সুনসান সাত মসজিদ রোড যেভাবে হয়ে উঠল রেস্তোরাঁ ব্যবসার কেন্দ্র

ছবি: রাশেদ সুমন/স্টার

নব্বইয়ের দশকেও ধানমন্ডি ছিল রাজধানী ঢাকার এক নিরিবিলি এলাকা। দিনের বেলায় সাত মসজিদ রোডে মাঝেমধ্যে রিকশা-বেবিট্যাক্সির চলাচল দেখা যেত। সন্ধ্যার পর নামতো সুনসান নীরবতা। তখন কেউ বন্ধু-আত্মীয়দের নিয়ে বাইরে খাওয়ার কথা ভাবলে প্রথমেই মনে আসতো বেইলি রোড। অনেকের জন্য ছিল গুলশান বা বনানী।

এই স্মৃতি মনে করে মুচকি হেসে উঠেন ৩৬ বছর বয়সী শামীমা সীমা।

তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ধানমন্ডিতে ম্যাকডোনাল্ড নামে একটা রেস্তোরাঁ ছিল। আসল ম্যাকডোনাল্ড'স না। ভাজা মাছের পাশে পড়ে থাকতো স্প্রিং রোল।'

সে সময় ধানমন্ডিতে আরেকটি খাওয়ার জায়গা ছিল চাইনিজ রেস্তোরাঁ জিং লিং।

সবই পাল্টে যেতে শুরু করে ২০০০ সালের পর থেকে।

সেই সময়ের রাইফেলস স্কয়ার এখন পরিচিত 'সীমান্ত স্কয়ার' নামে। শপিংমলটি ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হয়ে উঠে মুখরোচক খাবারের দোকানের জন্য। আর নতুন নতুন স্কুল ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠলে ধানমন্ডি লেক মুখর হয়ে উঠে তরুণদের আড্ডায়।

তরুণদের সবকিছু প্রয়োজন হয় নাগালের মধ্যে। ধানমন্ডি থেকে বেইলি রোড অনেক দূর।

ছবি: রাশেদ সুমন/স্টার

স্কুলের দিনগুলোর কথা স্মরণ করে সীমা আরও বলেন, 'মনে আছে কড়াই গোস্ত, বাবুর্চি ও জিনজিয়ানের মতো রেস্তোরাঁগুলো তখন ভোজনরসিকদের টানতে শুরু করছে। খাবার বেশ মজার ছিল। দাম সবার সাধ্যের মধ্যে ছিল না। কলেজে পড়ার সময় সবাই লায়লাতি, আল বাইক, ধাবার কথা জানত।'

২০০২ সালে বুমার্স ক্যাফে আসে। প্রাণবন্ত ক্যাফে সংস্কৃতির যুগের শুরু। সাত মসজিদ রোড ব্যস্ত হয়ে উঠে তখন থেকে। এক সময়ের নির্জন পথের দুই পাশে গড়ে উঠে রেস্তোরাঁ।

ধানমন্ডির সাত মসজিদ রোডে কম খরচের রেস্তোরাঁগুলো হয়ে উঠে নিয়মিত আড্ডার স্থান। গত দুই দশকে এই সড়কটি খাবারপ্রিয় মানুষদের পছন্দের জায়গায় পরিণত হয়েছে।

উদ্যোক্তারা এখানে খাবারের দোকান খোলায় অনেকের কাজের সুযোগ হয়েছে।

এ ছাড়া, যারা পুরোপুরি আইন মেনে ব্যবসা করেছিলেন না তাদের প্রায় সবাই এখন সরকারি নিয়ম অনুসারে ব্যবসা করতে বাধ্য হচ্ছেন। ফলে এলাকাটি গ্রাহকদের আস্থা অর্জন করেছে, বলছেন উদ্যোক্তারা।

বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির (বিআরওএ) তথ্য অনুসারে, সাত মসজিদ রোড থেকে ধানমন্ডি-২৭ পর্যন্ত তালিকাভুক্ত রেস্তোরাঁর সংখ্যা ২৪৫টির বেশি।

এর বাইরে আরও প্রায় ১০০ রেস্তোরাঁ আছে বলেও জানিয়েছে সংগঠনটি। সব মিলিয়ে ওই এলাকায় সাত থেকে আট হাজার মানুষের কাজের সুযোগ হয়েছে।

ঢাকায় প্রায় ২৫ হাজার রেস্তোরাঁ আছে। এর মধ্যে কয়েকশ রেস্তোরাঁ গত এক দশকে নগরবাসীর স্বাস্থ্যসম্মত খাবারের চাহিদা মিটিয়ে যাচ্ছে।

সমিতির তথ্য বলছে, দেশে চার দশমিক ৮১ লাখ রেস্তোরাঁ আছে। সেখানে কাজ করছেন প্রায় ৩০ লাখ মানুষ। প্রায় দুই কোটি মানুষ প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে রেস্তোরাঁ খাতে যুক্ত।

