নারীর সক্রিয় সম্পৃক্ততা ছাড়া আদর্শ রাষ্ট্র বিনির্মাণ সম্ভব?
কথায় আছে, 'বাঙালি হুজুগে জাতি'! বাঙালি যদি মনে করে কোনো বিষয়ে সে প্রতিবাদ করবে কিংবা প্রতিক্রিয়া দেখাবে অথবা মেতে উঠবে, তবে পৃথিবীর তাবৎ শক্তির সাধ্য কী তাকে রুখে দেয়! জুলাই অভ্যুত্থানে ছাত্রদের সঙ্গে ছাত্রী ও আপামর জনগণের তুঙ্গ সম্পৃক্ততা সেই বচনের সাক্ষ্য নিশ্চিত করেছে।
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার বিষয়ক ২০১৮ সালের পরিপত্র পুনর্বহালের দাবিতে শুরু হওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নারী শিক্ষার্থীরা সম্মুখ সারিতে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ১০ জুলাই 'বাংলা ব্লকেড' ঘোষিত হওয়ার পর ১১ জুলাই প্রথম পুলিশি অবস্থানের বিপরীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ আশেপাশের অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা পাল্টা প্রতিরোধ সৃষ্টি করে। 'তুমি কে, আমি কে, রাজাকার রাজাকার', স্লোগানটি সূর্য সেন হল থেকে ধ্বনিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাতে প্রতিটি হল যোগ দেয়। ১৪ জুলাই রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েরা হলের তালা ভেঙে বেরিয়ে আসে এবং ছাত্রদের সঙ্গে রাজু ভাস্কর্যের সামনে মিছিলে যোগ দেয়। পরবর্তী প্রতিটি কর্মসূচিতে মেয়েরা মিছিলের অগ্রভাগে থেকে পুলিশের গুলি ও লাঠির আঘাত অগ্রাহ্য করে নিরাপত্তা বেষ্টনীর মতো ভাই-বন্ধুদের আগলে রাখে। ছাত্রলীগ ও হেলমেটবাহিনীও তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল।
৩১ জুলাই 'মার্চ ফর জাস্টিস' কর্মসূচিতে অংশ নেওয়া স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নুর হোসেনকে রক্ষা করতে এগিয়ে যান একই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নুসরাত জাহান টুম্পা। অসম সাহসী কন্যাটি নিজের জীবনের পরোয়া না করে পুলিশের প্রিজন ভ্যান আটকে দেওয়ার চেষ্টা করেছে। পাঁচ সমন্বয়কের সঙ্গে ২৮ জুলাই সকালে নারী সমন্বয়ক নুসরাত তাবাসসুমকে ডিবি অফিসে তুলে আনা হয়েছিল। ১ আগস্ট দুপুরে নুসরাতসহ ছয় সমন্বয়ক ডিবি অফিস থেকে ছাড়া পান। ওই দিনই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক শামীমা সুলতানা দুপুরের পর নিজ অফিস কক্ষ থেকে শেখ হাসিনার ছবি নামিয়ে ফেলেন এবং সেই দৃশ্য তার ফেসবুক ওয়ালে শেয়ার করে লেখেন—খুনি হাসিনার ছবি তিনি তার অফিস কক্ষে রাখবেন না। সমন্বয়করা যখন ডিবি হেফাজতে ছিলেন, শিক্ষকদের একটি প্রতিনিধিদল ডিবি কার্যালয়ে গিয়েছিলেন। সেখানেও একাধিক নারী শিক্ষক ছিলেন। নারী কবি ও লেখকরা শাসক শ্রেণিকে 'ট্রিগার' করে কবিতা ও কলাম লিখেছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নারীরা সর্বদাই সরব ছিলেন।
