বাংলাদেশের সংবিধান: সংশোধন ও বাতিলের বৃত্ত
সংবিধান সংশোধন একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। কিন্তু বাংলাদেশের সংবিধান সংশোধনের সঙ্গে 'বাতিল' শব্দটিও এখন ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছে। কেননা সংবিধানে এখন পর্যন্ত যে ১৭ বার সংশোধনী আনা হয়েছে, তার মধ্যে সবচেয়ে বড় সংশোধনীগুলোই হয় সর্বোচ্চ আদালতে বাতিল হয়েছে, না হয় আদালতে বিচারাধীন কিংবা আদালতে বাতিল হওয়ার পরে সেটিও চ্যালেঞ্জড হয়েছে।
২০১১ সালে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ১৯৭২ সালের সংবিধানের মূলনীতি ফিরিয়ে আনাসহ আরও যেসব পরিবর্তন আনা হয়েছিল, সেটিও আদালতে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে এবং এই সংশোধনীটিও শেষ পর্যন্ত অবৈধ ঘোষণা হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বাংলাদেশের সংবিধান কেন এরকম সংশোধন ও বাতিলের বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছে? সংবিধান সংশোধনের প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক ঐকমত্য ছিল না বলে? যদি তাই হয়, তাহলে গত ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর থেকে সংবিধানে যে আমূল পরিবর্তন, এমনকি অনেকগুলো অনুচ্ছেদ পুনর্লিখনের কথা বলা হচ্ছে; অন্তর্বর্তী সরকারের 'প্রাথমিক নিয়োগকর্তা' হিসেবে স্বীকৃত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের কেউ কেউ বর্তমান সংবিধানকে 'মুজিববাদী' এবং 'আওয়ামী লীগের সংবিধান' আখ্যা দিয়ে একে ছুঁড়ে ফেলার কথা বলছেন—তার ধারাবাহিকতায় যদি এবারও সংবিধানে বড় ধরনের পরিবর্তন আনা হয়, সেটিও কি ভবিষ্যতে টিকবে? নাকি সেই সংশোধনীও আদালতে চ্যালেঞ্জড হবে এবং বাতিল হয়ে যাবে? এই আশঙ্কা থেকেই কি নতুন করে সংবিধান লেখার কথা বলা হচ্ছে?
মুশকিল হলো, নতুন করে সংবিধান লেখার সাংবিধানিক এখতিয়ার বা ম্যান্ডেট অন্তর্বর্তী সরকারের নেই। আবার পরবর্তী জাতীয় সংসদও নতুন করে সংবিধান লিখতে পারবে না। বরং দুই-তৃতীয়াংশ সংসদ সদস্যের সম্মতি থাকলে সংবিধানে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনা যাবে। কিন্তু সংবিধান নতুন করে লিখতে গেলে বা পুনর্লিখন করতে গেলে গণপরিষদ গঠন করতে হবে। সেজন্য নির্বাচন দিতে হবে। নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে গণপরিষদ গঠন করে সেখানে নতুন করে সংবিধান লিখতে হবে। কিন্তু সেই পথে যাওয়ার মতো বাস্তবতা আছে কি না, বা গণপরিষদ গঠন করে সংবিধান পুনর্লিখন ইস্যুতে রাজনৈতিক ঐকমত্য গড়ে তোলা যাবে কি না—সেটা বিরাট প্রশ্ন। সেই তর্কে না গিয়ে বাংলাদেশের সাংবিধানিক যাত্রায় সংশোধন ও বাতিলের প্রেক্ষাপট নিয়ে আলোকপাত করা যাক।
সংবিধানে এ যাবত যে ১৭ বার সংশোধনী আনা হয়েছে, তার মধ্যে পঞ্চম, সপ্তম, অষ্টম, ত্রয়োদশ এবং সবশেষ ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ বলে রায় দিয়েছেন দেশের সর্বোচ্চ আদালত। এর মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধানসম্বলিত ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায়ের রিভিউ বা পুনর্বিবেচনার আবেদন করেছে তিনটি পক্ষ। সেই রিভিউয়ের ওপর শুনানি হবে আগামী ১৭ নভেম্বর। যদি রিভিউতে ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায়টি অবৈধ ঘোষণা করা হয়, তাহলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহাল হবে বলে মনে করা হয়।
