এমন হত্যাকাণ্ড আর কতদিন?

সাংবাদিকতার পরিভাষায় সোব সিস্টার নামে একটি টার্ম আছে। সাধারণত এই নামে পরিচিত বা দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংবাদকর্মী প্রত্যেক সংবাদপত্রেই থাকেন। তাদের দায়িত্ব হলো বস্তুনিষ্ঠ কোনো সংবাদ অত্যন্ত সংবেদনশীল ও স্পর্শকাতরভাবে ফিচার কাঠামোর মাধ্যমে তুলে ধরা। যাতে পাঠকরা আবেগতাড়িত হন, প্রভাবিত হন, সচেতন হন। বাংলাদেশে এখন প্রায় প্রতিদিন এমনসব হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটছে, তাতে হয়তো নিশ্চিতভাবেই বেশিরভাগ প্রতিবেদককেই সোব সিস্টার্সের দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে।

কয়েকদিন আগেই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের রাস্তায় একটি মেয়ে নিষ্ঠুরভাবে প্রাণ হারালেন। ২৩ নভেম্বর সকালে অকালে প্রাণ হারালেন আরও তিনজন শিক্ষার্থী। যে মৃত্যুতে তাদের কোনো দায় ছিল না। শুধু অব্যবস্থাপনা আর দায়িত্বহীনতায় তারা মর্মান্তিকভাবে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন। চিরতরে ধূলিসাৎ হয়ে গেল কয়েকটি পরিবারের স্বপ্ন। অনেকেই বিষয়গুলোকে অপঘাত বা দুর্ঘটনা বলে আখ্যায়িত করে থাকেন। কিন্তু আমার কাছে মনে হয় এগুলো এক একটি নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড, যার বিচার ও প্রতিকার ভীষণ প্রয়োজন।

শিক্ষাসূচিতে বছর শেষে একটি পিকনিক বা আনন্দভ্রমণ শিক্ষার্থীদের খুবই কাঙ্ক্ষিত একটি উপলক্ষ। এ দিনটি নিয়ে তারা অনেক আগে থেকেই প্রস্তুতি নিয়ে থাকেন। কেউ নতুন পোশাক কেনেন, স্মৃতি ধরে রাখতে ভালো ক্যামেরা সংগ্রহ করেন। বন্ধুদের সঙ্গে আনন্দ উদযাপনের নানা পরিকল্পনাও থাকে। দূরত্ব ঘুচিয়ে একটি দিনের জন্য হলেও তারা শিক্ষকদের বেশ কাছাকাছি আসার সুযোগও পান। এমনই এক আনন্দযজ্ঞে মাততে ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির (আইইউটি) শিক্ষার্থীরা রওনা হয়েছিলেন বিনোদনকেন্দ্রের উদ্দেশ্যে।

কিন্তু হায়! পথেই তাদের জন্য ওত পেতে ছিল মানবসৃষ্ট যমদূত। মুহূর্তেই বিদ্যুতায়িত হয়ে মারা গেছেন তিনজন তরুণ শিক্ষার্থী। ১১ হাজার ভোল্টের বিদ্যুতে পুড়ে ছারখার হয়ে গেছে তাদের শরীর। নভেম্বরের শীত সকালে নাঈম, মাহিন ও সাকিবের এমন মৃত্যু স্পর্শ করেছে গোটা দেশের মানুষকে। সবাই হয়তো নতুন করে ভাবতে শুরু করেছেন, এ কেমন দেশ? যে দেশে আনন্দ আয়োজনে যোগ দিতে যাওয়া শিক্ষার্থীদের মরতে হয় কোনো কারণ ছাড়াই!

মাঝেমধ্যে মনে হয় বাংলাদেশ এমন একটি দেশ, যার পদে পদে মৃত্যুঝুঁকি। সড়কের মোড়ে, তে-মাথায়, চৌ-মাথায় ওত পেতে থাকে মৃত্যুদূত। জলে-স্থলে-আকাশ পথে হাজারো মৃত্যুফাঁদ। প্রতিনিয়ত যেগুলো শিকার করছে মানুষের মূল্যবান জীবন, ঝরছে তাজা প্রাণ।

প্রশ্ন হলো, এসব দেখবে কে? কে প্রতিকার করবে? কবে বন্ধ হবে অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুর মিছিল? মাঝেমধ্যে ভীষণ অসহায় লাগে। আহা! কত সম্ভাবনাময় তরুণ প্রাণ অকারণে, হেলায় হারিয়ে যাচ্ছে। এসব প্রাণ আমাদেরর রক্ষা করতে হবে। বন্ধ করতে হবে এই মৃত্যুর মিছিল। যতদিন সড়কে নিরাপত্তা নিশ্চিত না হচ্ছে, ততদিন আমাদেরকেই অধিক সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। নিজের ঝুঁকি নিজেকে যাচাই করতে হবে। আমিতো এ ছাড়া কোনো উপায় দেখি না।

আরেকটি বিষয়। যারা দায়িত্বে অবহেলা ও দুর্নীতি করে মানুষের জীবনকে ঝুঁকিপূর্ণ করেছেন, তারা ভাববেন না মৃত্যু শুধু মোজাম্মেল হোসেন নাঈম, মোস্তাকিম রহমান মাহিন কিংবা জোবায়ের আলম সাকিবকেই তাড়া করেছে। হয়তো সামনের কোনোদিন এমন মৃত্যুর মাতম আপনার পরিবারেও উঠতে পারে। হয়তো শুধু সময়ের অপেক্ষা। আমাদের সড়কে যে মৃত্যুঝুঁকি আমরা নিজেরা তৈরি করেছি, সেই ফাঁদে যে কেউ পড়তে পারেন যেকোনো দিন।

আর তখন হয়তো নতুন করে দায়িত্ব বাড়তে পারে কোনো একজন সোব সিস্টার ফিচার লেখকের। তিনি হয়তো আমার মতোই আবার লিখবেন, এমন হত্যাকাণ্ড আর কত দিন?

রাহাত মিনহাজ: সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা

Comments

The Daily Star  | English

US retailers lean on suppliers to absorb tariffs

Rather than absorbing the cost or immediately passing it on to consumers, many US apparel retailers and brands have turned to their suppliers in Bangladesh, demanding they share the pain

1h ago