বিশ্লেষণ

কমছে বিদেশি বিনিয়োগ, নীতিনির্ধারকদের সতর্ক হওয়া উচিত

অলঙ্করণ: স্টার ডিজিটাল গ্রাফিক্স
অলঙ্করণ: স্টার ডিজিটাল গ্রাফিক্স

দেশে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) ব্যাপকহারে কমেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় এর পরিমাণ জিডিপির মাত্র শূন্য দশমিক পাঁচ শতাংশে আটকে আছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে—২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশটি বছরে ৭১ শতাংশ কম বিদেশি বিনিয়োগ পেয়েছে। আগের বছরের একই সময়ের ৩৬০ দশমিক পাঁচ মিলিয়ন ডলারের তুলনায় অনেক কম।

আরও উদ্বেগের বিষয়—বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) সাম্প্রতিক 'এফডিআই হিটম্যাপ' শীর্ষক প্রতিবেদনে জানানো হয়—দেশীয় শিল্পের জন্য কাঠামোগত বিনিয়োগে উৎসাহ দিতে প্রচারণার ঘাটতি আছে।

এতে আরও বলা হয়, বিদেশি বিনিয়োগের মাত্র ৪৫ শতাংশ প্রকৃত অর্থে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ। বেশিরভাগই আন্তঃপ্রতিষ্ঠান ঋণ বা পুনঃবিনিয়োগ।

এটি উদ্বেগজনক। বছরের পর বছর ধরে অর্থনীতিবিদরা কর্মসংস্থান সৃষ্টি, ব্যবসায়িক কার্যক্রমকে উত্সাহ ও অর্থনীতিকে গতিশীল করতে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তার কথা বলে আসছেন।

এখন প্রশ্ন—সবাই বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানোর পক্ষে পরামর্শ দিলেও বিনিয়োগ কেন কম?

বিশেষজ্ঞরা রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা, আমলাতান্ত্রিক অদক্ষতা ও অসামঞ্জস্যপূর্ণ নীতিসহ বেশ কয়েকটি বাধার কথা বলছেন।

তারা উচ্চ মূল্যস্ফীতি, মুদ্রাবাজারে অস্থিরতা ও আন্তঃপ্রতিষ্ঠান যোগাযোগহীনতার দিকেও ইঙ্গিত করেছেন। এগুলো সম্মিলিতভাবে বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমিয়ে দেয় ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করে।

গত বছরের মাঝামাঝি দেশে গণঅভ্যুত্থানের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। এই রাজনৈতিক পরিবর্তন অর্থনৈতিক কার্যক্রম ব্যাহত হলে সার্বিক স্থিতিশীলতা ও সুশাসন নিয়ে সন্দেহ হয়। মূলত বিদেশি বিনিয়োগ এসবের ওপর নির্ভর করে।

আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির কারণে রাজনৈতিক অস্থিরতা আরও জটিল হয়ে উঠেছে। বিনিয়োগকারীরা অপেক্ষা করার নীতি গ্রহণ করছেন।

পণ্যের ক্রমবর্ধমান মূল্যবৃদ্ধি, অস্থিতিশীল মুদ্রাবাজার ও ডলারের অভাবসহ অর্থনৈতিক সমস্যাগুলো বিদেশিদের বিনিয়োগকে আরও কঠিন করে তুলছে। নীতিগত অসঙ্গতি আরেকটি বড় বাধা।

পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান এম মাসরুর রিয়াজ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বাংলাদেশ মৌলিক অর্থনৈতিক ইস্যুতে জর্জরিত। ফলে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত বাধাগ্রস্ত হয়েছে।'

তার মতে, বিদেশি বিনিয়োগ সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার জন্য অপরিহার্য।

গত ১৫ বছরে ঘুষের বাইরেও দুর্নীতি ব্যাপকহারে বেড়েছে। নীতি প্রণয়নে কারসাজি ও দুর্নীতির এই বাড়বাড়ন্ত বিদেশি বিনিয়োগকে নিরুৎসাহিত করেছে।

