‘সত্যিকারের রাজনৈতিক বাধা থেকে আমাদের মনোযোগ সরানো উচিত নয়’

বদরুদ্দীন উমর। ফাইল ছবি: স্টার
বদরুদ্দীন উমর। ফাইল ছবি: স্টার

বামপন্থী লেখক, গবেষক ও রাজনীতিবিদ বদরুদ্দীন উমর। সম্প্রীতি দেওয়া সাক্ষাৎকারে ছাত্র-নেতৃত্বাধীন গণঅভ্যুত্থান এবং বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা বলেছেন তিনি। বদরুদ্দীন উমরের একান্ত সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন দ্য ডেইলি স্টারের অনন্ত ইউসুফ, প্রিয়ম পাল ও শামসুদ্দোজা সাজেন।

রাষ্ট্রযন্ত্রের ব্যাপক দমন-পীড়নের মুখেও সাম্প্রতিক গণঅভ্যুত্থান কীভাবে সফল হলো?

অতীতে বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি গণআন্দোলন সংঘটিত হয়েছে। যেমন: ১৯৫২, ১৯৬৯, ১৯৭১ ও ১৯৯০ সালে। এ বছর আমরা যে দমন-পীড়নের সম্মুখীন হয়েছি, তা সম্ভবত ১৯৬৯ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে সংঘটিত গণঅভ্যুত্থানের সময়কার চেয়েও বেশি। আমরা ১৯৭২ সাল থেকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করে আসছি এবং ২০০৮ সাল থেকে শেখ হাসিনার শাসনামলেও তা করেছি। তবে আওয়ামী লীগের সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলকে একাধিক কারণে প্রশ্নবিদ্ধ করা যায়।

সেনাবাহিনী, পুলিশ ও বিচার বিভাগের মাধ্যমে শেখ হাসিনা তার কর্তৃত্ববাদী শাসন টিকিয়ে রেখেছিল। যে কারণে সংগঠন হিসেবে আওয়ামী লীগকে ভুগতে হয়েছে। এ ছাড়া, দলের শীর্ষ নেতাদের যেন দেশ লুটপাটের লাইসেন্স দিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ফলে তারা প্রতারক ও অবিশ্বস্ত দলে পরিণত হয়। প্রকৃতপক্ষে, এটি শেষ পর্যন্ত দলীয় নেতাকর্মীদেরকে রাজনৈতিক আদেশ ও প্রতিশ্রুতিকে অগ্রাধিকার না দেওয়ার দিকে পরিচালিত করেছিল। শেখ হাসিনার শাসনামলে ইউনিয়ন ও গ্রামপর্যায়ের কয়েকজন রাজনীতিবিদও কোটি কোটি টাকা আয় করেছেন। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সহকারীর সম্পদের পরিমাণ ৩০ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি বলে জানা গেছে।

দেশে করব্যবস্থা কঠোর করা হয়েছিল এবং এর ফলে দেশের মধ্য-নিম্নবিত্তরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে বসবাসকারী মানুষ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কোটি কোটি ডলার বিদেশে পাচার হয়েছে। এটা সাধারণ মানুষের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে সরাসরি টাকা চুরি করার শামিল। সুস্পষ্ট আর্থিক কেলেঙ্কারির পাশাপাশি বাংলাদেশে স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক পরিবেশের সার্বিক পরিস্থিতি সর্বকালের সর্বনিম্ন পর্যায়ে ছিল।

শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বাধীন এই আন্দোলন ছিল সামগ্রিক পরিস্থিতির প্রতিক্রিয়া; এটা কোটা সংস্কারের দাবির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। শেখ হাসিনা আপস করতে চাননি, আর সেটাই আওয়ামী লীগের ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার অন্যতম কারণ। প্রাথমিক বিক্ষোভের পর আইনি পরিবর্তন শুরু হওয়ায় পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছিল। কিন্তু ছাত্রদের সঙ্গে যেভাবে সমঝোতা করা উচিত ছিল, শেখ হাসিনা সরকার সেভাবে করেনি।