আবু সাঈদের মৃত্যুর পর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, স্কুল ও মাদ্রাসার ছাত্রীরা ছাত্রদের সঙ্গে স্পর্ধায় মাথা তুলে আন্দোলনে অংশ নিয়েছে। শিক্ষার্থীদের পথে নামার এই বিস্ফোরণ কত কত অব্দ যেন এদেশবাসী দেখেনি। ছাত্রীরা সশব্দ সঙ্গী না হলে এই আন্দোলনের অভিমুখ ভিন্ন হতে পারত! ৩ অক্টোবর সেটি স্বীকার করেছেন উপদেষ্টা মাহফুজ আলম। তার ভাষ্য: 'এই আন্দোলনে মেয়েদের সম্পৃক্ততা ছিল বিরাট। এখন অনেকে ভুলে গেলেও এ কথাটা সত্য যে মেয়েরা না থাকলে এই আন্দোলন কোনোভাবেই সফল হতো না।' আন্দোলনে নিহত মাইলস্টোন স্কুল ও কলেজের দশম শ্রেণির ছাত্রী নাইমা সুলতানা হিরো হয়ে ওঠেনি। নাইমার জন্য নির্মিত হয়নি কোনো চত্বর কিংবা তোরণ। আন্দোলনে নিহত সব নারীর তালিকা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে কি না, তা নিয়েও রয়েছে স্পষ্ট সংশয়।
দেশের প্রতিটি অঞ্চল এবং সব শ্রেণি-পেশার নারীজগৎ মিছিল ও স্লোগানে আন্দোলনে ঘূর্ণি সৃষ্টি করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষক প্ল্যাকার্ড হাতে রাস্তায় নেমেছেন। ছাত্রকে রক্ষা করতে পুলিশের লাঞ্ছনা সহ্য করেছেন। প্রিজন ভ্যানে তুলে নেওয়া সন্তানকে মা পিঠ চাপড়ে অভয় বাণী দিয়েছেন। ডা. অর্থি ও ডা. হৃতিশা বাড়ির গ্যারেজে আহত ছাত্র-ছাত্রীদের পরম মমতায় চিকিৎসা সেবা দিয়েছেন।
উপরে বর্ণিত বয়ানগুলো নারীর অসামান্য এবং অসংখ্য অবদানের খণ্ডিত তথ্য মাত্র। ৩৬ জুলাই পট পরিবর্তিত হতে চলেছে—এমন পূর্বাভাস ২ আগস্ট পর্যন্ত অমূলক, অবাস্তব ও অসম্ভব ছিল। কর্তৃত্ববাদী সরকারের নির্বিচার হত্যা, জেল-জুলুম এবং গুম-খুনের খড়গ মাথায় নিয়েই নারীরা জুলাই বিপ্লবে দৃপ্ত পদক্ষেপে অংশগ্রহণ করেছে। অথচ ৫ আগস্ট-পরবর্তী সরকার গঠনের সময় নারীরা কেন মূল আবর্ত থেকে কক্ষচ্যুত হলো? উপদেষ্টা পরিষদে কিংবা প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী হিসেবে কোনো নারী সমন্বয়ককে নিয়োগ দেওয়া হলো না! অথচ সমন্বয়ক কমিটিতে ২০ জনের অধিক নারীর উপস্থিতি বহমান।
এখন পর্যন্ত ২৪ জনের উপদেষ্টা পরিষদে মাত্র চারজন নারী উপদেষ্টা রয়েছেন। এই চারজনই আবার এনজিওর সঙ্গে সম্পৃক্ত। বিষয়টি অদ্ভুত ও অযৌক্তিক এই অর্থে যে, নব্বইয়ের গণআন্দোলন পরবর্তী যে তিনটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়েছিল; প্রতিটি সরকারে একজন করে নারী উপদেষ্টা নিয়োগ পেয়েছিলেন এবং তারা প্রত্যেকেই এনজিও সম্পৃক্ত নারী। সে সময় শ্রবণ করতে হয়েছে, নারী উপদেষ্টারা প্রধান উপদেষ্টার পূর্বপরিচিত ছিলেন।
অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর প্রাসঙ্গিক বিষয়টির কূটাভাসের রেখা স্পষ্ট। এখানে প্রশ্ন উত্থাপন করতেই হচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী নারী—যারা নানা পেশায় গর্বিত অংশীদার এবং বহুমাত্রিক প্রতিভার আধার, তারা কেন ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন?
জনসংখ্যার অনুপাতে ২৪ জন উপদেষ্টার মধ্যে ১২ জন নারী উপদেষ্টা থাকবার কথা। সেটা ছেড়ে দিলেও গণপ্রতিনিধিত্ব (সংশোধন) আদেশ আইন (২০০৯) অনুযায়ী রাজনৈতিক দলগুলোকে কমিটির কমপক্ষে ৩৩ শতাংশ পদ নারীদের জন্য সংরক্ষিত রাখতে হবে। এটিকে আমরা নারীর দেশ পরিচালনায় সম্পৃক্ততার ক্ষেত্রে একটি ইনডিকেটর হিসেবে দেখলে উপদেষ্টা পরিষদে এক-তৃতীয়াংশ নারী সদস্য থাকার কথা। অন্যদিকে কোনো সংস্কার কমিটির প্রধান নারী নন। আবার প্রতিটি কমিটিতে দুয়েকজন করে নারী সদস্যের উপস্থিতি আসলে কী বার্তা বহন করে?
