ট্রাম্পের নতুন বন্ধু বুকেলে: রতনে রতন চেনে

হোয়াইট হাউসে এল সালভাদরের প্রেসিডেন্ট নায়িব বুকেলে পৌঁছালে তাকে স্বাগত জানান মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ছবি: এএফপি

সারা পৃথিবীতে ডানপন্থিদের নতুন আইকনে পরিণত হয়েছেন এল সালভাদরের প্রেসিডেন্ট নায়িব বুকেলে। গতকাল সোমবার হোয়াইট হাউসে রাজসিক অভ্যার্থনা পেয়েছেন ৪৩ বছর বয়সী এই নেতা।

এল সালভাদরের অপরাধী গ্যাংগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়ে প্রথম আলোচনায় আসেন নায়িব বুকেলে। মধ্য আমেরিকায় প্রশান্তপাড়ের ছোট্ট এই দেশটির জনসংখ্যা মাত্র ৬৩ লাখ। এর মধ্যে গত তিন বছরেই এক শতাংশের বেশি মানুষকে কারাগারে ভরেছেন তিনি, সংখ্যায় যা ৮৭ হাজারের বেশি। এই বিশাল সংখ্যক মানুষের জন্য অতিকায় একটি কারগারও তৈরি করেছেন তিনি। একে বলা হচ্ছে 'মেগা প্রিজন'। অবৈধ অভিবাসীদের তাড়াতে ট্রাম্পের প্রতিশ্রুতি পূরণে এই কারাগারের দ্বার খুলে দিয়েছেন বুকেলে। এর ফলে ট্রাম্পের 'গণবিতাড়ন' পরিকল্পনার একজন গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হয়ে উঠেছেন তিনি।

বুকেলের এই দমননীতি থেকে অনুপ্রেরণা পাচ্ছেন রিপাবলিকান দলের নেতারা। বিশেষ করে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ অনুচরদের মধ্যে বুকেলের ব্যাপক প্রভাব দেখা যাচ্ছে। ট্রাম্প বলেছেন, 'আমি তাকে (বুকেলে) অত্যন্ত সম্মান করি। আমি তাকে চিনি। অপরাধ দমনে তিনি খুবই কঠোর।'

ট্রাম্পের 'মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন' আন্দোলনের রূপকারদের অনেকেই মনে করেন, এল সালভাদরের নীতি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের অনেক কিছু শেখার আছে।

সাফল্য ও সমালোচনা

বুকেলে ২০১৯ সালে যখন ক্ষমতাগ্রহণ করেন এল সালভাদরকে তখন বিশ্বের অপরাধের রাজধানী বললেও অত্যুক্তি হতো না। ওই বছর প্রতি লাখ মানুষের মধ্যে দেশটিতে খুন হওয়ার হার ছিল ৩৮। সেই হিসাবে চট্টগ্রাম জেলার চেয়েও কম জনংখ্যার এই দেশে দৈনিক খুন হচ্ছিলেন প্রায় সাড়ে ছয় জন।

এর পরের বছরগুলোতে এল সালভাদরকে লাতিন আমেরিকার অন্যতম নিরাপদ দেশে পরিণত করেন তিনি। বুকেলের ভাষায়, সমাজকে পরিশুদ্ধ করতে অকল্পনীয় পদক্ষেপ নিতে হয়েছে তার সরকারকে।

তবে এই 'শান্তি' অর্জনের প্রক্রিয়া শান্তিপূর্ণ ছিল না। জনসংখ্যার অনুপাতে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি কারাবাসী মানুষ এখন এই দেশটিতেই। বিশাল সংখ্যক মানুষকে বন্দি রাখতে 'সেকোট' নামে বিশ্বের বৃহত্তম কারাগারও নির্মাণ করেছেন বুকেলে।

অপরাধ দমনে বুকেলে যেসব ব্যবস্থা নিয়েছেন তার কোনোটাই বিতর্কের ঊর্ধ্বে ছিল না। ২০২২ সাল থেকে জরুরি অবস্থার অধীনে দেশ শাসন করছেন তিনি। এর জন্য জনগণের সাংবিধানিক অধিকার সংকুচিত করা হয়েছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, এল সালভাদরে ক্ষমতার ভারসাম্যহীনতা, ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘন, নির্বিচারে আটক এবং বিরোধী দলগুলোকে দুর্বল করা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব এবং স্বাধীন গণমাধ্যমের ওপর আক্রমণের ঘটনা ঘটেছে। তবে অভিযোগ অস্বীকার করে প্রেসিডেন্টের প্রেস অফিসের দাবি, বুকেলে ক্ষমতায় আসার আগে গ্যাংগুলোই আইন মান্যকারী নাগরিকদের মানবাধিকার লঙ্ঘন করত। মানবাধিকার সংগঠনগুলোর ওপর একহাত নিয়ে বুকেলে প্রশ্ন তোলেন, খুনিদের অধিকার নাকি সাধারণ মানুষের অধিকার—কোনটি অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত।

মার্কিন রক্ষণশীলদের সঙ্গে সম্পর্ক

২০১৮ সাল থেকে প্রেসিডেন্ট বুকেলের উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করছেন ডেমিয়েন মেরলো। ওয়াশিংটনের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষায় বুকেলের বার্তাবাহক হিসেবে কাজ করেন তিনি।

