বিক্রমপুরের ঐতিহ্যবাহী ‘কাজির ভাত’

ছবি: নিবিড় সাফওয়ান

'কাজি' শব্দটি আসলে 'কাঁজি'র অপভ্রংশ, যার উৎস খুঁজলে মেলে তৎসম বা সংস্কৃত শব্দ 'কাঞ্জি'। ১৯৭৩ সালে জনার্দন চক্রবর্তীর সম্পাদনায় প্রকাশিত আচার্য্য রাধাগোবিন্দ নাথ স্মারকগ্রন্থে 'কাঁজির বড়া'র উল্লেখ পাওয়া যায়। কাঁজি প্রসঙ্গে সেখানে বলা হয়েছে, 'কাঁজি বা কাঞ্জি শব্দটি প্রাচীন বাংলায় পরিচিত, অর্থ পর্যুষিত অন্নের অম্লজল বা আমানী। চণ্ডীমঙ্গল কাব্যেও ব্যবহৃত হয়েছে এই শব্দ—পাঁচমাসে কাঁজি করঞ্জায় খায় মন।'

এই শব্দটির উৎস যাত্রা যথেষ্ট কৌতূহলোদ্দীপক। মনে করা হয়, এটি দক্ষিণ-ভারত থেকে ওড়িশার মধ্য দিয়ে বাংলায় এসেছে। তামিলে 'কঞ্জি' নামে একটি শব্দ আছে, যার অর্থ 'ভাতের ফেন'।

মধ্যযুগীয় চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে 'কাঁজি'র ব্যবহারের আরও নিদর্শন পাওয়া যায়। ধর্মকেতুর পত্নী এবং কালকেতুর মাতা 'নিদয়া' তার গর্ভাবস্থায় স্বামীর কাছে নানান ব্যঞ্জনের সাধ প্রকাশ করেন। সেখানে এক জায়গায় বলা হয়েছে—

'হরিদ্রা রঞ্জিত কাঞ্জি উদর পুরিয়া ভুঞ্জি

প্রাণ পাই পাইলে পাকা তাল।'

লোককথা ও প্রবাদেও এই 'কাঁজি' জায়গা করে নিয়েছে। যেমন: 'গোয়ালা হইয়াও দুধ খাইতে পায় না, কাঁজি খায়।'

'কাজির ভাত' কী?

বাংলা একাডেমি পত্রিকার (ভলিউম ৪৮, পৃষ্ঠা ৪৬) তথ্যানুযায়ী, পদ্মার চরাঞ্চলে 'কাজির ভাত' এক জনপ্রিয় খাবার। এটি মূলত একধরনের গাঁজানো ভাত। পানিভরা মাটির হাঁড়িতে দীর্ঘসময় ভিজিয়ে রাখা চাল থেকে এটি রান্না করা হয়। ভাতের সঙ্গে পরিবেশন করা হয় বিভিন্ন অনুপান ও উপকরণ। যেমন: মেথি, কালজিরা, শুঁটকি মাছ। মেথি ও কালজিরা শুকনো খোলায় ভেজে, বেটে ভাতের সঙ্গে মেশানো হয়।

'কাজির ভাত' বিক্রমপুরের নিজস্ব ঐতিহ্য হলেও নারায়ণগঞ্জ, ফরিদপুর, মাদারীপুর ও শরীয়তপুর জেলার বহু মানুষও এই 'কাজির ভাত' খান।

প্রস্তুত প্রণালী ও সংরক্ষণ পদ্ধতি

এই ভাত রান্নার একাধিক পদ্ধতি রয়েছে। সবচেয়ে প্রচলিত ও সহজ পদ্ধতিটি হলো, মানুষ অনুপাতে নির্দিষ্ট পরিমাণ চাল একটি মাটির হাঁড়িতে পানির সঙ্গে ছয়-সাত দিনের জন্য ভিজিয়ে রাখা। হাঁড়িটি এমনভাবে চুলার পাশে রাখতে হয়, যাতে আগুনের হালকা আঁচ মাটির হাঁড়িতে পৌঁছায়। নির্ধারিত সময় পর সেই চাল রান্না করা হয়। অনেকে রান্নার সময় ভাতের মাড় ফেলে দেন, আবার কেউ মাড়সহই রান্না করেন—যাতে ভাতের মাঝে মাড় মিশে থাকে। মাড় ফেলে দিলে ভাতের টক স্বাদ কিছুটা কমে যায়। পুষ্টিবিদদের মতে, ভাতের মাড় না ফেলে খাওয়াই স্বাস্থ্যকর ও পুষ্টিকর।

