প্রবাসে শিক্ষার্থীদের রমজানের আমেজ যেমন

প্রবাসে রমজান
ছবি: সংগৃহীত

সামনে ঈদ। ক্লাসরুমে দেখি আমার শিক্ষার্থীরা অধীর আগ্রহে ছুটির জন্য অপেক্ষা করছে, ঈদের আগে রমজানের একটা আমেজ আছে। কবে ছুটি হবে, কবে গোছগাছ করে ডর্ম বা হল থেকে বাড়ি যাওয়া হবে কিংবা শিক্ষার্থী জীবনের স্বল্প হাতখরচে ঈদে কেনাকাটার নানা পরিকল্পনা। নিজে যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলাম, একই আমেজ নিজের মধ্যেও ছিল। পরীক্ষা শেষ আর বন্ধুরা সবাই হলগুলো ফাঁকা করে যেত বাড়িতে। পুরো মাস সবাই অপেক্ষা করতাম কবে ছুটি হবে, টিএসসিতে বসে ইফতার করতে পারব।

এই আমেজটা যে আমাদের মধ্যে কতটা জড়িয়ে আছে, তা খুব করে উপলব্ধি করেছি দেশের বাইরে থাকার সময়। লেক্সিংটন শহরে দুবছরে মোট তিনটা ঈদ পেয়েছি। এটাই আমার পরবাসে ঘর ছেড়ে প্রথম ঈদ। বিদেশে তো শুধু ঘর ছেড়েই থাকতে হয় না, নিজের যত চেনাজানা অভ্যাস সবকিছুই ফেলে এক ভিনদেশের রীতিনীতি আর সংস্কৃতিতে মানিয়ে নিতে হয়। তো রোজার সময় যেহেতু সেখানে কোনো ছুটি নেই, তাই স্বাভাবিক রুটিনেই ক্লাস, পরীক্ষা, এমনকি ঈদের দিন প্রেজেন্টেশনও দিতে হয়েছে। এক ঈদে তো পুরোটা সময় অফিস ডেস্কেই পার করে দিয়েছি। সন্ধ্যায় শুধু বন্ধুর বাসায় দাওয়াত ছিল বলে, না হয় মনেই হতো না দিনটা ঈদ।

এমনও দিন গেছে, ক্লাস শেষে ভার্সিটির বাসের জন্য দাঁড়িয়ে আছি তো আছিই, ইফতারের সময় হয়ে গেছে। আমি কিন্তু ঠায় দাঁড়িয়ে সেই বাস স্টপেজে। অন্যান্য বিভাগের বন্ধুদের দেখেছি, ঈদের দিন সকালে কোনোমতে নামাজটা পড়ে ক্লাসে ছুটে যেতে। এই সময়গুলো কিছুটা খারাপ লাগত।

'কিছুটা' বলছি এই কারণে, সত্যি বলতে আমার বন্ধু ভাগ্য প্রসন্নই ছিল। ডর্মে এমন কিছু বন্ধু এবং নিজ দেশের মানুষ পেয়েছি যে রোজা-ঈদ একবারে দেশীয় খাবার ছাড়া উদযাপন হয়েছে, এমনটা হয়নি। তবে হ্যাঁ, অনেক দিন গেছে ইফতার ঠিক সময়ে করতে পারিনি, ছুটির বালাই নেই। বরং ঈদের দুদিন আগে পড়ার টেবিলে বসে পড়তে হয়েছে লক্ষ্মী মেয়ের মতো। কারণ সেই আমেজটাই তো নেই। ঈদের দিন যে শত নম্বরের প্রেজেন্টেশন, সেই কোর্সের প্রফেসরকে জানাতে হয়েছে, 'দয়া করে একটা দিন ছুটি দিন!'

