নিরাপদে চলার গ্যারান্টি চাই

'মানুষ তেল-চাল-ডাল-নুন নিয়ে শুধু স্বাভাবিক জীবন-যাপন করার কথা ভাবে না, ভাবে রাস্তায় জনতার আক্রোশে পৈত্রিক প্রাণটা কখন বিপর্যস্ত হয়। কখন আততায়ীর গুলি ছিন্ন-ভিন্ন করে দেয় তাকে। সে শুধু জীবনের প্রতিশ্রুতি নয়, চায় একটা স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি।'

উপরের কথাগুলো ১৯৭৩ সালের ১৬ মার্চ দৈনিক বাংলার উপ-সম্পাদকীয় হিসেবে লিখেছিলেন দেশবরেণ্য সাংবাদিক নির্মল সেন। তার সেই আলোচিত কলামের শিরোনাম ছিল 'আমি স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই'। অনিকেত নামে এই লেখাটি প্রকাশিত হওয়ার পর শেখ মুজিবুর রহমান সরকারের রোষানলে পড়েছিলেন নির্মল সেন। কিন্তু সমাজের প্রকৃত চিত্র তুলে ধরে আস্থা অর্জন করেছিলেন গণমানুষের।

২৩ ফেব্রুয়ারি রাতে রামপুরার বনশ্রীতে নিজবাড়ির সামনে প্রাণঘাতী আক্রমণের শিকার হন স্বর্ণ ব্যবসায়ী আতাউর রহমান। চিন্তা করুন, আবাসিক এলাকায় নিজের বাড়ির সামনে একদল অস্ত্রধারী গুলি ছোড়ে, ছুরিকাঘাত করে একজন মানুষের সম্পদ ছিনিয়ে নিয়ে গেল। রাস্তার উপরের ফ্ল্যাট বাসা থেকে আতঙ্কগ্রস্ত নগরবাসীর চেয়ে চেয়ে দেখা আর আর্তনাদের সঙ্গে মোবাইলে ভিডিও করা ছাড়া কিছুই করার থাকল না। কতটা অসহায়, কতটা নিরাপত্তাহীন এই নগরীর মানুষ।

বনশ্রীর এই ভিডিও দেখে ঘুমাতে যাওয়ার আগে আমার বারবার সাংবাদিক নির্মল সেনের কথা মনে পড়ছিল। এই সাংবাদিক বেঁচে থাকলে হয়তো কলম ধরতেন। লিখতেন, স্বাভাবিক চলাচলের গ্যারান্টি চাই।

কিন্তু এই গ্যারান্টি যাদের কাছে চাইব, আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় তারা ভিন্ন বিভ্রমে মগ্ন। তারা সবকিছুর মধ্যেই শেখ হাসিনার প্রেতাত্মা খুঁজে পান। সবকিছুর দায় শেখ হাসিনাকে দিতে তারা পারঙ্গম। কিন্তু দুষ্কৃতিকারীদের গ্রেপ্তার করে মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ব্যাপারে ঠনঠনে। সদা হাসিমুখ স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী ঘোষণা দিয়েছেন, ২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির লক্ষণীয় উন্নতি হবে। সব রেকর্ড ভঙ্গ করে রাত ৩টায় বারিধারা ডিওএইচএসে নিজ বাসভবনে এক জরুরি সংবাদ ব্রিফিংয়ে তিনি এই আশ্বাস বাণী উচ্চারণ করেছেন। এই অভূতপূর্ব সংবাদ সম্মেলনে তিনি আরও ঘোষণা দিয়েছেন, আওয়ামী দোসরদের ঘুম তিনি হারাম করে দেবেন। খুব ভালো কথা, আশাবাদী উচ্চারণ। কিন্তু এসব আশ্বাস যাতে শুধুই বাগাড়ম্বর না হয়। আপনারা এরইমধ্যে এই ক্ষেত্রে অলিম্পিক পদক জয়ের মতো সাফল্য অর্জন করেছেন। আর অন্যদিকে সারাদেশে মানুষের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। মানুষ অতি প্রয়োজনীয় কাজ ছাড়া সন্ধ্যার পর আর ঘর থেকে বের হন না। আর মোহাম্মদপুর তো এখন রীতিমতো ভারতীয় ক্রাইম থ্রিলার মির্জাপুরের শুটিং স্পট। দিনে দিনে রাজধানীর নতুন এলাকা মির্জাপুর খেতাব অর্জনের প্রতিযোগিতায় যুক্ত হচ্ছে।