জুলাইয়ের ঘটনাগুলো প্রমাণ করেছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দেশে ব্যাপক গণআন্দোলন ঠেকাতে পারছে না। আওয়ামী লীগের উচিত হয়নি তাদের ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে সহিংস কর্মকাণ্ডে অংশ নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া। সাবেক মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের তাদের উসকানি দিয়েছেন বলে মনে হয়।

আপনি কি মনে করেন যে এই গণঅভ্যুত্থান দেশে উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তন আনবে?

ভবিষ্যতে আমূল রাজনৈতিক পরিবর্তন হবে বলে আমি মনে করি না। তবে আমি বিশ্বাস করি, আরেক কর্তৃত্ববাদী সরকারের পক্ষে ক্ষমতায় আসা কঠিন হবে। আওয়ামী লীগের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা যেভাবে দেশকে ধ্বংস করেছেন, তা অত্যন্ত লজ্জাজনক। এমন ঘটনা আগে কখনো ঘটেনি। পূর্ববর্তী এমপিদের বেশিরভাগই রাজনীতিবিদ হওয়ার আগে ব্যবসায়ী ছিলেন। যদিও আমি ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে আছি, তবে আমি নিশ্চিত নই যে আমাদের যেমন রাজনৈতিক পরিবর্তন প্রয়োজন তা শুরু করা হবে। আমি মনে করি না যে আমাদের অর্থনীতি ও শিক্ষাখাতে আগামী বছরগুলোতে আমূল কোনো পরিবর্তন আসবে।

এখন দেখার বিষয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ও অন্যান্য প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো কী উদ্যোগ নেয়। অনেকে বিএনপিকে পছন্দ নাও করতে পারেন। তবে তারা এখনো দেশের অন্যতম শক্তিশালী দল এবং নির্বাচনের সময় অবশ্যই তারা অংশ নিতে চাইবে। বিএনপি-জামায়াত ছাত্র আন্দোলনকে সমর্থন করলেও ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আমলে তারা বৈধ রাজনৈতিক ক্ষমতা খুঁজবে।

প্রতীকী ছবি: স্টার
প্রতীকী ছবি: স্টার

শেখ হাসিনা পরিবারতন্ত্রের রাজনীতিকে এমন পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন যা আমরা কল্পনাও করতে পারিনি। শেখ মুজিবের সাবেক বাসভবনে যা ঘটেছে তা দুর্ভাগ্যজনক। তবে আমি বলব, এই ঘটনার জন্য শেখ হাসিনা আংশিকভাবে দায়ী। শেখ মুজিবের নাম এবং শেখ পরিবারের সংশ্লিষ্টতাকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়েছে। আওয়ামী লীগের ব্যাপক দুর্নীতি শেখ মুজিবের সুনামকে ক্ষুণ্ণ করেছে। শেখ হাসিনার উচিত ছিল তার বাবার সুনামের দিকে মনোযোগ দেওয়া এবং উপলব্ধি করা যে, তিনি ক্ষমতায় আছেন, তার বাবা নয়। প্রতিটি সভা এবং বাংলাদেশ দূতাবাসে শেখ মুজিবের ছবি ব্যবহার করে আওয়ামী লীগের লুটপাটকে শেখ মুজিবের আন্তর্জাতিক মর্যাদার সঙ্গে যুক্ত করার একটি আখ্যান তৈরি করা হয়েছিল।