যদিও সেখানে জটিলতা থেকে যাবে পঞ্চদশ সংশোধনীর কারণে। কেননা পঞ্চদশ সংশোধনীর সময়েও তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাটি বাতিল করে দেওয়া হয় এবং বর্তমান সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কোনো বিধান নেই। সম্প্রতি পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল চেয়েও উচ্চ আদালতে রিট করা হয়েছে।
সংশোধনীর ধারাবাহিকতা
বাংলাদেশের সংবিধানে প্রথম সংশোধনী আনা হয় সংবিধান প্রণয়নের আট মাসের মাথায়—১৯৭৩ সালের ১৫ জুলাই যুদ্ধাপরাধ ও অন্যান্য অপরাধের বিচারের জন্য। অভ্যন্তরীণ বা বহিরাক্রমণ গোলযোগে দেশের নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক জীবন বিপন্ন হলে সে অবস্থায় জরুরি অবস্থা ঘোষণার বিধান করতে সংবিধানে দ্বিতীয় সংশোধনী আনা হয় ১৯৭৩ সালের ২০ সেপ্টেম্বর। তৃতীয় সংশোধনী আনা হয় এর এক বছর পরে ১৯৭৪ সালের ২১ নভেম্বর—বাংলাদেশ ও ভারতের সীমানা নির্ধারণী একটি চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য। প্রথম এই তিনটি সংশোধনী কখনো আদালতে চ্যালেঞ্জড হয়নি বা অবৈধ ঘোষিত হয়নি।
বাংলাদেশের সংবিধানে প্রথম সবচেয়ে বড় ও বিতর্কিত সংশোধনী আনা হয় ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি। এদিন সংবিধানে চতুর্থ সংশোধনী এনে সংসদীয় গণতন্ত্র বাতিল করে রাষ্ট্রপতিশাসিত এবং একদলীয় শাসনব্যবস্থা চালু করা হয়। বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল) নামে একটি নতুন রাজনৈতিক দল বা একটি নতুন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা চালুর মধ্য দিয়ে দেশের সব রাজনৈতিক দলের কার্যক্রম কার্যত বন্ধ করে দেওয়া হয়। এই সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রপতিকে একচ্ছত্র ক্ষমতাবান করা হয়।
একটি বিশেষ পরিস্থিতিতে সংবিধানে এই বিরাট পরিবর্তন আনা হলেও এটি দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। কেননা একদলীয় শাসনব্যবস্থা চালুর সাত মাসের মাথায় সপরিবারে নিহত হন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এরপরও দেশে রাষ্ট্রপতিশাসিত ব্যবস্থা বহাল থাকলেও একদলীয় শাসনের অবসান ঘটে। বহুদলীয় ব্যবস্থা পুনরায় চালু হয়। অর্থাৎ আদালতে এই সংশোধনী চ্যালেঞ্জড না হলেও বা আদালত এই সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা না করলেও কার্যত চতুর্থ সংশোধনী পরবর্তী রাজনৈতিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাতিল হয়ে গেছে।
কিন্তু তারপরও সম্প্রতি চতুর্থ সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে মুক্তিযোদ্ধা মোফাজ্জল হোসেনের পক্ষে রিট আবেদন করেছেন একজন আইনজীবী—যেখানে এই সংশোধনীকে 'বেআইনি, চরম বিভ্রান্তিকর এবং বাংলাদেশের সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ' ঘোষণার দাবি জানানো হয়েছে। ২৭ অক্টোবর হাইকোর্টের একটি বেঞ্চে এর ওপর শুনানি হতে পারে বলে জানা গেছে।
