অতি বিপন্ন উল্লুকের স্বর্গরাজ্য লাউয়াছড়া

Lawachhara
ছবি: মিন্টু দেশোয়ারা

অতি বিপন্ন প্রাণী উল্লুকের জন্য দেশে যে কয়টি আবাসস্থল অবশিষ্ট আছে, তার মধ্যে অন্যতম লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান। মৌলভীবাজার জেলায় অবস্থিত এক হাজার ২৫০ হেক্টর এলাকাজুড়ে বিস্তৃত সংরক্ষিত এই বন জীববৈচিত্র্যের সমৃদ্ধ আবাসস্থল।

সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে ১৯৯৬ সালে বন্যপ্রাণী আইনের অধীনে লাউয়াছড়া বনকে জাতীয় উদ্যান ঘোষণা করে এবং এর পরিবেশগত স্বীকৃতি দেয়।

বর্তমানে এই বনে ৪৬০ প্রজাতির উদ্ভিদ ও প্রাণী রয়েছে। উদ্ভিদ রয়েছে ১৬৭ প্রজাতির, চার প্রজাতির উভচর, ছয় প্রজাতির সরীসৃপ, ২৪৬ প্রজাতির পাখি ও ২০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী।

বিপন্ন বানর, বিশেষত উল্লুক থাকায় আন্তর্জাতিক মনোযোগ আকর্ষণ করেছে এই উদ্যান।

বন বিভাগ সূত্রমতে, গত ৩০ বছরে বন উজাড় ও আবাসস্থল কমায় উল্লুকের সংখ্যা প্রায় ৮০ শতাংশ কমে তিন হাজার থেকে মাত্র ৪০০টির কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়েছে।

সম্প্রতি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় উঠে এসেছে, ১৩টি বিপন্ন উল্লুক পরিবার—যার মধ্যে প্রায় ৪৮টি প্রাইমেট রয়েছে—বর্তমানে এই বনে বিকশিত হচ্ছে। সংলগ্ন কালাচড়া ও চৌতালি বনে আরও উল্লুক পরিবার শনাক্ত করা হয়েছে।

গবেষক সাবিত হাসান বলেন, 'আমার সর্বশেষ জরিপে, লাউয়াছড়া বনে ১৩টি গিবন পরিবারের ৪৮টি প্রাইমেট পাওয়া গেছে। তবু লাউয়াছড়ায় আরও উল্লুকের বিকাশের জায়গা রয়েছে। এই আধা-চিরসবুজ আবাসস্থলে উল্লুকের জন্য সঠিক আবাসস্থল ব্যবস্থাপনার উদ্যোগ জরুরি।'

তিনি বলেন, 'লাউয়াছড়ায় উল্লুকদের জনসংখ্যার ঘনত্ব অন্যান্য বনের তুলনায় বেশি হলেও তাদের আবাসস্থল এখনো মানবসৃষ্ট চাপের সম্মুখীন হচ্ছে।'

প্রাইমেট প্রজাতির ওপর একাধিক গবেষণায় জড়িত শ্যামল দেববর্মা বলেন, 'উল্লুক বানরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সাদৃশ্যপূর্ণ, কিন্তু তাদের লেজবিহীন দেহ, লম্বা অঙ্গ এবং পুরুষ ও স্ত্রী প্রাণীর মধ্যে আকর্ষণীয় রঙের পার্থক্য রয়েছে। সাদা ভ্রুর কারণেও তাদের আলাদা করে চেনা যায়। প্রাপ্ত বয়স্ক উল্লুক সাধারণত ৬০-৯০ সেন্টিমিটার লম্বা এবং ছয় থেকে নয় কেজি ওজনের হয়। পুরুষ ও স্ত্রী হুলক গিবন আকারে একই রকম হলেও তাদের শরীরের রঙ উল্লেখযোগ্যভাবে ভিন্ন। পুরুষদের কালো ত্বক ও সাদা ভ্রু থাকে। অন্যদিকে স্ত্রীদের ধূসর-বাদামি পশম থাকে, গলা ও ঘাড়ের কাছে গাঢ় দাগ থাকে এবং চোখ ও মুখের চারপাশে স্বতন্ত্র সাদা পশম থাকে মুখোশের মতো।'

উল্লুক গর্ভধারণের ছয়-সাত মাস পরে সন্তান জন্ম দেয়। সেগুলো প্রথমে ঝাপসা সাদা পশমে ঢাকা থাকে, যা লিঙ্গের ওপর নির্ভর করে ছয় মাসের মধ্যে কালো বা বাদামি-ধূসর হয়ে যায়। তারা প্রায় আট-নয় বছর বয়সে প্রাপ্ত বয়স্ক হয় এবং ২৫ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে।

বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের সাবেক রেঞ্জ অফিসার মো. শহীদুল ইসলাম বলেন, 'অত্যধিক বন উজাড়, আবাসস্থল ধ্বংস ও খাদ্য সংকটের কারণে গিবনদের অস্তিত্ব মারাত্মকভাবে হুমকির মুখে। এই প্রাইমেটরা আঞ্চলিক ও অন্যান্য গোষ্ঠীর সঙ্গে মেশে না। তারা ডুমুর, চাপালিশ বা বন্য রুটি ফল, কাউপি, বেরি, বট, বাঁশের পাতা ও গাছের কচি ডাল খেয়ে বেঁচে থাকে।'

উল্লুকদের বেঁচে থাকার জন্য লাউয়াছড়ায় সংরক্ষণ প্রচেষ্টা জোরদার করা হয়েছে। কর্তৃপক্ষ উল্লুকদের জন্য একটি স্থিতিশীল খাদ্য উৎস নিশ্চিত করতে ডুমুর ও চাপালিশের মতো গাছ রোপণ করছে। এই প্রচেষ্টার ফলে লাউয়াছড়ায় উল্লুকদের সংখ্যা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন, আবাসস্থল হ্রাস ও খাদ্য ঘাটতি এই প্রজাতির অস্তিত্বের জন্য হুমকিস্বরূপ। দেশের বন থেকে সম্পূর্ণরূপে অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার আগে উল্লুকদের রক্ষায় টেকসই আবাসস্থল সুরক্ষা, পুনর্বনায়ন প্রচেষ্টা ও বন উজাড় রোধে কঠোর নীতিমালা নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তারা।

ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার অনুসারে, এই উল্লুকগুলো জাতীয় ও বিশ্বব্যাপী উভয়ক্ষেত্রেই অত্যন্ত বিপন্ন হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করা হয়েছে।

Comments

The Daily Star  | English

No justifiable reason to delay nat'l polls beyond Dec: Salahuddin

We have been able to make it clear that there is not even a single mentionable reason to hold the election after December, says the BNP leader

5h ago