এটাও বুঝতে হবে, ভারতের সম্পর্ক বাংলাদেশের সঙ্গে নয়, আওয়ামী লীগের সঙ্গে। বিজেপি নেতৃত্বাধীন সরকার প্রকাশ্যে আওয়ামী লীগকে সমর্থনের ঘোষণা দিয়েছে। শেখ হাসিনা কখনো ভারতের দাবি উপেক্ষা করেননি এবং সে কারণেই ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর দেশটি তাকে আশ্রয় দিয়েছে। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর পার্লামেন্টে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলেছেন। জয়শঙ্কর আন্দোলনের সময় কতজন প্রাণ হারিয়েছেন তার ওপর জোর দেননি, পরিবর্তে তার সরকার কর্তৃক অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত বিষয়গুলোতে মনোনিবেশ করেছেন।

ভারতের কথায় কর্ণপাত না করা বাংলাদেশের জন্য কঠিন। একইভাবে, ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখার চেষ্টা করে। কারণ, ভারতের সঙ্গে তার বেশিরভাগ প্রতিবেশীর দৃঢ় বন্ধন নেই। সুতরাং ঢাকার ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ অনুযায়ী ভারত তার পরবর্তী উদ্যোগ নেবে। রাজনৈতিক উত্থান-পতনের মধ্যে আওয়ামী লীগের সঙ্গে কীভাবে যোগাযোগ করা যায়, নয়াদিল্লি নিশ্চয়ই তা ভাবছে। নিঃসন্দেহে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোরও এ ক্ষেত্রে এক ধরনের প্রচেষ্টা থাকবে।

আওয়ামী লীগের ভাগ্য কি মুসলিম লীগের মতো হতে পারে, নাকি তারা আবারও ঘুরে দাঁড়াবে?

আওয়ামী লীগ ফিরতে পারবে বলে আমি মনে করি না। শেখ হাসিনা ছিলেন দলের প্রতিনিধিত্বকারী। সত্যিকার অর্থে সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতিতে তিনি দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ায় শিগগির দলটির মূলধারার রাজনীতিতে ফিরে আসার ব্যাপারে অনুমান করা কঠিন। দুঃখজনক হলেও সত্য, আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা আধুনিক রাজনীতির জন্য উপযুক্ত ছিলেন না।

বাংলাদেশের পরিবর্তিত রাজনৈতিক দৃশ্যপটের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে না পারার কারণে মুসলিম লীগের পতন হয়েছিল এবং আওয়ামী লীগের ঠিক একই অভিজ্ঞতা হয়েছে। আজ নির্বাচনে অংশ নিলে আওয়ামী লীগ কি বৈধভাবে আসন পাবে? আমার মনে হয় না।

১৯৫০-এর দশকে আওয়ামী লীগ আবির্ভূত হয় এবং ১৯৫৪ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে যুক্তফ্রন্ট (আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোট) সরকারের পতন হয়। এরই ধারাবাহিকতায় এক দশকেরও বেশি সময় ধরে দলের কাঠামো নিয়ে কাজ করা হয়। ১৯৬৯ সাল নাগাদ আওয়ামী লীগ সংগঠিত হয় এবং দুই বছর পর ১৯৭১ সালে এটি রাজনৈতিকভাবে জনগণের সমর্থনে পায়। ২০২৪ সালের আন্দোলনও ১৯৫২ সালের আন্দোলনের মতো—যেখানে কোনো রাজনৈতিক দল নেতৃত্ব দেয়নি।

২০২৪ সালের আন্দোলন ছিল ছাত্রদের নেতৃত্বে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান ড. ইউনূস কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব নন। আমি অতীতে ড. ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংককে নিয়ে লিখেছি। যুক্তরাষ্ট্র তার ক্ষুদ্র ঋণ কর্মসূচিকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করে। কিন্তু কার্যকর রাজনৈতিক সংস্কারের মাধ্যমে প্রকৃত পরিবর্তন আসে। ড. ইউনূসের প্রতি আন্তর্জাতিক খ্যাতনামা সংস্থাগুলোর সমর্থনও রয়েছে।