বাস্তবতা হলো, এই সংশোধনীকে উচ্চ আদালত যদি এখন অবৈধ বলে ঘোষণাও করেন, তাতে কিছু যায় আসে না। কারণ চতুর্থ সংশোধনীর কোনো প্রাসঙ্গিকতাই এখন আর নেই। অর্থাৎ যে সংশোধনীটি বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পরে বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং ১৯৯১ সালে দেশে পুনরায় সংসদীয় ব্যবস্থা চালুর মধ্য দিয়ে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাতিল হয়ে গেছে, প্রায় অর্ধ শতাব্দী পরে সেই সংশোধনী আদালতে চ্যালেঞ্জ করার নেপথ্যে কোনো একটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকলেও আখেরে এর কোনো সাংবিধানিক গুরুত্ব নেই। কেননা এই সংশোধনীটি বাতিল হোক বা না হোক, তার মধ্য দিয়ে দেশের সংবিধান বা সরকারকাঠামোর কোনো পরিবর্তন হবে না।
পঞ্চম সংশোধনী বাতিল, তবে 'বিসমিল্লাহ' বহাল
বাংলাদেশের সংবিধানে এ পর্যন্ত যে ১৭ বার সংশোধনী আনা হয়েছে, তার মধ্যে জিয়াউর রহমানের আমলে আনা পঞ্চম সংশোধনী একটি বিরাট কেসস্টাডি। কেননা এই সংশোধনীর মধ্য দিয়ে ১৯৭২ সালের সংবিধানের মূলনীতিতে পরিবর্তন আনা হয়। সংবিধানের প্রারম্ভে 'বিসমিল্লাহ' যুক্ত করা হয় এবং কয়েকটি সামরিক অধ্যাদেশ পাস তথা সামরিক শাসনের বৈধতা দেওয়া হয়। তবে ২০০৫ সালের ২৯ আগস্ট হাইকোর্ট এই সংশোধনী অবৈধ বলে রায় দেন। অবশ্য এই সংশোধনীর মাধ্যমে আনা পরিবর্তনগুলোকে অবৈধ বলে ঘোষণা করা হলেও পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের প্রারম্ভে যে 'বিসমিল্লাহ' যুক্ত করা হয়েছিল, আদালত সেটি বাতিল করেননি। পরে আপিল বিভাগও হাইকোর্টের ওই রায় বহাল রাখেন।
অবৈধ হলো সপ্তম সংশোধনীও
১৯৮১ সালের ৩০ মে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান চট্টগ্রামে নিহত হলে ওইদিনই উপরাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তার অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব নেন। রাষ্ট্রপতি পদে তিনি যাতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেন, সেজন্য সংবিধানে ষষ্ঠ সংশোধনী আনা হয়। ১৯৮১ সালের ৮ জুলাই সংশোধনীটি গৃহীত হয়।
পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে জিয়াউর রহমান যেমন তার আমলের সব সামরিক ফরমানের বৈধতা দিয়েছিলেন, সপ্তম সংশোধনীর মাধ্যমে হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদও সেরকম ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চের পর থেকে ১৯৮৬ সালের ৯ নভেম্বর পর্যন্ত যেসব সামরিক আদেশ জারি করেছিলেন, সেগুলোর অনুমোদন দেন। সপ্তম সংশোধনী গৃহীত হয় ১৯৮৬ সালের ১০ নভেম্বর। তবে ২০১০ সালের আগস্ট মাসে হাইকোর্ট সপ্তম সংশোধনী বাতিল করে রায় দেন। যা পরবর্তীতে আপিল বিভাগও বহাল রাখেন। এই রায়ের মধ্য দিয়ে এরশাদের ক্ষমতা দখল অবৈধ হয়ে যায়।
অষ্টম সংশোধনী বাতিল হলেও রাষ্ট্রধর্ম বহাল
বাহাত্তর সালের মূল সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম বলে কিছু ছিল না। কিন্তু ১৯৮৮ সালে হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদ সংবিধানে অষ্টম সংশোধনী এনে '২ক' নামে একটি নতুন অনুচ্ছেদ যুক্ত করে রাষ্ট্রধর্মের বিধান করেন। ১৯৮৮ সালের ৭ জুন অষ্টম সংশোধনী বিল পাস হয়। এই সংশোধনীর মাধ্যমে এরশাদ দুটি উদ্দেশ্য সিদ্ধি করতে চেয়েছিলেন; প্রথমত ইসলামের নাম ব্যবহারের মাধ্যমে দেশের ধর্মভীরু সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সমর্থন আদায় এবং দ্বিতীয়ত, বিচার বিভাগের বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে তার সরকারের অন্যতম প্রধান প্রতিপক্ষকে দুর্বল করে দেওয়া। কেননা এরশাদ সরকার শুরু থেকেই বৈধতার সংকটে ভুগছিলেন। তার বৈধতার সংকট যেমন তীব্র ছিল, তেমনি বিরোধীদের সঙ্গেও বিরোধ ছিল তুঙ্গে।
