রবীন্দ্রনাথের ‘ন্যাশনালিজম’ বক্তৃতার কী প্রতিক্রিয়া হয়েছিল আমেরিকায়

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কেবলমাত্র একজন কবি ছিলেন না, তিনি মানবতাবাদী ও চিন্তাবিদ, যার দৃষ্টিভঙ্গি জাতীয়তাবাদ ও আধুনিক সমাজের সংকীর্ণতাকে অতিক্রম করে এক বৈশ্বিক মানবতার ধারণা প্রতিষ্ঠা করেছিল। ১৯১৬-১৭ সালে আমেরিকা সফরে রবীন্দ্রনাথ তার ন্যাশনালিজম বক্তৃতার মাধ্যমে জাতীয়তাবাদের সীমাবদ্ধতা ও এর যান্ত্রিক প্রভাব নিয়ে তীব্র সমালোচনা করেন।
এই বক্তৃতা শুধু একটি নির্দিষ্ট সময় বা ঘটনার প্রেক্ষাপটে সীমাবদ্ধ ছিল না; বরং তা আধুনিক রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থার প্রতি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন। কবি জাতীয়তাবাদকে এমন একটি প্রক্রিয়া হিসেবে দেখেছিলেন, যা মানুষের সৃজনশীলতা ও মানবিকতাকে দমন করে। তাঁর এই চিন্তা আমেরিকার রাজনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতার সঙ্গে তখনকার সময়ে খাপ খায়নি, কিন্তু তাঁর বক্তব্য পশ্চিমা সমাজে গভীর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল—কখনো প্রশংসা, কখনো সমালোচনা।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমেরিকা ভ্রমণে আসেন ৫ বার। এর মধ্যে ১৯১৬ ও ১৯১৭ সালে প্রথমে জাপান এবং পরে আমেরিকায় আসেন। ১৯১৬ সালের ৭ সেপ্টেম্বর রবীন্দ্রনাথ জাপান থেকে আমেরিকা যাত্রা করেন। ১৮ সেপ্টেম্বর জাহাজ আমেরিকার সিয়াটলে পৌছায়। এই সময়ের আমেরিকায় ভ্রমণটি ছিল উচ্চাকাঙ্ক্ষী। আমেরিকা এবং জাপান উভয় দেশেই তিনি জাতীয়তাবাদের উপর প্রভাবশালী এবং বিতর্কিত বক্তৃতা দিয়েছিলেন যা পণ্ডিত এবং জীবনীকারদের মধ্যে আজও বিতর্কিত।
একটি বক্তৃতার আয়োজন করেন 'পন্ড লীসিয়াম ব্যুরো'। এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের ৪০টি বক্তৃতা চুক্তি হয়। প্রতিটি বক্তৃতার জন্য কবি ৫০০ ডলার। মূলত শান্তিনিকেতনের জন্য অর্থ সংগ্রহ। এই সফরে তিনি নিউ ইয়র্ক, সান ফ্রান্সিসকো, লস অ্যাঞ্জেলস, ডেনভার এবং শিকাগোসহ ২৫টিরও বেশি আমেরিকান শহরে বক্তব্য রাখেন। এসব শহরে, শতাধিক মানুষের সমাবেশে দেওয়া বক্তৃতাগুলিতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মার্কিন শিল্পায়ন সম্পর্কে তাঁর গভীর সংশয় প্রকাশ করেন এবং মানুষের প্রতি যান্ত্রিক ও উপযোগবাদী মনোভাবকে প্রত্যাখ্যান করেন, যা তিনি আমেরিকান আধুনিকতায় শেকড় গাড়তে দেখেছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ আশঙ্কা করেছিলেন যে আধুনিক পশ্চিমা বিশ্বে, বিশেষত যুক্তরাষ্ট্রে, মানবজীবনকে কেবলমাত্র তার ব্যবহারযোগ্যতার দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হচ্ছে—ব্যবসায়িক স্বার্থে, সামরিক বাহিনীর মাধ্যমে ধ্বংসাত্মক কাজে, এবং রাষ্ট্রের প্রশাসনিক ব্যবস্থায় ব্যবহার করা হচ্ছে। তার মতে, মানবজীবনের এই ধরনের উপযোগবাদী শোষণকে তিনি জাতি বলে অভিহিত করেছিলেন, যা তিনি সংজ্ঞায়িত করেন এইভাবে: "যখন কোনো জনগোষ্ঠী যান্ত্রিক উদ্দেশ্যে সংগঠিত হয়, তখন তা জাতির রূপ পায়।"