আমাদের বর্তমান উপদেষ্টারা একটি রাজনৈতিক শূন্যতার মুখোমুখি। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আমাদের প্রকৃত প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক পরিবর্তন আনার ক্ষেত্রে অনেক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি আছেন। যেখানে রাষ্ট্র কাঠামোর কথা বলা হয়, সেখানে তা সংশোধন করতে হলে সাংবিধানিক ও সংসদীয় উপাদান দরকার। সুতরাং, আমাদের এমন সংসদ সদস্য প্রয়োজন, যারা এই পরিবর্তন আনার ক্ষেত্রে নির্ভরযোগ্য ও সৎ। এমনটা হবে কি না, তা নিয়ে আমি যথেষ্ট সন্দিহান।

ভবিষ্যতে ছাত্রদের দল গঠনের সম্ভাবনা সম্পর্কেও আমি সচেতন। এটি অর্জন করা কঠিন হতে পারে। কারণ, শিক্ষার্থীদের এখনো আওয়ামী লীগ, বিএনপি বা জামায়াতের মতো দৃঢ় সামাজিক ভিত্তি নেই। আমার একটি দ্বিধার জায়গা আছে যে, শিক্ষার্থীরা এটি অর্জন করতে সক্ষম হবে কি না—যদিও তারা এখন পর্যন্ত ভালো করছে এবং তাদের মধ্যে তিনজন বর্তমান উপদেষ্টা পরিষদে রয়েছেন। আমি বিশ্বাস করি যে তারা এটি করার চেষ্টা করবে।

বর্তমান প্রেক্ষাপটে গণপরিষদ গঠনের সম্ভাবনা আছে কি?

আমাদের সংবিধান বেশ কয়েকবার সংশোধন করা হয়েছে এবং এর ইতিহাস বিতর্কিত। বাংলাদেশের সংবিধান ইয়াহিয়া খান মনোনীত কাউন্সিল থেকে এসেছে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের কথা আমরা সবাই জানি, যখন রাজনৈতিক পালাবদল হয়েছিল। পরের বছর মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়, যা জনগণের মধ্যে কিছু রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা জাগিয়ে তোলে। সেই আকাঙ্ক্ষা কি বাংলাদেশের মূল সংবিধানে প্রতিফলিত হয়েছিল? বিষয়টি নিয়ে আমি খুব নিশ্চিত নই।

স্বাধীনতার পর মুক্তিযুদ্ধে সহায়তাকারী অনেক ব্যক্তিত্বকে আর সামনে আসতে দেওয়া হয়নি। বরং ১৯৭০ সালের নির্বাচনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সামনে আনা হয়েছে। আমার মতে এই কাজটি ছিল অবৈধ কিছু করার মতো। এটি আমাদের ১৯৭২ সালের সংবিধানের বিষয়বস্তুকে প্রভাবিত করেছিল। আমার মতে, আমাদের সংবিধানকে পুরোপুরি ঢেলে সাজানো দরকার। এর জন্য প্রবল রাজনৈতিক ভিত্তিও প্রয়োজন, যা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নেই। সুষ্ঠু নির্বাচন হলেও কি সংশোধনী আনা হবে এবং তা গৃহীত হবে? এটা কল্পনা করা কঠিন।

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর হিন্দুদের ওপর হামলার পেছনে কী উদ্দেশ্য ছিল?

৫ আগস্টের পর বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর হামলা হয়েছে। এটা দুঃখজনক এবং এটা বন্ধ করতে হবে। আমাদের দেশে মুসলমানরাও একই ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন। সেটাও গণমাধ্যমে প্রচার করতে হবে। আর বাংলাদেশে হিন্দুদের প্রতি সহিংসতাকে রাজনৈতিক রূপ দিলে চলবে না। দুর্নীতি ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বর্তমানে বাংলাদেশের সবাইকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। আমাদের অবশ্যই সাম্প্রদায়িক রাজনীতি থেকে সরে আসতে হবে, বিশেষ করে এমন এক সময়ে যখন রাজনৈতিক পরিবর্তন দেখার জন্য আমাদের তরুণরা অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছে।