কিন্তু প্রায় সব বিরোধী দল এবং বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় অষ্টম সংশোধনীর তীব্র বিরোধিতা করে। সর্বপ্রথম পেশাগত প্রতিবাদ শুরু হয় আইনজীবীদের ভেতর থেকে। তারা আদালত বর্জনসহ মিছিল-মিটিং করে প্রতিবাদ জানান। তাদের প্রতিবাদের মূল কারণ ছিল, এই সংশোধনীর মধ্য দিয়ে ঢাকার বাইরেও হাইকোর্টের বেঞ্চ স্থাপন করা হয়। যদিও শেষ পর্যন্ত এরশাদ ওই বিরোধিতা সামাল দিতে পারেননি। তাছাড়া অষ্টম সংশোধনীর যে অংশটুকুর দ্বারা হাইকোর্ট সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল, উচ্চ আদালত সেটি অবৈধ বলে রায় দেন। কিন্তু রাষ্ট্রধর্ম বাতিল করা হয়নি।
নবম থেকে দ্বাদশ
সংবিধানের নবম সংশোধনী গৃহীত হয় ১৯৮৯ সালের ১০ জুলাই। এ সংশোধনীর মাধ্যমে উপরাষ্ট্রপতি পদে সরাসরি নির্বাচনের বিধান করা হয়। এ ছাড়া, রাষ্ট্রপতি পদে একই ব্যক্তি দুই মেয়াদের বেশি থাকতে পারবেন না বলে বিধান করা হয়।
জাতীয় সংসদে নারীদের জন্য ৩০টি আসন সংরক্ষিত ছিল। ১৯৯০ সালের ১২ জুন দশম সংশোধনীর মাধ্যমে এই ব্যবস্থা আরও ১০ বছরের জন্য সংরক্ষণ করা হয়।
১৯৯০ সালে গণআন্দোলনের মুখে এরশাদ পদত্যাগ করার আগে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদকে উপ-রাষ্ট্রপতি নিয়োগ করে এরশাদ তার কাছে পদত্যাগ করেন। বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদ দেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা করেন। ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর থেকে ১৯৯১ সালের ৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তিনি অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব পালন করেন। তার উপরাষ্ট্রপতি হিসেবে নিয়োগ এবং ওই সময়ে তার সব কাজ অনুমোদনের জন্য একাদশ সংশোধনীর প্রয়োজন হয়। এই সংশোধনীর ফলে উপরাষ্ট্রপতি পদে তার সব কার্যকলাপ বৈধতা পায় এবং তার স্বপদে (প্রধান বিচারপতি) ফিরে যাওয়ার পথ প্রশস্ত হয়। একাদশ সংশোধনী গৃহীত হয় ১৯৯১ সালের ৬ আগস্ট।
সরকারি ও বিরোধী—উভয় রাজনৈতিক দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে যে বড় সংশোধনী আনা হয়েছিল, তার একটি ১৯৯১ সালের দ্বাদশ সংশোধনী। এই সংশোধনী প্রধানমন্ত্রীশাসিত সংসদীয় শাসনব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করে।
বিতর্কের কেন্দ্রে তত্ত্বাবধায়ক সরকার
সংবিধানে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত করার জন্য একটি রক্তক্ষয়ী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ১৯৯৬ সালের ২৬ মার্চ সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বিল সংসদে পাস হয়। তবে যে দলটি (আওয়ামী লীগ) এই ব্যবস্থা চালুর জন্য সবচেয়ে সোচ্চার ছিল—তারাই ২০১১ সালে সংবিধানে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধানটি বাতিল করে দেয়। ওই বছরের ১০ মে ত্রয়োদশ সংশোধনী অবৈধ বলে রায় দেন আপিল বিভাগ এবং তৎকালীন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের দাবি, তারা আদালতের রায়ের আলোকেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান বাতিল করেছে।
৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায় অবৈধ বলে ঘোষণার দাবি করে তিনটি রিভিউ আবেদন করা হয়েছে। এর মধ্যে একটি রিট করা হয়েছে বিএনপির তরফে, একটি জামায়াতের পক্ষ থেকে এবং আরেকটি আবেদন করেছেন সুজনের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারসহ পাঁচজন বিশিষ্ট নাগরিক। এই তিনটি রিভিউয়ের ওপরেই আগামী ১৭ নভেম্বর আপিল বিভাগে শুনানি হওয়ার কথা রয়েছে।
২০০৪ সালের ১৬ মে চতুর্দশ সংশোধনী এনে সংসদের নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন ৩০টি থেকে বাড়িয়ে ৪৫টি করা হয় ১০ বছরের জন্য সংরক্ষিত রাখার বিধান করা হয়। একইসঙ্গে এই সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারপতিদের বয়স সীমা ৬৫ বছর থেকে বাড়িয়ে ৬৭ করা হয়। পিএসসির চেয়ারম্যান ও সদস্যদের বয়স সীমাও ৬২ বছর থেকে বাড়িয়ে ৬৫ বছর করা হয়।
পঞ্চদশ: সবচেয়ে আলোচিত সংশোধনী
২০১১ সালের ৩০ জুন জাতীয় সংসদে পাস হয় সংবিধানের সবচেয়ে আলোচিত পঞ্চদশ সংশোধনী—যার মধ্য দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা হয় এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে জাতির পিতা হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এ ছাড়া, জাতীয় সংসদে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন সংখ্যা ৪৫ থেকে বাড়িয়ে ৫০ করা হয়; সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতা পুনর্বহাল করা হয়। রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার নীতিও পুনর্বহাল করা হয়।
এই সংশোধনীর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হলো, সংবিধানের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ অনুচ্ছেদকে মৌলিক কাঠামোর অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে এগুলো সংশোধন অযোগ্য বলে ঘোষণা করা হয়।
রিভিউতে বহাল ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়
বাহাত্তরের মূল সংবিধানে বিচারকদের অপসারণ সম্পর্কিত ৯৬ অনুচ্ছেদে বিধান ছিল, কোনো বিচারকের বিরুদ্ধে অসদাচরণ বা অসামর্থ্যের প্রমাণ পেলে এবং সংসদের মোট সদস্যের অন্যূন দুই-তৃতীয়াংশ সদস্য ভোট দিলে রাষ্ট্রপতির আদেশে ওই বিচারককে অপসরণ করা যাবে। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ২৪ জানুয়ারি সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে এ ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে অর্পণ করা হয়। ওই বছরের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার মধ্য দিয়ে চতুর্থ সংশোধনীও কার্যত অচল হয়ে যায়। কেননা ওই সংশোধনীর মাধ্যমে যে রাজনৈতিক ব্যবস্থা চালু করা হয়েছিল সেটি বাতিল হয়ে যায়। সঙ্গত কারণেই বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতাও আর রাষ্ট্রপতির হাতে থাকে না। এমতাবস্থায় ১৯৭৭ সালের ২৭ নভেম্বর সামরিক ফরমান বলে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বিধান করেন জিয়াউর রহমান; পরে যা পঞ্চম সংশোধনীতে অন্তর্ভুক্ত হয়।