এই যান্ত্রিক জাতি ধারণার বিপরীতে যুক্তি দিয়েছিলেন যে, মানবসমাজকে একটি জৈবিক ও গতিশীল সংস্কৃতি হিসেবে দেখতে হবে। তার মতে, "সমাজের নিজস্ব কোনো গূঢ় উদ্দেশ্য নেই। এটি নিজেই একটি লক্ষ্য। একজন সামাজিক মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত আত্মপ্রকাশ" (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ন্যাশানিলিজম, ১৯১৭, পাবলিশার ম্যাকমিলন এন্ড কো)। জাতীয়তাবাদ বিষয়ক বক্তৃতা মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল। আমেরিকার সাধারণ জনগণ এবং সংবাদমাধ্যম তাঁর এই দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে ভিন্নমত ছিল।
অনেকেই তাঁর বক্তৃতায় উঠে আসা বৈশ্বিক মানবতার ধারণা ও জাতীয়তাবাদের সমালোচনা পছন্দ করেনি, বিশেষত প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জাতীয়তাবাদ বিরোধী অবস্থানকে অনেকে তৎকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতির বিরোধী মনে করে নেতিবাচক ভাবে দেখেছিলেন। বিশেষত তিনি যখন বলেছিলেন যে অন্ধ দেশপ্রেম মানবতার ক্ষতি করে, তখন কিছু সংবাদমাধ্যম তাঁকে আদর্শহীন বলে সমালোচনা করে।
তবে একইসঙ্গে বুদ্ধিজীবী মহলে এবং কিছু সাহিত্যপ্রেমী আমেরিকানের মধ্যে তার চিন্তাভাবনা যথেষ্ট প্রশংসা করেছিলেন। তাঁরা ঠাকুরের বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং শান্তি, সহমর্মিতা ও মানবতার উপর জোর দেওয়ার প্রশংসা করেছিলেন। কিছু পত্রিকা তাঁর বক্তব্যকে সাহসী বলে অভিহিত করেছিল, কারণ তিনি এমন সময়ে যুদ্ধ ও জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে কথা বলছিলেন, যখন অধিকাংশ মানুষ উল্টো দিকে অবস্থান করছিল।
সামগ্রিকভাবে, ঠাকুরের বক্তৃতা আমেরিকায় নতুন ভাবনার খোরাক যুগিয়েছিল, যদিও তা তৎকালীন রাজনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতার সঙ্গে পুরোপুরি খাপ খায়নি। যখন ঠাকুর তাঁর সফর শুরু করেন, তখনো যুক্তরাষ্ট্র প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যোগ দেয়নি। সেই সময়ে উড্রো উইলসন সেই যুদ্ধে হস্তক্ষেপ না করার নীতিতে ভিত্তি করে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছিলেন। ঠাকুর আসন্ন যুদ্ধের সম্ভাবনা সম্পর্কে সচেতন ছিলেন—এবং তার সমালোচনার লক্ষ্যগুলির মধ্যে স্পষ্টতই যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য ইউরোপীয় ধ্বংসযজ্ঞে যোগ দেওয়ার শঙ্কা ছিল।