ইংরেজি ভাষায় উইচ হান্ট নামের একটি শব্দ গুচ্ছ আছে, যা বিভিন্ন ক্ষেত্রে নানাভাবে ব্যবহৃত হয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অন্যের ওপর দায় চাপাতে, নিজের ব্যর্থতা ঢাকতে অন্যকে শত্রু গণ্য করাতেও এই শব্দগুচ্ছের ব্যবহার আছে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যক্রম অনেকটা ওই উইচ হান্ট কার্যক্রমকে স্মরণ করিয়ে দেয়। প্রেস ব্রিফিংয়ে সরকারের প্রেস সচিবকে চলতি মাসেই সাংবাদিকরা প্রশ্ন করেছিলেন সাম্প্রতিক আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে। তিনি সদম্ভে বলেছিলেন, আওয়ামী লীগ আমলের তুলনায় এখন নাকি আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি খুব ভালো। কী অদ্ভুত যুক্তি? নানা বিষয়ে পারঙ্গম, করিৎকর্মা এই সরকারি কর্মকর্তা যদি সত্যিই ঠিক হয়ে থাকেন, তাহলে সারাদেশে মানুষের এই আতঙ্ক কেন? মানুষের জীবন এত অনিরাপদ কেন?

একটা বিষয় পরিষ্কার করে বলে রাখা প্রয়োজন। সবকিছুর জন্য পলাতক শেখ হাসিনা ও তার দোসরদের দায় দেওয়ার জন্য আপনাদের দেশবাসী দায়িত্ব দেয়নি। আপনাদের দায়িত্ব যেকোনো মূল্যে মানুষের দৈনন্দিন জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। অধিকতর সুশাসন নিশ্চিত করা। কিন্তু পদে পদে নিষ্ক্রিয়তা দেখিয়ে, অযোগ্যতা, ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে মানুষকে বোকা বানানো যাবে না। ২০২৫ সালে মানুষ অতটা বোকা না। আর দয়া করে কোনো দায়িত্ব পালন করতে না পারলে তা ছেড়ে দিন। মানুষকে স্বস্তি দিন। দায়িত্ব পালনে সীমাহীন ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে শুধু গালগপ্প করবেন, সবকিছুর জন্য অন্যকে দায় দিয়ে কাজ সারবেন—এই প্রহসন বন্ধ করুন।

আবার একটু ফেরত আসি সাংবাদিক নির্মল সেনের কাছে। তার 'আমি স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই' উপ-সম্পাদকীয়তে তিনি আরও লিখেছিলেন, 'আমি চাই না আততায়ীর গুলি বিদ্ধ করুক আমাকে এক অসতর্ক মুহূর্তে। আমি চাই না যে আমার শুভাকাঙ্ক্ষীরা একদিন থানা পুলিশ করুক আমার জন্য।' এ যেন বনশ্রীতে গুলিতে, ছুরিকাঘাতে আহত স্বর্ণ ব্যবসায়ী অভিব্যক্তি। নির্মল সেন ও স্বর্ণ ব্যবসায়ী আতাউর রহমানের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্দেশে বলতে চাই, আমি 'নিরাপদে পথ চলার গ্যারান্টি চাই'। আর এই নিশ্চয়তা দিতে না পারলে পদত্যাগ করুন মহাশয়রা। অনেক তো হলো।

রাহাত মিনহাজ: সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা

Comments

The Daily Star  | English

Tk 2,956 crore earmarked for Election Commission

Of this amount, Tk 2,727 crore has been allocated as revenue budget, while Tk 229 crore was allocated as development budget

18m ago