দীর্ঘদিন এই ব্যবস্থাই বহাল ছিল। এমনকি ২০১১ সালে যখন সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে বাহাত্তরের আদি সংবিধানের চার মূলনীতি ফিরিয়ে আনাসহ সংবিধানে ব্যাপক পরিবর্তন করা হয়, তখনও বিচারপতিদের অপসারণ-সম্পর্কিত ৯৬ অনুচ্ছেদে হাত দেওয়া হয়নি। কিন্তু ২০১২ সালের মে মাসে একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে হাইকোর্টের একজন বিচারপতিকে (এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী) অপসরণের দাবি ওঠে সংসদে। সেই ঘটনার পরিক্রমায় ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বিল সংসদে পাস হয়। এর মধ্য দিয়ে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা পুনরায় সংসদের ওপর ন্যস্ত করা হয়।
২০১৬ সালের ৫ মে হাইকোর্ট এই সংশোধনী অবৈধ বলে রায় দেন এবং ২০১৭ সালের ৩ জুলাই আপিল বিভাগও এটি বহাল রাখেন—যার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয় ওই বছরের ১ আগস্ট। ওই বছরের ২৪ ডিসেম্বর ষোড়শ সংশোধনী নিয়ে আপিল বিভাগের দেওয়া রায় রিভিউ (পুনর্বিবেচনা) চেয়ে আবেদন করে রাষ্ট্রপক্ষ। যার ওপর শুনানি হয় গত ২০ অক্টোবর এবং রিভিউতেও সর্বোচ্চ আদালত ষোড়শ সংশোধনীকে অবৈধ বলে দেওয়া রায় বহাল রাখেন।
সংবিধানে সবশেষ সংশোধনী আনা হয় ২০১৮ সালের ৮ জুলাই—সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্যদের আরও ২৫ বছর বহাল রাখার বিধান করতে।
কেন এত সংশোধনী?
অস্বীকার করার সুযোগ নেই, সংবিধানে এই যে ১৭ বার সংশোধন আনা হলো, তার অনেকগুলোই আনা হয়েছে ক্ষমতায় থাকা ব্যক্তি ও দলের রাজনৈতিক স্বার্থে এবং সেজন্য অনেক ক্ষেত্রে মানুষের মৌলিক অধিকারও সংকুচিত হয়েছে। তাছাড়া সংশোধনীর নামে যে একাধিকবার বাহাত্তরের মূল সংবিধানের মৌলিক বিষয়গুলোতেও হাত দেওয়া হয়েছে, তা নিয়েও সমালোচনা আছে।
১৭টি সংশোধনী বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এর মধ্যে প্রথম চারটি সংশোধনী আনা হয়েছে বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৫ সালের মধ্যে। পঞ্চম সংশোধনী আনা হয় জিয়াউর রহমানের আমলে। ষষ্ঠ সংশোধনী আবদুস সাত্তার উপরাষ্ট্রপতি থাকা অবস্থায়। সপ্তম থেকে দশম—এই চারটি সংশোধনী আনা হয় এরশাদের আমলে। একাদশ থেকে চতুর্দশ—এই চারটি সংশোধনী আনা হয় বিএনপির আমলে। বাংলাদেশের ইতিহাসে সংবিধানে সবচেয়ে বড় পরিবর্তনটি আনা হয় ২০১১ সালে আওয়ামী লীগের আমলে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে। ষোড়শ ও সবশেষ সপ্তদশ সংশোধনীও আওয়ামী লীগের আমলে আনা হলেও সপ্তদশ সংশোধনী ছাড়া বাকি দুটিই আদালতে চ্যালেঞ্জড হয়েছে।
এরইমধ্যে ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ বলে দেওয়া রায়ের রিভিউ বা পুনর্বিবেচনার মধ্য দিয়ে এটি চূড়ান্তভাবে নিষ্পত্তি হয়েছে। পঞ্চদশ সংশোধনীর ভাগ্যে কী ঘটবে—তাও এখন সহজেই অনুমেয়। এই সংশোধনী কেন অবৈধ হবে না, সেই প্রশ্নে দেওয়া রুলের ওপর আগামী ৩০ অক্টোবর হাইকোর্টে শুনানি হওয়ার কথা রয়েছে।
আমীন আল রশীদ: সাংবাদিক ও লেখক
Comments