আমাদের অবশ্যই এই ধরনের রাজনৈতিক বক্তব্যের অবসান ঘটাতে হবে। কারণ, শেষ পর্যন্ত এর ফলে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সাধারণ বাংলাদেশিরা ধর্মনিরপেক্ষ এবং ১৯৪৭ সাল থেকে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধে। 'সাধারণ বাংলাদেশিরা হিন্দু-বিরোধী'—সাম্প্রতিক সময়ে ভারত সরকার এমন ধারণাকে আরও জোরদার করেছে। হেফাজত ও জামায়াত আমাদের দেশের কমিউনিস্ট ও গণতন্ত্রমনাদের বিরোধিতা করে, বাংলাদেশি হিন্দুদের নয়। এটি বিবেচনা করার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

ঐক্যবদ্ধ জাতি হিসেবে আমরা প্রকৃতপক্ষে যেসব রাজনৈতিক বাধার সম্মুখীন হচ্ছি, সেখান থেকে আমাদের দৃষ্টি সরিয়ে নেওয়া উচিত হবে না। জুলাইয়ের গণআন্দোলনে মুসলমানদের পাশাপাশি হিন্দুরাও অংশগ্রহণ করেছে। এই মুহূর্তে আমাদের অবশ্যই অতীতের রাজনৈতিক কূটকৌশলে লিপ্ত হওয়ার পরিবর্তে পার্থক্য কমানোর চেষ্টা করতে হবে। হিন্দু-মুসলিম বিভাজন দশকের পর দশক উপমহাদেশজুড়ে বহু মানুষের জীবনকে প্রভাবিত করেছে। ১৯৯৬ সালে জামায়াতের সমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগ হেফাজতকেও সহযোগিতা করেছে বহু বছর ধরে। এ ধরনের রাজনৈতিক প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা ও সমঝোতার ক্ষেত্রে আমাদের অবশ্যই খুব সতর্ক থাকতে হবে।

গণতন্ত্র রক্ষায় এখন কী ধরনের উদ্যোগ নেওয়া উচিত?

কোটাবিরোধী আন্দোলন পরবর্তীতে রূপ নেয় গণঅভ্যুত্থানে। ফাইল ছবি: স্টার
কোটাবিরোধী আন্দোলন পরবর্তীতে রূপ নেয় গণঅভ্যুত্থানে। ফাইল ছবি: স্টার

বড় আকারের পরিবর্তনের জন্য একটি সামাজিক বিপ্লব প্রয়োজন, যার ফলস্বরূপ আসবে প্রতিশ্রুতি ও সঠিক উদ্দেশ্য। একটি সংগঠিত রাজনৈতিক দলের ক্ষমতায় থাকা এখন সময়ের দাবি। লেনিন সাধারণ জনগণের সংহতিতে দৃঢ় বিশ্বাসী ছিলেন। বাংলাদেশে এখন আমাদের যা প্রয়োজন তা হলো এমন একটি প্লাটফর্ম, যা হবে গণমানুষের চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এ ধরনের একটি কাঠামোর মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে এবং সত্যিকার অর্থে মৌলিক পরিবর্তনের পথ প্রশস্ত করতে হবে। স্বার্থান্বেষী মহল ও দুর্নীতি নির্মূল করতে হবে। অতীতের অবিশ্বাস ও ভ্রান্ত ধারণার রাজনীতির দিকে আমাদের তাকাতে হবে। অবশ্য কাজটা সহজ হবে না।

সত্তর ও আশির দশকে বাংলাদেশের অনেকেই আশাবাদী ছিলেন। ছাত্ররাজনীতি করার ক্ষেত্রে সাধারণ ব্যক্তিরাই এগিয়ে আসতেন। আজ আর সেই অবস্থা নেই। মেধাবী ছাত্রদের অধিকাংশই বাংলাদেশের রাজনীতির ভবিষ্যৎ নিয়ে আশাবাদী নন।

