বিপন্ন প্রাণকে আরও বিপন্ন করে তুলছে অনিরাপদ বৈদ্যুতিক লাইন

সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ভেতর দিয়ে যাওয়া উন্মুক্ত বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইনে লজ্জাবতী বানর। ছবি: স্টার

মৌলভীবাজারের জুড়ি ও বড়লেখা রেঞ্জের সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ভেতর দিয়ে যাওয়া উন্মুক্ত বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইনের কারণে বিপন্ন প্রজাতির লজ্জাবতী বানর ও চশমা পরা হনুমানের মৃত্যু পরিবেশবিদদের মধ্যে গভীর উদ্বেগ তৈরি করেছে।

২০২৪ সালের মে মাস থেকে এ পর্যন্ত বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে অন্তত ১০টি বিপন্ন প্রজাতির বানরের মৃত্যু হয়েছে; যার মধ্যে সাতটি লজ্জাবতী বানর ও তিনটি চশমা পরা হনুমান আছে।

সর্বশেষ ২০২৫ সালের ১২ মে মাধবকুণ্ড ইকোপার্কের প্রধান ফটকের কাছে একটি প্রাপ্তবয়স্ক লজ্জাবতী বানরের  মৃতদেহ পাওয়া যায়। এর আগে একই এলাকায় ৩১ মার্চ ও ২৬ এপ্রিল একই ধরনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটে।

বন বিভাগের দেওয়া তথ্য অনুসারে, মাধবকুণ্ড ইকো পার্কের প্রধান ফটক সংলগ্ন প্রায় আধা কিলোমিটার সড়কের একটি অংশ বিপন্ন বানরদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ আবাসস্থল।

বিষয়টি নিয়ে পরিবেশবিদ আবিদ হোসেন বলেন, 'এই ধারা অব্যাহত থাকলে লাঠিটিলা ও মাধবকুণ্ডের বনাঞ্চল থেকে বন্যপ্রাণী বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে। এ এলাকার জীববৈচিত্র্য এখন মারাত্মক হুমকির মুখে।'

আবিদ হোসেন জানান, ২০২৩ সালে বন বিভাগ মৌলভীবাজার পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির বড়লেখা জোনাল অফিসে আনুষ্ঠানিকভাবে একটি চিঠি দেয়, যেখানে বনাঞ্চলের মধ্য দিয়ে যাওয়া বিদ্যুৎ লাইন ঢেকে দেওয়ার ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়। কিন্তু এ ব্যাপারে এখন পর্যন্ত কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

লজ্জাবতী বানর নিয়ে গবেষণা ও সংরক্ষণ প্রকল্পের প্রধান গবেষক সাবিত হাসান জানান, এই প্রজাতির বানর কমে আসার পেছনে অনেকগুলো কারণ আছে। যেমন—নির্বিচারে বন উজাড়, পাচার, শিকার এবং বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হওয়া।

সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ভেতর দিয়ে যাওয়া উন্মুক্ত বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন। ছবি: স্টার

সাবিত বলেন, সড়কের ধার ঘেঁষে থাকা গাছের ছাউনি অপসারণের কারণেও ঝুঁকি বাড়ছে। তার পরামর্শ, এই বিপন্ন বানরদের রক্ষা করার জন্য বনের ভেতর দিয়ে যাওয়া বৈদ্যুতিক তারগুলো রাবারের মতো বিদ্যুৎ অপরিবাহী উপকরণ দিয়ে মুড়িয়ে দিতে হবে। রাস্তার পাশের গাছগুলোর ভেতর ছাউনি-সংযোগ সংরক্ষণ করতে হবে। এছাড়া আঠা হয় এমন গাছ লাগানোর ওপর জোর দিতে হবে, যা লজ্জাবতী বানরের খাদ্যের গুরুত্বপূর্ণ উৎস।

সিলেটের বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা ডঃ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, স্থানীয় বন অফিসকে সর্বশেষ ঘটনা সম্পর্কে আনুষ্ঠানিকভাবে অবহিত করা হয়নি। তবে, আমি বেশ কয়েকবার বিদ্যুৎ বিভাগ-কে চিঠি লিখে খোলা তারগুলিকে অন্তরক করার জন্য অনুরোধ করেছি। তারা পর্যায়ক্রমে এটি করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। আমি আবার তাদের সাথে যোগাযোগ করব। আমরা আর বন্যপ্রাণীর মৃত্যু দেখতে চাই না।

বিষয়টি নিয়ে কথা হয় সিলেটের বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলমের সঙ্গে। তার ভাষ্য, সর্বশেষ ঘটনার বিষয়ে স্থানীয় বন অফিসকে আনুষ্ঠানিকভাবে অবহিত করা হয়নি।

জাহাঙ্গীর আলম বলেন, 'আমি পল্লী বিদ্যুৎ সমিতিকে একাধিকবার উন্মুক্ত তার নিরাপদ করার অনুরোধ জানিয়েছি। তারা ধাপে ধাপে কাজ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। আমি আবারও তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করব। আমরা আর কোনো বন্যপ্রাণীর মৃত্যু দেখতে চাই না।'

পাথারিয়া বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ দলের মুখপাত্র খুরশেদ আলমের পর্যবেক্ষণ, 'সংরক্ষিত বনাঞ্চলে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে লজ্জাবতী বানর ও চশমা বানরের সাম্প্রতিক মৃত্যু কেবল দুঃখজনক নয়, এটি বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও অবকাঠামো পরিকল্পনায় পদ্ধতিগত ব্যর্থতার ইঙ্গিত দেয়।'

খুরশেদ আলম আরও বলেন, 'বিদ্যুৎ অবকাঠামোকে প্রকৃতির সঙ্গে দায়িত্বশীলভাবে সহাবস্থান করতে হবে। বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল উন্নয়নের জন্য গৌণ নয়; এটি আমাদের জাতির পরিবেশগত ভারসাম্য ও জীববৈচিত্র্যের জন্য অপরিহার্য। যদি দ্রুত ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, তাহলে আমরা শিগগিরই আমাদের বনাঞ্চলে একসময় সমৃদ্ধ ছিল এমন প্রজাতিগুলোর অপূরণীয় ক্ষতির সাক্ষী হতে পারি।'

মৌলভীবাজার পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির মহাব্যবস্থাপক বন বিভাগের চিঠি পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, 'মানুষকে বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে হবে। বন্যপ্রাণীকেও সংরক্ষণ করতে হবে। আমরা বিষয়টি তদন্ত করছি এবং ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি। এ বিষয়ে সমীক্ষা শেষে নিরোধক বৈদ্যুতিক তারের ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'

Comments

The Daily Star  | English
Bangladesh energy import from Nepal

Nepal to export 40 MW power to Bangladesh via Indian grid from today

Bangladesh has agreed to import electricity from Nepal for the next five years

1h ago