ঢাকায় বাদ্যযন্ত্রের খোঁজ মেলে যেখানে

বাদ্যযন্ত্র, সায়েন্সল্যাব,
ছবি: শাদাব শাহরুখ হাই

ঢাকাবাসীর কাছে মিরপুর রোডের সায়েন্স ল্যাব এলাকা মানে গাড়ির তীব্র হর্নের শব্দ, কোলাহলে ভরপুর বিপণি-বিতান আর নিরবচ্ছিন্ন যানজট; যেখানে গেলে যানজটেই বসে থাকতে হয় দীর্ঘ সময়। কিন্তু এই রাজ্যের ভিড়ের রাস্তাতেও কান পাতলে ভিন্ন একটা সুর শোনা যায়, এমন সুর যা আপনাকে নিয়ে যাবে অন্য জগতে।

আমরা কথা বলছি ঢাকার বাদ্যযন্ত্রের সবচেয়ে বড় বিক্রয়কেন্দ্রের কথা, যেখানে প্রতিটি সুরের সঙ্গে কারও না কারও স্বপ্ন জড়িয়ে আছে, যেখানে গিটারের তারে আশা খোঁজেন নতুন সংগীতশিল্পীরা, যেখানে সুরের মূর্ছনা আপনাকে নিয়ে যাবে অন্য জগতে।

তাই, আপনি যদি এমন কেউ হন যে, নিজের প্রথম বাদ্যযন্ত্রটি কেনার জায়গা খুঁজছেন তাহলে যানজট কিছুটা সহ্য করে হলেও সায়েন্স ল্যাবের দোকানগুলোয় যেতে পারেন। ঘুরতে ঘুরতে সেখানে দেখাও হয়ে যেতে পারে প্রিয় কোনো সংগীতশিল্পীর সঙ্গেও।

সায়েন্স ল্যাব এলাকার এই বাদ্যযন্ত্রের দোকানগুলোর বহু পুরোনো কিন্তু একান্ত কিছু গল্প রয়েছে। সবচেয়ে পুরোনো দোকানটির নাম সুরশ্রী। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই পুরান ঢাকার শাঁখারিবাজার থেকে সায়েন্স ল্যাবে এসে তারা নতুন যাত্রা শুরু করে। মূলত সেই সময় থেকেই সায়েন্স ল্যাব এলাকা ধীরে ধীরে বাংলাদেশের সংগীতজগতের হৃৎস্পন্দনের কেন্দ্রে পরিণত হয়। একই ধরনের আরও অনেক দোকান গড়ে ওঠে যেগুলো বছরের পর বছর ধরে শিল্পী ও ভবিষ্যৎ শিল্পীদের হাতে তুলে দিচ্ছে সেরা বাদ্যযন্ত্রটি।

আদি সুরশ্রীর মালিক সুমন সরকার বলেন, 'বাচ্চু ভাই (আইয়ুব বাচ্চু) তার প্রথম ইলেকট্রিক গিটারটি আমাদের কাছ থেকে কিনেছিলেন। তখন সবাই সিঙ্গাপুর থেকে আমদানি করত। আমরাই প্রথম চীন থেকে বাদ্যযন্ত্র আমদানি করতে শুরু করি। চীন ছাড়া এখন সবচেয়ে বেশি আমদানি করা হয় ভারত থেকে। এতে বেশ সাশ্রয়ী দামে বিভিন্ন ধরনের বাদ্যযন্ত্র পাওয়া যায়। এ ছাড়া উচ্চমানসম্পন্ন পণ্যগুলো যুক্তরাষ্ট্র, ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশ থেকে আনা হয়, সেক্ষেত্রে আগে থেকে অর্ডার দিতে হয়।'

আপনি দিনের যখনই এসব দোকানের কোনোটিতে ঢোকেন না কেন, দেখবেন কোনো না কোনো শিক্ষার্থী বা তরুণ গায়ক হয়তো তার জীবনের প্রথম উকুলেলেটি বাজাচ্ছে। কিংবা একদল বন্ধু হয়তো জড়ো হয়েছে অ্যাকোস্টিক গিটারের পাশে, হয়তো তারা কোনটির শব্দ সবচেয়ে ভালো শোনাচ্ছে তা নিয়ে তর্ক করছে।

