জরায়ুমুখ ক্যানসারের টিকা কেন ও কখন নেবেন, কতটা কার্যকর

জরায়ুমুখ ক্যানসারের টিকা
ছবি: সংগৃহীত

জরায়ুমুখ ক্যানসারে আক্রান্তের সংখ্যা বর্তমানে অনেক। এ ক্যানসারের টিকা সম্পর্কে বিস্তারিত জানিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের গাইনোকোলজিক্যাল অনকোলজি বিভাগের ইউনিট প্রধান অধ্যাপক ডা. জান্নাতুল ফেরদৌস জোনাকী।

জরায়ুমুখ ক্যানসার কী

ডা. জান্নাতুল ফেরদৌস বলেন, জরায়ুর দুইটি অংশ থাকে, উপরের অংশটিকে বলা হয় ইউটেরাস বডি বা জরায়ু দেহ এবং নিচের অংশটিকে বলা হয় জরায়ুমুখ বা সার্ভিক্স। এই জরায়ুমুখ বা সার্ভিক্সের ক্যানসারকেই বলা হয় সারভাইকাল ক্যানসার।

বিশ্বব্যাপী নারীদের ক্যানসারের আক্রান্ত ও মৃত্যু হারের দিক থেকে চতুর্থ স্থানে রয়েছে জরায়ুমুখ ক্যানসার এবং বাংলাদেশে এর স্থান দ্বিতীয়। জরায়ুমুখ ক্যানসার ৩৫ থেকে ৫৫ বছর বয়সী নারীদের মধ্যে বেশি দেখা যায়। বিশ্বব্যাপী জরায়ুমুখ ক্যানসারে মৃত্যু হারের ৯০ শতাংশই ঘটে বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল, মধ্যম আয় এবং অনুন্নত দেশগুলোতে।

জরায়ুমুখ ক্যানসারের জন্য দায়ী হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস (এইচপিভি)। ১০০টিরও বেশি প্রকার বা স্ট্রেন আছে হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাসের। এর মধ্যে ১৪ থেকে ১৫টি হচ্ছে হাই রিস্ক স্ট্রেন এবং এই উচ্চ ঝুকিপূর্ণ এইচপিভি-১৬, এইচপিভি-১৮ স্ট্রেন ৭০ থেকে ৮০ ভাগ দায়ী জরায়ুমুখের ক্যানসার হওয়ার জন্য।

জরায়ুমুখ ক্যানসারের টিকা কী ও কেন দিতে হবে

ডা. জান্নাতুল ফেরদৌস বলেন, সব ক্যানসার প্রতিরোধ করা যায় না কিন্তু জরায়ুমুখ ক্যানসার প্রতিরোধ করা সম্ভব। জরায়ুমুখ ক্যানসার প্রতিরোধের জন্য বিশ্ব টিকা প্রথম বাজারে আসে ২০০৬ সালের দিকে। এইচপিভি ভাইরাসের মাধ্যমে জরায়ুমুখে ক্যানসার হয় আর এই ভাইরাসের বিরুদ্ধেই এই টিকা আবিষ্কার হয়েছে। এ পর্যন্ত ৩ ধরনের টিকা আবিষ্কৃত হয়েছে। যেমন-

বাইভ্যালেন্ট ভ্যাকসিন- ২টি ভাইরাসের বিরুদ্ধে কাজ করে বাইভ্যালেন্ট ভ্যাকসিন।

কোয়াড্রিভ্যালেন্ট ভ্যাকসিন- ৪টি ভাইরাসের বিরুদ্ধে যখন কাজ করে সেটি কোয়াড্রিভ্যালেন্ট ভ্যাকসিন।

নোনাভ্যালেন্ট ভ্যাকসিন- ৯টি ভাইরাসের বিরুদ্ধে যখন কাজ করে সেটি হচ্ছে নোনাভ্যালেন্ট ভ্যাকসিন।

আমাদের দেশে বাজারে পাওয়া যায় বাইভ্যালেন্ট ভ্যাকসিন, সরকারিভাবে যেটা দেওয়া হচ্ছে সেটি কোয়াড্রিভ্যালেন্ট ভ্যাকসিন।

এইচপিভি ভাইরাসের বাইরের আবরণে একটি প্রোটিন থাকে। সেই প্রোটিনে এক ধরনের বিশেষ প্রোটিন থাকে যাকে এল ওয়ান (খ১) প্রোটিন বলা হয়। সেই প্রোটিন থেকে রিকম্বিন্যান্ট ডিএনএ প্রযুক্তি ব্যবহার করে ভাইরাসের সদৃশ কণা তৈরি করা হয়, যা ভ্যাকসিন হিসেবে ব্যবহৃত হয়। যেহেতু ভাইরাস সদৃশ কণা থেকে ভ্যাকসিনটা তৈরি এবং ভাইরাসের কোনো ডিএনএ এখানে থাকে না, এতে করে সংক্রামক ও অনকোজেনিক ক্যানসার হওয়ার মত কোনো উপাদান ভ্যাকসিনটাতে থাকে না।

