সিন্ডিকেট করে শত শত কোটি টাকার জ্বালানি তেল চুরি

প্রতীকী ছবি

দেশের জ্বালানি খাতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র চট্টগ্রামের পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা অয়েল ডিপোতে সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেটের মাধ্যমে তেল চুরির ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে।

জাহাজের নাবিক ও ডিপোর অন্যান্য কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় গায়েব হয়ে যাচ্ছে শত শত কোটি টাকার তেল।

সম্প্রতি গোয়েন্দা সংস্থার বিশেষ প্রতিবেদনে তেল চুরির ভয়াবহ চিত্র উঠে আসার পর কর্ণফুলী নদী এবং বঙ্গোপসাগরে নিয়মিত অভিযান পরিচালনার জন্য কোস্টগার্ডের সহযোগিতা চেয়েছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন।

বিপিসির একাধিক কর্মকর্তা দ্য ডেইলি স্টারকে জানিয়েছেন, দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ গোয়েন্দা সংস্থা গত ৬ মে তেল চুরি সংক্রান্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন।

তাতে পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা অয়েল ডিপো থেকে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে তেল চুরির ভয়াবহ চিত্র সামনে এসেছে। এরপর তেল চুরি রোধে গত শনিবার বিপিসি পরিচালক (অপারেশন ও পরিকল্পনা) ড. এ কে এম আজাদুর রহমান চিঠি দিয়ে কোস্টগার্ডের সহযোগিতা কামনা করেন।

আজাদুর রহমান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'চুরির বিষয়টি উদ্বেগজনক। আমরা ডিপোগুলোকে অটোমেশনের আওতায় নিয়ে আসার কাজ শুরু করেছি। পাশাপাশি অভিযান পরিচালনায় কোস্টগার্ডের সহযোগিতা চেয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে।'

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বিভিন্ন পর্যায়ে জ্বালানি তেল চুরি ও দুর্নীতির মাধ্যমে প্রতি বছর সরকার শত শত কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে।

বহিঃনোঙ্গর থেকে খুচরা বাজার—তেল চুরির বিস্তৃত নেটওয়ার্ক

আমদানি করা জ্বালানি তেল প্রথমে চট্টগ্রাম বন্দরের বহিঃনোঙ্গরে অবস্থানরত মাদার ভেসেল থেকে লাইটার জাহাজের মাধ্যমে ডিপোগুলোতে আনা হয়। এরপর ডিপো থেকে সড়ক, রেল ও নদীপথে ট্যাংকার, ট্যাংক লরি ও রেল ওয়াগনের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পাঠানো হয়।

প্রতিবেদন অনুসারে, এই পুরো প্রক্রিয়ায় নানা স্তরে তেল চুরি হয়। যার পেছনে রয়েছেন তেল বিপণন কোম্পানিগুলোর কিছু অসাধু কর্মকর্তা, স্থানীয় সিন্ডিকেট, জাহাজের নাবিক ও অন্যান্য সহযোগীরা।

তেল পরিবহনের ব্যবহৃত ২০০ লিটারের প্রতিটি ড্রামে নির্ধারিত পরিমাণের চেয়ে গড়ে ১৫ থেকে ২০ লিটার করে অতিরিক্ত তেল ভরে দেওয়া হয়। যা পরবর্তীতে কালোবাজারে চলে যায়, উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে।

কর্ণফুলী নদী হয়ে উঠেছে চুরির রুট

চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীতে দেশি-বিদেশি জাহাজ নিয়মিত পণ্য খালাস করে। সন্ধ্যার পর চোরাই তেল পাচারের অন্যতম রুট হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে এই নদী পথ।

জাহাজে কর্মরত নাবিক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য 'জরুরি মালামাল পৌঁছে দেওয়ার' অজুহাতে মাঝিরা নৌকায় করে তেল সংগ্রহ করেন। এই তেল চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ, স্থানীয় পেট্রোল পাম্প, খোলা বাজার ও ইঞ্জিনচালিত নৌযান চালকদের কাছে বিক্রি হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে লাইটার জাহাজেও অবৈধভাবে বাংকারিং করা হয়।

রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন তেল পরিবহনকারী প্রতিষ্ঠান—পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা অয়েল লিমিটেডের নিজস্ব জাহাজ ব্যবহার করেও চুরি চলছে বলে প্রতিবেদনে অভিযোগ আনা হয়েছে।

সূত্র জানিয়েছে, চুরির সঙ্গে কারা জড়িত তা গোয়েন্দা সংস্থার বিশ্লেষণে স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে।

চুরি ও দুর্নীতির লাগাম টানতে প্রতিবেদনে একাধিক সুপারিশ করেছে গোয়েন্দা সংস্থা।

যার মধ্যে রয়েছে—তেল কোম্পানিগুলোকে দ্রুত অটোমেশন ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কঠোর জবাবদিহিতার আওতায় আনা; তেলবাহী ট্যাংক লরিতে জিপিএস ট্র্যাকিং সিস্টেম ও ডিজিটাল লক স্থাপন; তেল লোড ও আনলোডের সব স্থান সিসিটিভির আওতায় আনা এবং তেল পরিমাপে নিয়োজিত সার্ভেয়ার কোম্পানি, জাহাজ মাস্টার, নাবিকদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত ও একটি স্বতন্ত্র 'ইনস্পেকশন কমিটি' গঠন করে সরবরাহ পদ্ধতি তদারকি করা।

এছাড়া, 'ট্রানজিট লস' বা 'অপারেশন লস' এর যৌক্তিক হার নির্ধারণ এবং অভ্যন্তরীণ মনিটরিং কমিটির মাধ্যমে প্রকৃত মজুত যাচাই, চট্টগ্রাম-ঢাকা পাইপলাইন প্রকল্প, সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং (এসপিএম) প্রকল্প ও মূল ডিপোর অটোমেশন প্রকল্প দ্রুত বাস্তবায়নের সুপারিশ এসেছে প্রতিবেদনে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিপিসির একাধিক কর্মকর্তা ডেইলি স্টারকে বলেন, এই খাতের ভয়াবহ অনিয়ম ও দুর্নীতির রাশ টানতে কঠোর পদক্ষেপ প্রয়োজন। তা না হলে দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক কাঠামো মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

Comments

The Daily Star  | English

Debates over leasing NCT to foreign operator intensifying

The debate over whether to lease out the New Mooring Container Terminal (NCT) at Chittagong Port to a foreign operator is intensifying, with political parties, including the BNP, Jamaat-e-Islami, and left-leaning groups, uniting in opposition.

9h ago