ছবি: রাশেদ সুমন/স্টার

একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মী রওশন তৃষা ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ওই এলাকায় বেশিরভাগ রেস্তোরাঁয় তুলনামূলক কম বাজেটে খাওয়া যায়। ছোট ছোট ফুড কার্টও আছে। সহকর্মী ও বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটানোর জন্য বেশ দারুণ একটা স্পট।'

এ কারণে তিনি সময় পেলেই সাত মসজিদ রোডে আড্ডা দেওয়ার জন্য যান বলেও জানান।

মাল্টি কুইজিন বুফে রেস্টুরেন্ট দ্য প্যান প্যাসিফিক লাউঞ্জের মালিক আবুল আহসান আনোয়ার ডেইলি স্টারকে জানান, ২০০০ সালে তিনি সাত মসজিদ রোডে ব্যবসা শুরু করেন।

২০২২ সালে তিনি একই এলাকায় আরেকটি রেস্তোরাঁ খোলেন। ২০২৪ সালে খোলেন তৃতীয়টি।

আবুল আহসান আনোয়ার বলেন, 'জিগাতলা থেকে ধানমন্ডি-২৭ পর্যন্ত রাস্তাটি এখন পুরোপুরি ফুড জোন। যেহেতু ব্যবসা দিন দিন বাড়ছে, তাই বিনিয়োগ বাড়িয়েছি।'

তার মতে, সাত মসজিদ রোডের রেস্তোরাঁগুলোয় অনেক রকমের খাবার পাওয়া যায়।

'ধানমন্ডিতে বিনোদনের জায়গা খুব কম। তাই মানুষ রেস্তোরাঁয় খেতে খেতে আড্ডা দেন। কেউ আবার ঘুরে বেড়ান ধানমন্ডি লেকে।'

আশপাশে বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ও স্কুল থাকায় রেস্তোরাঁ ব্যবসা বাড়ছে।

তবে তিনি মনে করেন, গত বছরের মার্চ থেকে মূল্যস্ফীতি নয় শতাংশের ওপরে থাকায় এবং হঠাৎ করে গত আগস্টে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কারণে ব্যবসায় নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।

'ক্রাশ স্টেশন'র ব্যবস্থাপক নাসিম আহমেদ ডেইলি স্টারকে বলেন, '২০১৭ সালে আমাদের রেস্তোরাঁ চালু হয়। বর্তমানে ১৩ জন কাজ করছেন। তাদের বেশিরভাগই শিক্ষার্থী।'

কেন দোকানের জন্য এই জায়গা বেছে নিয়েছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'ধানমন্ডির এই এলাকাটি জনপ্রিয় কারণ এখানে অফিস, স্কুল, কলেজ, শপিংমল ও অন্যান্য দোকান আছে। ফলে রেস্তোরাঁগুলোয় ক্রেতা বাড়ছে।'

তিনি আরও বলেন, 'এখানে কম টাকায় খাওয়ার জন্য অনেক রেস্তোরাঁ আছে। তরুণরা সময় কাটানোর জন্য এমন জায়গা বেছে নেন।'

গত ফেব্রুয়ারিতে বেইলি রোডে এক রেস্তোরাঁয় আগুনের ঘটনার পর ক্রেতা কমতে শুরু করে জানিয়ে তিনি আরও বলেন, 'আমাদের রেস্তোরাঁর বেশিরভাগ ক্রেতা তরুণ-তরুণী ও দম্পতি।'

ছবি: রাশেদ সুমন/স্টার

সেই আগুনে অন্তত ৪৬ জনের মৃত্যু হয়। আহত হন আরও অনেকে।

ওই ঘটনার পর গ্রাহকরা নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন বলে মনে করেন তিনি।

'আমরা জরুরি বহির্গমন পথ নিশ্চিত করে এবং কর্মীদের আগুন নেভানোর প্রশিক্ষণ দিয়ে সুরক্ষার মান পূরণ করতে অনেক উদ্যোগ নিয়েছি।'

নাসিম আহমেদ আরও বলেন, 'ব্যবসা আগের মতো নাই। উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ব্যবসায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।'

মূল্যস্ফীতি কমার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য বলছে—চাল ও সবজির দাম বেড়ে যাওয়ায় গত অক্টোবরে মূল্যস্ফীতি তিন মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ ১০ দশমিক ৮৭ শতাংশে পৌঁছেছে।

পার্ক এন স্মির্ক রেস্তোরাঁর ক্যাশিয়ার মুন্না খান ডেইলি স্টারকে জানান, ২০১৬ সালে রেস্তোরাঁটি চালু হয়। বর্তমানে সেখানে পাঁচজন কাজ করছেন।

'আমাদের রেস্তোরাঁ মালিক এই কেয়ারি ক্রিসেন্ট টাওয়ারে একটি ফ্লোরেরও মালিক। এই এলাকাটি খাবারের দোকানের জন্য সুপরিচিত হওয়ায় তিনি রেস্তোরাঁ খোলার সিদ্ধান্ত নেন।'

তিনি আরও বলেন, 'সম্প্রতি আমাদের ব্যবসা আগের তুলনায় অনেক ভালো। লোকসানের কারণে গত মাসে এই ভবনের অন্তত তিনটি রেস্তোরাঁ বন্ধ হয়ে গেছে।'