অতীতের ছাত্ররাজনীতি সামগ্রিক সামাজিক-রাজনৈতিক কারণগুলোর ব্যাপারে অনেক বেশি উদ্বিগ্ন ছিল। মূলত, ব্যক্তির অধিকারে রাষ্ট্রের বিরোধিতার কারণেই এই কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরু হয়েছিল, যদিও এর সঙ্গে সামগ্রিক কিছু ব্যাপারও ছিল। মনে রাখতে হবে, কোটা সংস্কার আন্দোলন প্রাথমিকভাবে বাংলাদেশের প্রগতিশীল রাজনীতির দাবি থেকে উদ্ভূত হয়নি। ২০০৮ সাল থেকে আওয়ামী লীগের দুঃশাসনের কারণে চাকরির অভাবের প্রতিবাদে এটি শুরু হয়েছিল এবং জনসাধারণের মধ্যে অনুরণিত হয়েছিল। বিক্ষোভের পর সরকারের প্রতিক্রিয়া জনগণকে আরও ক্ষুব্ধ করে তোলে এবং এর ফলে একটি গণআন্দোলন শুরু হয়। অতীতের আশাবাদী চরিত্র অর্জনের জন্য ছাত্ররাজনীতি দরকার, যেখানে নৈরাশ্যবাদের পরিবর্তে আসবে ভবিষ্যতে ইতিবাচক কিছু করার ভাবনা।

১৯৯১ সাল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে নির্বাচন হচ্ছে না। ১৯৯১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় এলে ছাত্র হলগুলোতে তাদের ছাত্র সংগঠন হামলা চালায়। এরপর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ পুনরায় ক্ষমতায় আসে এবং এর ফলে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলেও একই চিত্র দেখা দেয়। এই প্রবণতা চক্রাকারে চলছে। আংশিকভাবে কোটা সংস্কার আন্দোলন ছাত্রলীগের মতো নিপীড়কদের বিরুদ্ধেও ছিল।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পুনরায় নির্বাচনের আয়োজন করতে হবে। বিশ্বাসযোগ্য ছাত্র ইউনিয়ন গঠন করা আবশ্যক এবং শিক্ষার্থীদের অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ দিতে হবে। শিক্ষকদের বিভাজনের রাজনীতিতে অংশ নেওয়া উচিত নয়। তাদের অবশ্যই নির্ভরযোগ্য শিক্ষাবিদ হিসেবে নিজেদের গড়ে তোলার দিকে মনোযোগ দিতে হবে এবং গবেষণার মতো বিষয়গুলোতে মনোনিবেশ করতে হবে। আসলে মানসম্পন্ন শিক্ষকের অভাবে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে অনেক অধ্যাপক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, কিন্তু দুঃখজনক বাস্তবতা হচ্ছে বাংলাদেশে শিক্ষার মান অনেক নিচে নেমে গেছে। প্রকৃতপক্ষে যে প্রয়োজনীয় পরিবর্তনগুলো আমাদের দরকার, আমাদের অবস্থান এখনো সেগুলোর বিপরীতে।

ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করা উচিত বলে আমি মনে করি না। শিক্ষার্থীরা কেন এ ধরনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবে? বাংলাদেশের ছাত্ররাজনীতিকে যথাযথ দিকনির্দেশনা দিতে হবে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আজ যেসব দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা ঘটছে, তা দুঃখজনক। আমাদের সময় পরিস্থিতি এমন ছিল না।

Comments

The Daily Star  | English

Teknaf customs in limbo as 19 mt of rice, authorised by AA, reaches port

The consignment of rice weighing 19 metric tonnes arrived at Teknaf land port on Tuesday evening with the documents sealed and signed by the Arakan Army

2h ago