছিল।

আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, কোনো সশস্ত্র হামলা যদি আসন্ন ও অবশ্যম্ভাবী না হয়, তবে এ ধরনের অভিযানকে অবৈধ শক্তি প্রয়োগ হিসেবেই গণ্য করা হয়। যেহেতু হুমকি মোকাবিলায় শক্তি প্রয়োগ ছাড়া অন্য পথ (যেমন—কূটনৈতিক আলোচনা, নিষেধাজ্ঞা, আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার নজরদারি) খোলা আছে, সেহেতু আত্মরক্ষার নামে এখনই সামরিক অভিযান চালানোর কোনো বৈধতা নেই।

Comments

The Daily Star  | English

BNP struggles to rein in the rogues

Over the past 11 months, 349 incidents of political violence took place across the country, BNP and its affiliated organisations were linked to 323 of these

8h ago