বিশেষজ্ঞরা বাংলাদেশ ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও মন্ত্রণালয়গুলোর মতো নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের অভাবের কারণে কাঠামোগত অদক্ষতা, বাহ্যিক ধাক্কা ও নীতিগত ফাঁক-ফোকরগুলোর মতো গভীর সমস্যাগুলোর দিকেও আঙুল তুলেছেন।

ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ফিকি) সাবেক সভাপতি রূপালী চৌধুরীর মতে, 'নীতিগত অসঙ্গতি ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা বিনিয়োগের ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলেছে। তাদের আস্থা ফিরে পেতে সরকারকে প্রাতিষ্ঠানিক নীতিমালার মধ্যে সমন্বয় নিশ্চিত করতে হবে।'

সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক সেলিম রায়হান মনে করেন, 'নীতিগত অনিশ্চয়তার কারণে বর্তমান পরিবেশ বিনিয়োগের অনুকূল নয়।'

তার মতে, সরকারি নীতিগুলো ঘন ঘন পরিবর্তন করা হয়। বিশেষ করে, আমদানি শুল্ক ও কর সম্পর্কিত পরিবর্তনগুলো বিদ্যমান ও সম্ভাব্য বিনিয়োগকারীদের বাধা দেয়।

'কাগজে-কলমে লাভজনক নীতিমালা আছে, কিন্তু বাস্তবায়নের অভাবে সেগুলোর কার্যকারিতা কমে গেছে। বিদেশি বিনিয়োগের উন্নতির জন্য সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও ধারাবাহিক নীতি অপরিহার্য।'

বিদেশি বিনিয়োগকে অনেক সময় অর্থনৈতিক বাস্তবতার সূচক হিসেবে দেখা হয় বলে মনে করেন তিনি।

বাংলাদেশ চায়না চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির যুগ্ম মহাসচিব আল মামুন মৃধার ভাষ্য, 'বিরাজমান অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতিই বিদেশি বিনিয়োগ কমে যাওয়ার প্রধান কারণ।'

সুদের বাড়তি হার ও শিল্প-কারখানায় গ্যাস সরবরাহের ঘাটতিকে আরেক প্রতিবন্ধকতা হিসেবে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, 'বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ করার আগে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করেন। তাই এই সংকটময় মুহূর্তে এখানে কেউ বিনিয়োগে আগ্রহী হবেন না।'

'তুলনামূলকভাবে কম টাকায় শ্রমিক পাওয়া গেলেও দেশে ব্যবসা করার খরচ অন্য অনেক দেশের তুলনায় বেশি। এটি বিদেশি বিনিয়োগকে নিরুৎসাহিত করে।'

ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি জাভেদ আখতার এর আগে বলেছিলেন, যে কোনো ধরনের বিনিয়োগের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

সামগ্রিক স্থিতিশীলতা ছাড়াও টাকার অবমূল্যায়ন, হঠাৎ নিয়ন্ত্রক পরিবর্তন ও অস্থিতিশীল ব্যবসায়িক পরিবেশের মতো ঝুঁকির কারণে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা দ্বিধাগ্রস্ত হন।

রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা দ্রুত সমাধান করা না হলে বাংলাদেশ বিদেশি বিনিয়োগের সুযোগ হারাতে পারে। এতে দেশটির দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক লক্ষ্য ও প্রবৃদ্ধি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।

তবে সম্প্রতি বিদেশি বিনিয়োগ কমে যাওয়াকে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তাকেই একমাত্র কারণ হিসেবে দেখা উচিত নয়। এজন্য নীতিনির্ধারকদের সতর্ক হওয়া উচিত।

Comments

The Daily Star  | English

Bangladesh, Japan for concluding EPA soon to boost economic, trade ties

Japanese PM Ishiba described Bangladesh as a long-standing friend and said that Japan would stand by Bangladesh in its endeavour for a democratic transition

3h ago