এসব দোকানের মালিকরাও জানেন, কেমন ক্রেতা কেমন পণ্য চায়, কার চাহিদা কোনটি। সে অনুযায়ীই পণ্য সাজান তারা।

বাদ্যযন্ত্র, সায়েন্সল্যাব,

জেডএস মিউজিক জোনের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর আলী রেজওয়ান বলেন, 'আমাদের প্রাথমিক ক্রেতা হলো শিক্ষার্থীরা। আমরা তাদের আবেগটা বুঝি, তারা হয়তো হাতখরচ থেকে টাকা বাঁচিয়ে শখের বাদ্যযন্ত্র কিনতে আসে। সেজন্য আমরা এসব ক্ষেত্রে সীমিত লাভে পণ্য বিক্রির চেষ্টা করি।'

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সংগীতের ক্ষেত্রে তরুণদের পছন্দের পরিবর্তন হয়েছে। হারমোনিয়াম আর তবলার জায়গায় স্থান করে নিয়েছে গিটার ও উকুলেলে।

এ প্রসঙ্গে সুরশ্রীর ম্যানেজার রনি বর্মন বলেন, 'আগে হারমোনিয়াম আর তবলা ছিল গান গাওয়া শুরু করার জন্য প্রাথমিক বাদ্যযন্ত্র। শুধুমাত্র কিছু মানুষ যারা আধুনিক সংগীতে আগ্রহী ছিলেন, তারা হয় হাওয়াইয়ান গিটার বাজাতেন। এরপর এলো ৯০ এর দশক। তখন জনপ্রিয় হয়ে উঠল স্প্যানিশ গিটার। এখন গত কয়েকবছর ধরে চলছে উকুলেলের জয়জয়কার। তরুণরাও এটা পছন্দ করছেন। কারণ এটা বেশ সাশ্রয়ী।'

আপনি যদি স্থানীয় লোকগীতির অন্যতম অনুষঙ্গ হাতে তৈরি দোতারার খোঁজ চান কিংবা উচ্চমানসম্পন্ন অ্যাকুস্টিক গিটার বা পিয়োনো খোঁজেন, তাহলে সায়েন্স ল্যাবের দোকানগুলো হতে পারে আপনার সঠিক ঠিকানা। ভায়োলিন থেকে শুরু করে কাহন কিংবা ম্যান্ডোলিন থেকে বাঁশি, এমন কোনো বাদ্যযন্ত্র নেই যা সায়েন্স ল্যাবে পাওয়া যায় না।

বাদ্যযন্ত্রের ব্যবসায়ীরা বলছেন, আগের মতো আর ব্যবসার অবস্থা নেই। গত কয়েক বছর ধরেই বেচাকেনা কমছে। বিশেষ করে সাম্প্রতিক সময়ে দেশে চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা পরিস্থিতি আরও খারাপ করে দিয়েছে।

নানা ধরনের অনিশ্চয়তার পরেও সায়েন্স ল্যাবের বাদ্যযন্ত্রের দোকান মালিকরা আশা হারাচ্ছেন না। তারা বলছেন, আপাতত ব্যবসায় কিছুটা ধীরগতি দেখা গেলেও সংগীতপ্রেমীদের কাছে এই দোকানগুলো যে চেতনা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, তা কিছুতেই পরাজিত হবে না।

দোকান মালিকরা আশা করছেন, ঢাকার অন্যান্য অতীত সংকটের মতো এই সংকটও কেটে যাবে। ধীরে ধীরে আবার ছন্দ ফিরে পাবে ঢাকার গানের জগৎ, জেগে উঠবে বাদ্যযন্ত্রের দোকানগুলোও।

অনুবাদ করেছেন শেখ সিরাজুম রশীদ

Comments

The Daily Star  | English

Eid meat: Stories of sacrifice, sharing and struggle

While the well-off fulfilled their religious duty by sacrificing cows and goats, crowds of people -- less fortunate and often overlooked -- stood patiently outside gates, waiting for a small share of meat they could take home to their families

9h ago