একজন নোবেল বিজয়ী এবং বিশ্বজোড়া সাহিত্যিক তারকা তবুও যদিও স্বীকার করতে হয় যে আমেরিকায় তখন পুঁজিবাদের যে আদর্শ ও চর্চা চলছিল, রবীন্দ্রনাথের বক্তৃতাগুলি এবং সমালোচনা সেখানে তেমন প্রভাব ফেলতে পারেননি। কিছু আমেরিকান সাংবাদিক এবং সংবাদপত্র রবীন্দ্রনাথের বক্তব্য নিয়ে খানিকটা ব্যঙ্গ করেছিলেন।
এই সফরে কবি বেশ বড়সড় পারিশ্রমিক পেয়েছিলেন। বস্তুবাদের সমালোচনা করার জন্যই এমন মোটা অঙ্কের পারিশ্রমিক পাওয়ার মধ্যে একটি নিঃসন্দেহ পরিহাস ছিল, যা মিনিয়াপোলিস ট্রিবিউন উল্লেখ করতেও দ্বিধা করেনি। সফরের মাঝামাঝি সময়ে মিনিয়াপোলিস ট্রিবিউন ঠাকুরকে "ভারত থেকে আসা সেরা ব্যবসায়ী" বলে আখ্যা দেয়: তিনি আমেরিকানদের প্রতিটি তিরস্কারের জন্য $৭০০ করে এবং প্রতিবার আবেদন (বিশ্বভারতীর জন্য অর্থ সংগ্রহের) করার জন্য $৭০০ করে পেয়েছিলেন। (দত্ত এবং রবিনসন ১৯৯৫: ২০৪)

১৭ অক্টোবর আমেরিকার লস এঞ্জেলস এক্সপ্রেস কবিকে খুব কড়া ভাষায় সমালোচনা করে লিখে, "যাই হোক অর্থ রোজগার হিসাবেও আমেরিকানদের প্রয়োজন আছে দেখিতেছি। ঠাকুর মহাশয় তাহাদিগকে তাহাদের ধনের জন্য সমালোচনা করিয়াছেন--কিন্তু সেখানে আসিয়াছেন তো তাহাদের উপার্জিত ধনের কিছু অংশ গ্রহণ করিতে... ধন খুবই হীন পদার্থ, ধনোপার্জন বৃত্তি অত্যন্ত গর্হিত ... কিন্তু আমাদের এই সান্ত্বনা যে আমাদের তুচ্ছধন--যাহা তিনি একই ঘৃণা করেন তাহাই তাঁহাকে এতদূর টানিয়া আনিয়াছে। তিনি যাহা নিন্দা করেন, তাহাই পাইবার জন্য আসিয়াছেন, এবং এখানে আসিয়া সেই কাজই নিজে করিতেছেন, যার জন্য এত নিন্দাবাদ। [রবীন্দ্রজীবনী: ২য় খণ্ড]
স্টার লেক ট্রিবিউন পত্রিকাও কড়া সমালোচনা করে লিখে"...স্যার রবীন্দ্রনাথ আমাদের ধর্ম সম্বন্ধে কেবল দোষ দেখেন নাই, আমাদের রাজনীতি সম্বন্ধেও দোষ দেখিয়াছেন। কিন্তু এইসব কথার আলোচনায় পৃথিবীর বড়ো বড়ো সমস্যার প্রশ্ন উঠিবে, রবীন্দ্রনাথের ন্যায় দার্শনিকেরই এইসব আলোচনার সময় ও অবসর আছে।" [রবীন্দ্রজীবনী: ২য় খণ্ড]
এইসব কারণে কবির মন ক্রমেই আমেরিকার প্রতি বিরূপ হয়ে উঠছিল। কিন্তু পণ্ড কোম্পানির সাথে চুক্তিবদ্ধ থাকায় তিনি আরও বেশ কিছুদিন বক্তৃতা দিয়েছিলেন। যদিও শেষের দিকে সহসাই আর বক্তৃতা না দিয়া দেশে ফিরে আসতে মনস্থির করেন। কবি ২১ জানুয়ারি আমেরিকা থেকে জাপান যাত্রা করেন।
এই ন্যাশানিলিজম বিষয়ক বক্তৃতাগুলিতে প্রচুর শ্রোতার সমাগম হয়েছিল এবং তাদের আগ্রহের বিষয় ছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নির্দিষ্ট উপমার ব্যবহার, যার মাধ্যমে তিনি ব্যবসা, সরকার এবং সামরিক ক্ষেত্রে মানুষকে শোষণের (ইন্সট্রুমেন্টালিজমের) অনৈতিকতা তুলে ধরেছিলেন। একটি উপমা, যা তিনি প্রায়শই তার বক্তৃতায় ব্যবহার করেছেন, তা হলো এসেম্বলি লাইনের [একটি অ্যাসেম্বলি লাইন, একটি উৎপাদন