জরায়ুমুখ ক্যানসারের টিকা কেন দিতে হবে

ডা. জান্নাতুল ফেরদৌস বলেন, জরায়ুমুখের ক্যানসারের জন্য ৭০ ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় এইচপিভি-১৬, এইচপিভি-১৮ দায়ী। এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রাথমিক প্রতিরোধ হিসেবে এইচপিভি ভ্যাকসিন দেওয়া উচিত। এইচপিভি ভাইরাস নারীদের জরায়ুমুখের যে কোষ বা কলা থাকে সেখানে প্রথম সংক্রমণ ঘটায় যা যৌন সংস্পর্শের মাধ্যমে কোষে ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়ে। ৮০ শতাংশ নারী নিজস্ব রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার কারণে ২ বছরের মধ্যে ভাইরাস মুক্ত হয়ে যান। সংক্রমণ ঘটলেও ভাইরাস স্থায়ী হতে পারে না, এমনিতেই শরীর থেকে চলে যায়।

বাকি ২০ শতাংশ নারীদের জরায়ুমুখে এইচপিভি ভাইরাস দীর্ঘস্থায়ীভাবে থেকে যায়। পরবর্তীতে দেখা যায় এই ভাইরাস সার্ভিকাল ইন্ট্রাপিথেলিয়াল নিউওপ্লাসিয়া (সিআইএন) বা ক্যানসারপূর্ব অবস্থা তৈরি করে। সিআইএনের আবার ৩ টি ধাপ আছে, যেমন- সিআইএন ১, সিআইএন ২ এবং সিআইএন ৩, এরপরে সিআইএস বলা হয় এবং পরবর্তীতে এটা ক্যানসারে রূপান্তরিত হয়।

প্রথমে এইচপিভির মাধ্যমে জরায়ুমুখে ইনফেকশন হয় এবং পরবর্তীতে পুরো ক্যানসার হয়। এই পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে ১০ থেকে ২০ বছর সময় লাগে। অর্থাৎ একটি গ্রহণযোগ্য সময় পাওয়া যায় জরায়ুমুখ ক্যানসার প্রতিরোধের জন্য।

দীর্ঘমেয়াদী সংক্রমণের জন্য কিছু সুনির্দিষ্ট কোফ্যাক্টর কাজ করে। যেমন-বাল্যবিবাহ, স্বামীর একাধিক বিয়ে, বিবাহ বহিভূর্ত সম্পর্ক, একাধিক যৌনসঙ্গী থাকা, অল্প বয়সে মা হওয়া, ঘন ঘন সন্তান ধারণ করা, একটানা ৫ বছরে বেশি জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি সেবন, অপুষ্টি, রক্তস্বল্পতা, ধূমপান, তামান, জর্দা এসব কিছু ক্যানসার হওয়ার ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। এতে করে নারীদের শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়, ভাইরাস নিজ থেকে বের হতে  পারে না।

আমাদের দেশে নারীদের জরায়ুমুখ ক্যানসার হওয়ার পেছনে এই কারণগুলো যথেষ্ট ভূমিকা রাখে। তাই আমাদের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট ও ক্যানসারের কারণগুলো বিবেচনা করে বলা যায়, ক্যানসারের টিকা নেওয়া অত্যাবশক।

এ ছাড়া জরায়ুমুখের ক্যানসারের সঙ্গে এইচপিভি ভাইরাসের মাধ্যমে সংগঠিত অন্যান্য কিছু ক্যানসার আছে, যেমন- যোনীপথের ক্যানসার, যোনীমুখের ক্যানসার, মুখের ক্যানসার এগুলোও প্রতিরোধ করা সম্ভব প্রায় ৪০ থেকে ৬০ শতাংশ।

 জরায়ুমুখ ক্যানসারের টিকা কীভাবে কাজ করে

মানবদেহে কোষীয় এবং অ্যান্টিবডি এই ২ ধরনের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা আছে। এইচপিভি ভাইরাস ২ ধরনের প্রতিরোধ ক্ষমতাই প্রতিরোধ করতে পারে। এইচপিভি ভ্যাকসিন ২ ধরনের প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে উজ্জীবিত করে অ্যান্টিবডি তৈরি করে। দেখা যায় এইচপিভি ভ্যাকসিন দেওয়ার ১ মাসের মধ্যেই অ্যান্টিবডি রক্তে চলে আসে, ৬ মাস পর সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছে যায় সাধারণত। বলা হয়ে থাকে ৬ মাস পর অ্যান্টিবডি দীর্ঘদিন স্থায়ী হয় শরীরে। ক্যানসার প্রতিরোধে সহায়তা করে শরীরকে সুরক্ষা দেয়।