আরেকটি পদ্ধতিও বেশ জনপ্রিয়। প্রতিদিন ভাত রান্নার সময় ধোয়া চাল থেকে কিছু পরিমাণ নিয়ে একটি মাটির হাঁড়িতে জমিয়ে রাখা হয়। প্রতিবার এভাবে রাখলে সাতদিন বা তার কম সময়ের মধ্যেই রান্নার উপযোগী হয়ে ওঠে সেই চাল। দীর্ঘক্ষণ মাটির হাঁড়িতে থাকার ফলে চাল খানিকটা ফুলে ওঠে ও টক স্বাদ ধারণ করে। এতে খাবারে এক বিশেষ ঘ্রাণ ও স্বাদ যুক্ত হয়।

তবে বিশেষজ্ঞ রাঁধুনিদের মতে, সাত দিনের বেশি সময় চাল মাটির হাঁড়িতে রাখা অনুচিত। এতে ভাত খাওয়ার অনুপযোগী হয়ে উঠতে পারে।

অনেকে শুধু গাঁজানো চাল দিয়েই ভাত রাঁধেন, আবার কেউ কেউ টাটকা চালের সঙ্গে তা মিশিয়ে রান্না করেন। মাটির হাঁড়িতে জমে থাকা পানিটুকু কেউ ফেলে দেন, কেউ তা ভাতের সঙ্গে মিশিয়ে নেন। স্বাদের পার্থক্য এই পানির ব্যবহারেও স্পষ্ট হয়। পুষ্টিবিদদের মতে—এই জমা পানিটুকু ফেলে না দেওয়াই শ্রেয়।

পরিবেশন ও খাওয়ার রীতি

'কাজির ভাত' সাধারণত নানা প্রকার ভর্তার সঙ্গে পরিবেশিত হয়। এসব ভর্তার মধ্যে রয়েছে- কাঁচামরিচ, ধনেপাতা, চ্যাঁপাশুঁটকি, ধুন্দল, কালিজিরা, বেগুন, বরবটি, ডাল, কচু, শিম, পটল, চিংড়ি, আলু, কাঁকরোল, লাউশাক, বাঁটামরিচ, তিল ও সরিষা ভর্তা।

মূলত ভর্তা দিয়েই এই ভাত পরিবেশন করা হয়। তবে বর্তমান সময়ে এর সঙ্গে যোগ হয়েছে ভাজা ইলিশ, পুঁটি বা দেশি কই। এই ভাত তৈরিতে সময় ও যত্ন প্রয়োজন হয় বলে শীতকালে অনেকেই তা প্রস্তুত করতে অনাগ্রহ দেখান। কারণ, শীতে চাল কাঙ্খিতভাবে ফুলে উঠতে ও টক হতে দ্বিগুণ সময় নেয়। তুলনায় গ্রীষ্ম বা বর্ষায় তা সহজেই হয়।

খাওয়ার রীতিতেও রয়েছে মজার বৈচিত্র্য। অনেকে সব ভর্তা একসঙ্গে মিশিয়ে খেয়ে থাকেন, আবার অনেকে আলাদা আলাদা করে প্রতিটি ভর্তার স্বাদ উপভোগ করেন। তবে এই ভাত একা খাওয়ার আনন্দ নেই বললেই চলে। পরিবার-পরিজন সবাই মিলে একত্রে খাওয়ার মাঝেই লুকিয়ে রয়েছে এর আসল মাধুর্য।

যান্ত্রিক এই সময়ে ধৈর্য ও যত্নশীল রান্নার পরিমাণ কমে গেলেও 'কাজির ভাত' আজও বিক্রমপুরবাসীর খাদ্য-সংস্কৃতির এক গর্বিত প্রতীক। স্বাদ, ঘ্রাণ আর পারিবারিক আবহ—সব মিলিয়ে এই ভাত একবার যিনি খেয়েছেন, তিনি বারবার খেতে চান।

Comments

The Daily Star  | English

US retailers lean on suppliers to absorb tariffs

Rather than absorbing the cost or immediately passing it on to consumers, many US apparel retailers and brands have turned to their suppliers in Bangladesh, demanding they share the pain

4h ago