প্রক্রিয়া যেখানে অসমাপ্ত পণ্যটি ওয়ার্কস্টেশন থেকে ওয়ার্কস্টেশনে সরাসরি লাইনে চলে যায়, চূড়ান্ত পণ্যটি সম্পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত অংশগুলি ক্রমানুসারে যোগ করা হয়।] অমানবিক, যান্ত্রিক প্রক্রিয়া। এই উপমার মাধ্যমে তিনি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে তাঁর ন্যাশানিলিজম গ্রন্থে যুক্তি পেশ করেছেন, যা নিম্নরূপ:
"এই মুহূর্তে একটি বিমূর্ত সত্তা, জাতি, ভারতকে শাসন করছে। আমাদের দেশে কিছু টিনজাত খাবারের বিজ্ঞাপনে বলা হয় যে সেগুলি সম্পূর্ণভাবে তৈরি ও প্যাক করা হয় মানুষের হাতের স্পর্শ না করেই। এই বর্ণনাটি ভারতের শাসন ব্যবস্থার জন্যও প্রযোজ্য, যেটি যতটা সম্ভব মানবিক স্পর্শ ছাড়াই পরিচালিত হয়। শাসকদের আমাদের ভাষা জানার প্রয়োজন নেই এবং আমাদের সঙ্গে ব্যক্তিগত যোগাযোগ রাখারও দরকার নেই, শুধুমাত্র সরকারি কর্তব্যের আওতায়; তারা দূরত্ব বজায় রেখে আমাদের আকাঙ্ক্ষাগুলোকে সাহায্য করতে পারে বা বাধা দিতে পারে। তারা নীতি অনুসরণে আমাদের একটি পথে নিয়ে যেতে পারে এবং পরে অফিসের লাল ফিতার বাঁধনে আমাদের টেনে আবার থামিয়ে দিতে পারে। ইংল্যান্ডের সংবাদপত্রগুলিতে, লন্ডনের রাস্তার দুর্ঘটনার বিবরণ সহানুভূতির সঙ্গে প্রকাশিত হয়, কিন্তু তারা ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে—যার আয়তন কখনও কখনও ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জের চেয়েও বড়— সেখানে ঘটা বিপর্যয়ের প্রতি সামান্যই নজর দেয়। (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ন্যাশানিলিজম, ১৯১৭, পাবলিশার ম্যাকমিলন এন্ড কো)
তখনকার সময়ে, এশিয়াবাসীদের আমেরিকায় প্রবেশাধিকার নিয়ে আমেরিকার সরকারের সমালোচনা করতে কবি ছাড়েন নাই। নিউ ইয়র্কে এক সাংবাদিক সম্মেলনে প্রসঙ্গ কথা উঠলে রবীন্দ্রনাথ বলেন, "এশিয়ানদের প্রতি আপনাদের আচরণ আপনাদের জাতীয় জীবনের অন্ধকার দিকগুলির মধ্যে একটি।" [Your treatment of Asiatics is one of the darkest sides of your national life] [রবীন্দ্রজীবনী: ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা: ৪৪১]
আমেরিকার নিগ্রো-বিদ্বেষ ও বর্ণ-বিদ্বেষের সমালোচনা করতেও কবি ছাড়েন নাই। আমেরিকার কয়েকটি পত্র-পত্রিকা রবীন্দ্রনাথের বিশ্বমানবতার প্রতি বিদ্রূপ করে লিখেছিল, 'ভারতের জাতিভেদ কি ভ্রাতৃ স্নেহের উপর প্রতিষ্ঠিত? 'Nationalism in India' নামক প্রবন্ধে কবি জবাব দিলেন: ..