টিকা কখন দিতে হবে

কোন বয়সে ভ্যাকসিন দিতে হবে এই প্রসঙ্গে ডা. জান্নাতুল ফেরদৌস বলেন, টার্গেট গ্রুপ, ক্যাচআপ গ্রুপ এবং কনসিডারেবল গ্রুপ এই ৩টি ভাগে ভাগ করা হয় টিকা দেওয়ার ক্ষেত্রে।

টার্গেট গ্রুপ: ৯ থেকে ১৪ বছর বয়সী কিশোরী, যাদের যৌন সংস্পর্শে হয়নি।  জরায়ুমুখের যে স্থান থেকে সারভাইকাল ক্যানসারের উৎপত্তি হয় যেটাকে ট্রান্সফরমেশন জোন বা অস্থিতিশীল এলাকা বলা হয়। যদি কারো বাল্যবিবাহ হয়, অল্প বয়সে সন্তান হয় সেক্ষেত্রে এইচপিভি ভাইরাস ওই ট্রান্সফরমেশন জোন আক্রান্ত করে। স্থায়ীভাবে থেকে যায় ভাইরাসটি, মেটাপ্লাসিয়া হয় এবং পরবর্তীতে ক্যানসার তৈরি করে। সেকারণে টিকা দেওয়ার টার্গেট গ্রুপ হচ্ছে ৯ থেকে ১৪ বছরের কিশোরী।

ক্যাচআপ গ্রুপ: ১৫ থেকে ২৬ বছর বয়স পর্যন্ত ক্যাচআপ গ্রুপ বলা হয়।

কনসিডারেবল গ্রুপ: এছাড়া ২৭ থেকে ৪৫ বছর বয়স পর্যন্ত টিকা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে অ্যাডভাইজারি কমিটি ফর ইমিউনাইজেশন প্র্যাকটিস (এসিআইপি) সুপারিশে।

নির্দিষ্ট বয়সের পর টিকা কতটা কার্যকর

টার্গেট গ্রুপ, ক্যাচআপ গ্রুপ ছাড়াও ২৭ থেকে ৪৫ বছর বয়স পর্যন্ত এইচপিভি ভ্যাকসিন দেওয়ার স্বীকৃতি থাকলেও এই বয়সে টিকার উপযোগিতা বেশ সীমিত। কারণ সারভাইকাল ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার জন্য পূর্বের যে প্রক্রিয়া সেটি শুরু হয়ে গেছে। যৌনমিলন, এইচপিভি সংক্রমণ, জরায়ুমুখ ক্যানসার হওয়ার বিভিন্ন কোফ্যাক্টরগুলো এই বয়সে কাজ করতে শুরু করে দেয়। স্থায়ী সংক্রমণ থেকে অস্বাভাবিক কোষীয় পরিবর্তন হয় যেটি ক্যানসার পূর্ব অবস্থা হয়ত সেটির প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায়। ভ্যাকসিনের মাধ্যমে স্থায়ী সংক্রমণ রোধ করা যায় না। এই বয়সে সাধারণত স্ক্রিনিং শুরু করতে হয়। স্ক্রিনিংয়ের মাধ্যমে কোষীয় কলার পরিবর্তন হয়েছে কি না সেটি শনাক্ত করে জরায়ুমুখ ক্যানসার প্রতিরোধে চিকিৎসা করতে হবে। সেক্ষেত্রে টিকার ভূমিকা কমে যায়।

কোথায় পাওয়া যাবে এইচপিভি টিকা

বিনামূল্যে দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পঞ্চম থেকে নবম শ্রেণির ছাত্রী এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বাইরে থাকা ১০ থেকে ১৪ বছর বয়সী কিশোরীদের জন্য টিকা কার্যক্রম শুরু হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি (ইপিআই) পরিচালিত সিঙ্গেল ডোজ এইচপিভি ভ্যাকসিন কার্যক্রমে ৬২ লাখেরও বেশি কিশোরীকে টিকার আওতায় আনার লক্ষ্যে পরিচালিত হচ্ছে এই ক্যাম্পেইন।

 

Comments

The Daily Star  | English

Probe body formed over vandalism centring women's football match in Joypurhat

The deputy commissioner's office of Joypurhat has formed a five-member probe committee to investigate the vandalism of a football field where a women's football match was scheduled for Wednesday

2h ago