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় মেয়েরা নারীদের জন্য ১০ শতাংশ কোটা সংরক্ষণের প্রয়োজন নেই বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন। মেয়েরা সম্মানের স্থানটি সেখানেই নির্দিষ্ট করেছেন। বাসবী চক্রবর্তীর মতে, 'নারীবাদ হচ্ছে মূলত নারীমুক্তির জন্যে কিংবা নারীর সমানাধিকার অর্জনের উদ্দেশ্যে গড়ে তোলা তত্ত্ব এবং একইসঙ্গে তার প্রয়োগ ও দৃষ্টিভঙ্গি। নারীবাদের প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে একটি লিঙ্গ বৈষম্যহীন সমাজ গড়ে তোলা, যেখানে নারী তার নিজস্ব পরিচিতি নিয়ে বেঁচে থাকতে পারবে।'
ইংরেজ লেখক মেরি ওলস্টোনক্র্যাফট, পিতৃতন্ত্রের ইতিহাসে তিনিই প্রথম নারী যিনি নারী অধিকার বিষয়ে সোচ্চার ছিলেন। তিনি তার লেখা গ্রন্থ 'অ্যা ভিনডিকেশন অব দ্য রাইটস্ অব অ্যা উইমেনে (১৭৯২) নারীর জন্য পুরুষের সমান অধিকার চেয়েছেন। নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন নারী ও পুরুষকে একটি গাড়ির দুটি চাকার সঙ্গে তুলনা করেছেন: 'যে শকটের এক চক্র বড় (পতি) এবং এক চক্র ছোট (পত্নী) হয়, সে শকট অধিক দূরে অগ্রসর হইতে পারে না; সে কেবল একই স্থানে (গৃহকোণেই) ঘুরিতে থাকিবে। তাই ভারতবাসী উন্নতির পথে অগ্রসর হইতে পারিতেছে না।'
বাংলাদেশ সংবিধানের ২৮ (২) অনুচ্ছেদ বলা হয়েছে, 'রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বস্তরে নারী পুরুষের সমান অধিকার লাভ করিবেন।' এবং ২৯ (১) অনুচ্ছেদ বলা হয়েছে, 'প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ-লাভের ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা থাকিবে।' যদিও বাংলাদেশ সরকার সিডও সনদের অনুচ্ছেদ ২ এবং ১৬ (১) (গ) এখনো সই করেনি। সিডও (কনভেনশন অন দ্য এলিমিনেশন অব অল ফর্ম অব ডিসক্রিমিনেশন অ্যাগেইনস্ট উইমেন) নারী সংক্রান্ত একমাত্র আন্তর্জাতিক চুক্তি বা সনদ। অনুচ্ছেদ ২-এ মূলত নারীর প্রতি সকল প্রকারের বৈষম্য বিলোপের অঙ্গীকারের কথা বলা হয়েছে।
বৈষম্যকেন্দ্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিপরীত উচ্চারণ গণঅভ্যুত্থান। ৮ আগস্ট গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার-ব্যবস্থায় তবে কেন বৈষম্য সৃষ্টি হলো? অন্তর্বর্তী সরকারকে অবশ্যই বিভেদ, বৈষম্য ও বিভ্রান্তি নিরসন করতে হবে। সমাজে নারীর তুমুল উপস্থিতি, অবস্থান ও অবদান অস্বীকার করাটা বুমেরাং হতে পারে না! মুদ্রার দুটো পিঠের প্রতিটি পিঠেই কিন্তু শাপলা নেই। রবার্ট ব্রাউনিং 'র দ্য প্যাট্রিয়ট' কবিতার অনুরণনে বলা যায়, ক্ষমতার আবর্তনে ফুল এবং কাঁকর সর্বদাই পাশাপাশি অবস্থান করে। পর্বতশৃঙ্গ থেকে খাড়ির দূরত্ব অধিক হলেও অসচেতন ভুলের পশরা এবং সামান্য বিচ্যুতিই সেই দূরত্বের ইতি টানার জন্য যথেষ্ট হতে পারে।
বাংলাদেশের নারীরা শিক্ষা, চিকিৎসা, প্রকৌশল, বিজ্ঞান, গবেষণা, শিল্পকলা, সাহিত্য, সাংবাদিকতা ও সমরবিদ্যা—কোথাও পিছিয়ে নেই। এমন বলার সুযোগ কি রয়েছে যে, যোগ্য নারী খুঁজে পাওয়া যায়নি? নাগরিক হিসেবে নারীকে তার প্রাপ্য অধিকার অর্পণ করার ক্ষেত্রে সদিচ্ছার অন্তরায়টাই এখানে প্রধান। সমান্তরাল একটি প্রপঞ্চকে বঞ্চিত রেখে অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্র গঠনের কথা বলা হলেও একচেটিয়া সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা পুরুষের নিয়ন্ত্রণে—বিষয়টি অন্যায্য এবং দ্বন্দ্বমুখর নয় কি? অন্তর্বর্তী সরকারের ১০০ দিন অতিক্রান্ত হওয়ার পরও নারীর ক্ষমতায়নের দৃশ্যমান পথরেখা অনুপস্থিত। এভাবে নারীর সক্রিয় সম্পৃক্ততা ছাড়া কি আদর্শ রাষ্ট্র বিনির্মাণ সম্ভব হবে?
লেখক: নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কলামিস্ট
Comments