'তরুণ গ্রাহকদের সংখ্যা বাড়ছে। আশা করছি ব্যবসা গতি পাবে।'

নিরাপত্তার বিষয়ে তার ভাষ্য, 'আমরা খাবার, অগ্নি-নিরাপত্তা ও গ্রাহক সেবা নিয়ে কর্মশালার আয়োজন করি। সব কর্মীরা বেশ অভিজ্ঞ। গ্রাহকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা সহজ।'

সাত মসজিদ রোডের 'টেকআউট ব্রাঞ্চের ব্যবস্থাপক হৃদয় পাল জানান, ২০১৪ সালে রেস্তোরাঁটি চালু হয়। এখানে ১২ জন কাজ করছেন। তিনি বলেন, 'এলাকার জনপ্রিয়তাই শাখা খোলার মূল কারণ।'

তার দাবি, 'বর্তমানে গ্রাহকের সংখ্যা আগের মতো নেই। মুনাফাও কম। বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, নিত্যপণ্যের বেশি দাম ও ব্যবসায় ক্রমবর্ধমান প্রতিযোগিতার কারণে বিক্রি কমেছে।'

তিনি আরও বলেন, 'আমরা কর্মীদের আগুন থেকে নিরাপদ থাকার উপায় এবং খাবার ও গ্রাহকসেবা সম্পর্কে প্রশিক্ষণের জন্য দুটি মাসিক কর্মশালার আয়োজন করি।'

রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির ঢাকা দক্ষিণের সভাপতি আবুল আহসান আনোয়ার ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এই এলাকায় কফিশপ খুলতে চাইলে ৩০ থেকে ৪০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করতে হবে।'

ছবি: রাশেদ সুমন/স্টার

ইউরোপীয় মানের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কফিশপ খুলতে চাইলে তাদের প্রায় এক কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে হবে। আর ২০০ থেকে ২৫০ জনের ধারণক্ষমতার রেস্তোরাঁ খুলতে হলে দরকার দেড় থেকে দুই কোটি টাকা।

অনেক তরুণ এখন উদ্যোক্তা হচ্ছেন। রেস্তোরাঁ ব্যবসায় আসছেন। তার মতে, 'এই ব্যবসায় বিপুল সম্ভাবনা আছে।'

'যতই দিন যাচ্ছে সাত মসজিদ রোড ততই জমজমাট হয়ে উঠছে' উল্লেখ করে আবুল আহসান আনোয়ার আরও বলেন, 'বেইলি রোডে দুর্ঘটনার পর কয়েক মাস ব্যবসা খারাপ ছিল। এখন প্রায় সব রেস্তোরাঁ শতভাগ অগ্নি-নিরাপত্তা মেনে ব্যবসা করছে। অতিথিরাও খুশি।'

সমিতির সদস্যরা নিয়ম মেনে কর দিচ্ছেন জানিয়ে তিনি বলেন, 'সমিতি সব সময় সদস্যদের নিয়ম মেনে কাজ করতে বলে। ব্যবসা শুরু করতে হলে ১৪ বিভাগ থেকে ১৪টি সার্টিফিকেট নিতে হয়। ওয়ান স্টপ সার্ভিস হলে খুব ভালো হতো।'

রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটির মহাসচিব ইমরান হাসান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ধানমন্ডি এলাকায় অভিজাত, মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্তসহ সব শ্রেণির গ্রাহক আছে।'

২০১০ সাল থেকে সাত মসজিদ রোডে রেস্তোরাঁ ব্যবসা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে।

ধানমন্ডিতে ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশসহ বেশ কয়েকটি স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় আছে। এটা ব্যবসা বেড়ে যাওয়ার আরেক কারণ বলে মনে করেন তিনি।

একটি এলাকায় যখন দুই-চারটি রেস্তোরাঁ ভালো ব্যবসা করে, তখন সেখানে আরও অনেকের ব্যবসা শুরু করা স্বাভাবিক। সাত মসজিদ রোডে এমনটাই ঘটেছে বলে মনে করেন তিনি।

বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান জাকারিয়া ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ঢাকার কোনো রেস্তোরাঁ হাবে আলাদাভাবে তদারকি হয় না। সার্বিকভাবে যেভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করা হয় ধানমন্ডির ক্ষেত্রেও তাই।'

ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ আলীম আক্তার খান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ভোক্তা স্বার্থ যাতে ক্ষুণ্ণ না হয় সেজন্য এই এলাকাতে নিয়মিত অভিযান চালানো হয়।'

'অতীতে বিভিন্ন সময়ে সাত মসজিদ রোডেও অভিযান চালানো হয়েছে' জানিয়ে তিনি আরও বলেন, 'কেউ অভিযোগ দিলে অভিযান হয়। অভিযানের পর দোষী রেস্তোরাঁকে জরিমানা করা হয়। এরপর নিয়মিত তদারকি করা হয়।'

Comments

The Daily Star  | English

Postgrad doctors block Shahbagh demanding stipend hike

The blockade resulted in halt of traffic movement, causing huge suffering to commuters

11m ago