এই দেশে অনেক মানুষ আমাকে জিজ্ঞাসা করেন, ভারতে জাতিভেদ নিয়ে কি ঘটছে। কিন্তু যখন এই প্রশ্ন আমাকে করা হয়, সেটা সাধারণত একধরনের ঊর্ধ্বতন মানসিকতায় করা হয়। আর তখন আমার ইচ্ছে হয় আমাদের আমেরিকান সমালোচকদের উদ্দেশে একই প্রশ্ন সামান্য পরিবর্তন করে রাখার, 'আপনারা রেড ইন্ডিয়ান এবং নিগ্রোদের সাথে কি করেছেন? কারণ আপনি এখনও তাদের প্রতি আপনার জাতিভেদের মনোভাব কাটিয়ে উঠতে পারেননি। আপনি অন্যান্য জাতিগোষ্ঠী থেকে দূরে থাকার জন্য সহিংস পন্থা অবলম্বন করেছেন, কিন্তু এখানে আমেরিকাতে এই সমস্যার সমাধান না করা পর্যন্ত আপনারা ভারতের ব্যাপারে প্রশ্ন তোলার অধিকার রাখেন না।" [রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ন্যাশানিলিজম, ১৯১৭, পাবলিশার ম্যাকমিলন এন্ড কো: পৃষ্ঠা ৯৮)]
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই ভ্রমণকালীন অভিজ্ঞতা থেকে উপলব্ধি করেছিলেন যে, পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে ভারতের ভাবনার পার্থক্য গভীর। ভারত যেখানে আধ্যাত্মিকতা এবং মানবিকতার দিকে ঝোঁক প্রবণ, সেখানে পশ্চিম বেশি ঝুঁকেছে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি এবং শক্তি-রাজনীতির দিকে। যদিও তাঁর বক্তব্য অনেকের কাছে সমালোচিত হয়েছিল, তবুও রবীন্দ্রনাথ তাঁর বিশ্বাসে অটল ছিলেন। তিনি মনে করতেন যে, মানুষের মূল পরিচয় তার জাতি নয়, বরং সে মানুষ– এই বোধই তাকে প্রকৃত মুক্তি দিতে পারে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহসী বক্তৃতা মানবতাবাদী অবস্থানের পরিচায়ক। যদিও তাঁর এই বক্তব্য সেই সময় পশ্চিমা বিশ্বের রাজনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল না এবং সমালোচিত হয়েছিল, তবুও রবীন্দ্রনাথ ভবিষ্যৎ মানবসমাজের কল্যাণে এক গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দিয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর চিন্তা আজও প্রাসঙ্গিক, যখন বিশ্বজুড়ে সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদের পুনরুত্থান ঘটছে।
রবীন্দ্রনাথের মানবতার আহ্বান আমাদের শেখায়, বিভাজন নয়, বরং ঐক্যই মানব সভ্যতার প্রকৃত পরিচয়। রবীন্দ্রনাথের মতে, প্রকৃত জাতীয়তাবাদ হতে হবে মানবিক ও নৈতিকতাভিত্তিক। "ঘরে বাইরে" উপন্যাস ও তাঁর কবিতায় সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদের সমালোচনা ও মানবিক মূল্যবোধের গুরুত্ব ফুটে উঠেছে। তিনি বিশ্বাস করতেন, ব্যক্তির স্বাধীনতা ও সৃষ্টিশীলতা জাতীয় পরিচয়ের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ।
রবীন্দ্রনাথ বিশ্বকে এক বৃহৎ মানব পরিবার হিসেবে দেখতেন। তাঁর রচনায় বিশ্বভ্রাতৃত্বের ধারণা স্পষ্ট। বিশ্বভারতীর প্রতিষ্ঠাও ছিল বিশ্বজনীন শিক্ষার প্রয়াস। জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে 'নাইট' উপাধি প্রত্যাখ্যান ছিল তাঁর নৈতিক অবস্থানের স্পষ্ট প্রকাশ। রবীন্দ্রনাথের জাতীয়তাবাদ কোনো সংকীর্ণ গণ্ডিতে আবদ্ধ ছিল না; বরং তা ছিল উদার, মানবিক যা আজও প্রাসঙ্গিক।
Comments