কিন্তু রুটিন, ক্লাসরুমের বাইরে আমাদের বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের যে অ্যাসোসিয়েশন ছিল, সেই কমিটি থেকে সবসময়ই উদ্যোগ নেওয়া হতো যেন ঈদের দিনটা অন্তত আমরা বাংলাদেশি মুসলিম শিক্ষার্থীরা একসঙ্গে উদযাপন করতে পারি। এছাড়াও কয়েকজন নিজ উদ্যোগেই পুরো বাংলাদেশি কমিউনিটির সবাইকে নিয়ে ইফতারের আয়োজন করতেন। সেখানে নিজ দেশের খেজুর গুড়ের পায়েসও রান্না হতো। আমরাও যতটুকু পারতাম লেগে যেতাম বিভিন্ন সাহায্যে। সকাল থেকে প্রায় শত মানুষের ফল, সালাদ কেটে দিতাম। আর ঈদের দিন থাকত ওয়ান ডিশ পার্টি। আমি আর আমার বন্ধু যেহেতু রান্নায় কেবল হাতেখড়ি নিচ্ছিলাম, তাই অন্য কাউকে দিয়েই নিজেদের দায়িত্বে থাকা বিরিয়ানিটা রান্না করিয়ে নিতাম। এই সহায়তাটুকুও পেয়েছি আমাদের মতোই পড়তে আসা নিজ দেশের মানুষের থেকে।

এছাড়া আরেক আকর্ষণ ছিল মসজিদের ইফতার। লেক্সিংটন শহরে ছিল কেন্দ্রীয় মসজিদ। নানা দেশের মুসলিমরা সেখানে আসতেন। আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য, কেউ আবার ধর্মান্তরিত মুসলিম। প্রতি সপ্তাহের শনি আর রোববার মিলত ইফতার। সপ্তাহ হিসেবে একেক দেশের মুসলিমরা এর আয়োজন করতেন। আমরা সারাদিন ক্লাস শেষে রান্নার ঝামেলা এড়ানোর জন্য চলে যেতাম মসজিদে। কিছুটা ঝামেলা হতো গাড়ি ঠিক করতে। কারণ বেশ দূরেই ছিল মসজিদ। কিন্তু আমাদের মতো যারা পরিবার ছাড়া একাই ডর্মে থাকত, তাদের কেউ না কেউ নিয়েই যেত। বিশেষ করে যেসব বন্ধু বা পরিবারের গাড়ি আছে। মসজিদে নামাজ শেষে, ইফতার করে চলত কিছুক্ষণ গল্প, আড্ডা। ফিরে এসে আমরা কখনো ডর্মে চা-পার্টির আয়োজন করে ফেলতাম।

সময় গড়িয়ে এ বছর রোজা-ঈদ করছি পরিবারের সঙ্গে। অফিস থেকে ফিরতে ফিরতে বিকেল সময়ে আবারও সেই শহরের ভিড়, ইফতারের পসরা। এসব ছেড়ে যাওয়ার সময় বেশ খারাপ লেগেছিল। তবে এতসবের মধ্যেও মনে পড়ে লেক্সিংটনের সেই দোতলা গোছানো ডর্মগুলোর কথা। যেখানে আমরা সবাই ঘর, পরিবার ছেড়ে এসে নিজেরাই নিজেদের মতো রোজা, ঈদ, যেকোনো উৎসবের আয়োজন করে নিতাম। তখন এটাই ছিল আমাদের পরিবারের মতো। ভালো থাকুক সেখানকার আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীরা এবং তাদের আনন্দ উদযাপনের চেষ্টাগুলো।

নাদিয়া রহমান: সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস (বিইউপি) ও যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব কেন্টাকির শিক্ষার্থী।

 

Comments

The Daily Star  | English
Bangladesh trade deficit July-August FY25

Trade deficit narrows 2.6% in July-April

The country’s trade deficit narrowed by 2.60 percent in the first ten months of the current fiscal year compared to the same period a year ago, thanks to a rise in export earnings coupled with subdued imports..During the July-April period of fiscal year (FY) 2024-25, the trade gap was $18.

4h ago