মেরলো বলেন, 'মানুষ যদি (সরকারের কাজে) খুশি না থাকে, তবে পরের নির্বাচনে তারা অন্য কাউকে ভোট দিতে পারে।' তিনি আরও বলেন, 'নির্বাচনে অনেক বেশি মানুষ অংশ নিচ্ছেন। আর তারা তার (বুকেলে) দল ও তার মিত্রদেরই ভোট দিচ্ছেন।'

২০২৪ সালে আদালতের এক রায়ে সাংবিধানিক নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে বুকেলে দ্বিতীয় মেয়াদে নির্বাচনে জয়ী হন। দেশটিতে পর পর দুই মেয়াদে প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচন করা সংবিধানসম্মত ছিল না। যুক্তরাষ্ট্রের এল সালভাদর ককাসের প্রতিষ্ঠাতা রিপাবলিকান নেতা ম্যাট গেটজ মনে করেন, বুকেলেকে আরও বেশি দিন ক্ষমতায় থাকতে দেওয়া উচিত।

বুকেলের জনপ্রিয়তার একটি বড় কারণ সামাজিকমাধ্যম ব্যবহার করে বিশ্বে এল সালভাদরের নতুন ভাবমূর্তি তৈরি। তিনি এল সালভাদরকে সার্ফিং, আগ্নেয়গিরি আর কফির দেশ হিসেবে তুলে ধরছেন। দেশে সুন্দরী প্রতিযোগিতা আয়োজনে তার মনোযোগ। রাষ্ট্রভাষা স্প্যানিশ হলেও ইংরেজিতে টুইট করেন বুকেলে। বিদেশি ভক্তদের কথা মাথায় রেখে কনটেন্ট তৈরি করেন। যুক্তরাষ্ট্রের খ্রিষ্টান ডানপন্থিদের তুষ্ট করতে কথায় কথায় ঈশ্বর বন্দনাও করেন তিনি।

মতাদর্শিক ঐক্য ও ভবিষ্যতের শঙ্কা

বুকেলে ট্রাম্পের বড় ভক্ত হিসেবে পরিচিত। দুজনেই টুইটার ব্যবহারে পারদর্শী এবং প্রতিষ্ঠিত গণমাধ্যমগুলোর বিরুদ্ধে 'ফেক নিউজ' ছড়ানোর অভিযোগে মুখর। ২০১৯ সালে ট্রাম্পের পাশে বসেই বুকেলে বলেছিলেন, 'প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প খুবই চমৎকার ও দারুণ, আমিও তাই... আমরা দুজনেই টুইটার ব্যবহার করি, তাই আমাদের মধ্যে ভালো বনিবনা হবে।'

বুকেলে যেভাবে তার দেশের বিচারপতিদের বরখাস্ত করে অনুগতদের বসিয়েছেন, সেই বিষয়টি ট্রাম্পের বলয়ের অনেকের কাছে আকর্ষণীয়। নিজের এজেন্ডা বাস্তবায়নে বিচার বিভাগ থেকে বাধা এলেই খড়্গহস্ত হতেন তিনি। এই একই আদালত বুকেলেকে সাংবিধানিক বাধা সত্ত্বেও দ্বিতীয় মেয়াদে নির্বাচন করার সুযোগ করে দেয়। উল্লেখ্য, ট্রাম্প নিজেও তৃতীয় মেয়াদে নির্বাচন করার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেননি।

যারা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কাজ করতে চান তাদের জন্য 'মডেল' হতে পারেন বুকেলে। ট্রাম্পের ধনকুবের মিত্র ইলন মাস্কের সঙ্গেও ব্যক্তিগত যোগাযোগ রয়েছে বুকেলের। তবে গত বছরও বুকেলেকে নিয়ে ভিন্ন সুরে কথা বলতেন ট্রাম্প। তখন ট্রাম্প অভিযোগ করেছিলেন, বুকেলে তার দেশের মাদক কারবারি ও অন্য অপরাধীদের যুক্তরাষ্ট্রে পাঠিয়ে দিচ্ছেন।

এখন ট্রাম্প 'বন্ধু' বুকেলেকে নিয়ে ইতিবাচক কথা বললেও ভবিষ্যতে আবার ভোল পাল্টাবেন কিনা, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।

আপাতত, বুকেলে ট্রাম্প প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ মিত্র। বিশেষ করে, লাতিন আমেরিকায় তার প্রভাবের কারণে। এল সালভাদর থেকে পানামার দূরত্বও খুব বেশি নয়। পানামা খালের নিয়ন্ত্রণ চান ট্রাম্প। আটলান্টিক ও প্রশান্ত মহাসাগরকে যুক্তকারী খালটি দখল করার ঘোষণা দিয়ে ইতোমধ্যে দক্ষিণ আমেরিকায় উত্তেজনা সৃষ্টি করেছেন তিনি।

সেই সঙ্গে বিচার বিভাগের ওপর হস্তক্ষেপ করে তৃতীয় মেয়াদে নির্বাচন করতে এল সালভাদরকে উদাহরণ হিসেবে সামনে আনার স্বপ্ন দেখতেই পারেন ট্রাম্প।

Comments

The Daily Star  | English
Rizvi criticizes PR system in elections

PR system a threat to democracy: Rizvi

Under the PR system, the party, not the people, will choose MPs, he says

2h ago