শরতের লাল-হলুদ-কমলা পাতার দিনগুলো

যুক্তরাষ্ট্র
ছবি: নাদিয়া রহমান

ছোটবেলায় টেলিভিশনে দেখতাম 'বিদেশে' কোনো একটা ঋতুতে গাছের পাতাগুলো রঙিন হয়ে উঠে। লাল, হলুদ, কমলা রঙের ম্যাপল লিফের মতো দেখতে পাতাগুলো। এমন রঙিন পাতা স্বচক্ষে দেখলাম বাইরে পড়তে গিয়ে। তখন বিষয়টা খুবই স্বাভাবিক ঠেকল। তবে 'ফল সিজন' বা শরৎ ঋতু আসবে এবং যুক্তরাষ্ট্রে ঘটা করে এই ঋতুর আগমন পালন করা হবে 'ফল হারভেস্টের' মাধ্যমে, তাই বিষয়টা একটা উদযাপনের মতন হয়ে উঠল।

ফল বা শরতের শুরুতেই ক্লাস বন্ধ দেওয়া হয় পুরো এক সপ্তাহের জন্য। এটাও অন্যতম কারণ এই ঋতুর জন্য অপেক্ষা করে থাকার। এবং এই 'ফল ব্রেকে' সেখানকার প্রত্যেকেই বেরিয়ে পড়ে ঘুরতে। এটাও একটা আমেজ, নানান পরিকল্পনা চলতে থাকে, কে কোথায় যাবে। কোথা থেকে শরতের রং ভালমতো দেখা যাবে।

কেন্টাকিতে আমার প্রথম বছরে শেষ মুহূর্তের পরিকল্পনায় গিয়েছিলাম রেড রিভার গর্জে। মূলত হাইকিংয়ের একটা ট্রেইল, যার চূড়ায় উঠলে শরতের সব রঙিন গাছেদের দেখা যাবে এক কাতারে। যেহেতু যুক্তরাষ্ট্রে আমার যাত্রা ছিল কেবল দুই বছরের, তাই পরের বছর আর কোথাও যাওয়া হয়নি। বারবার মনে হয়েছে, পরে হয়তো আবার আসা হবে, এবার না হয় পড়ায় মন দিই! তাই দ্বিতীয় বছরে শরতের এই বন্ধ কেটেছে আমার কেন্টাকি স্টেটের হাজার একরের আরবোরেটাম (উদ্যান) ঘেরা ডর্মে। সদর দরজা খুলেই পর্চ বয়া বারান্দায় দেখা মিলতো কাঠবেড়ালির। এই কাঠবেড়ালিগুলো ছিল আমাদের ডর্মের নিত্যদিনের সঙ্গী। মানুষের তোয়াক্কা না করে আমাদের সামনে দিয়েই হেলেদুলে হেঁটে বেড়াতো এই প্রাণী। তবে শরতে আরও যুক্ত হতো খরগোশ। ডর্মের সামনের লনে এরা নির্ভয়ে নিজেদের কাজে ব্যস্ত থাকত।

যুক্তরাষ্ট্র
ছবি: নাদিয়া রহমান

কখনো পিন পতন নীরবতায় ভর দুপুরে হয়তো একটু নিদ্রাভাব এসেছে, ওমনি শব্দ শুনে হুড়মুড়িয়ে উঠে পড়েছি। কারণ ছাদে ধুপ করে উড়ে এসে পড়েছে কাঠবিড়ালি। টালি দেওয়া কাঠের ডর্ম হওয়ায় সামান্য শব্দ সেই উদ্যান ঘেরা নির্জন দুপুরে বিকট মনে হতো। দুপুর শেষে বিকেলে যখন পর্চে দাঁড়িয়ে মনোরম শরতের অনেক বিকেল কেটে গেছে হাতে এক কাপ হট চকলেট নিয়ে। আমার বারান্দার ঠিক সামনেই ছিল বাস্কেটবলের কোর্ট। ছোট বাচ্চাদের থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের দেখতাম কেউ সাইকেল চালাচ্ছে, কেউ বাস্কেটবল খেলছে। কখনো পরিচিত কেউ থাকলে হাত নাড়িয়ে সেখানে যাবার তাগাদা দিত।

তবে আলসে আমি বেশিরভাগই এই পর্চে পাতা চেয়ারে জবুথবু হয়ে বসে বিকেল পার করে দিতাম রঙিন পাতাদের দেখে। গ্রীষ্মের সময়েও হয়তো তাই, তবে সামারে গরম থাকতো মারাত্মক। আর একটানা ক্রিকেট পোকার ডাক।

কখনো বন্ধুদের ডাক উপেক্ষা করতে পারতাম না, বিশেষ করে যারা আমার মতোই এই ফল ব্রেকে রয়ে যেত ডর্মে। শরত হলেও যেই সূর্য ডুবে যাবে, ওমনি হালকা কুয়াশার সঙ্গে নামবে শীত। তাই জ্যাকেট সঙ্গে থাকত সবসময়েই। হাঁটতে যেতাম রঙিন সেই আরবরেটামে। যেখানে নানান মানুষেরা দূর থেকে ড্রাইভ করে আসত, তা ছিল আমার ডর্মের ঠিক পিছেই। নতুন শস্যের উদযাপন আড় হ্যালোউইনকে কেন্দ্র করে উদ্যানে দেখতাম কিছু পুতুল, আর শরতের সব থেকে জনপ্রিয় বস্তু মিষ্টিকুমড়ো রাখা আছে। মানে পথে, রাস্তায় কিংবা বাড়িগুলোর সামনে চোখে পরবেই এ সকল জিনিস। তাই শরত যে এসে গেছে, এটা উপেক্ষা করা যেত না কোনোভাবেই।

ওখানে আরও দেখা মিলত বসন্ত আর গ্রীষ্মের কিছু টিউলিপ, গোলাপ এবং পেটুইনিয়ার, যারা এখনো তাদের সব কিছু গুছিয়ে এ বছরের যাত্রা শেষ করেনি। ওদের তাড়া না থাকলেও আমার ফেরবার তাড়া ছিল। সময়ের হিসেব ছিল বেশ পরিকল্পনামাফিক। তাই সেবার ফল ব্রেক থেকেই মনে হচ্ছিল, এ বারই তো শেষ।

বন্ধুরা অভয় দিত, আসছে দিনে আবার তো হবে। কিন্তু হয়তো আমাদের সঙ্গে আর না। তাই হয়েছে। এ বছর আরেক শরতের আমেজ পাওয়া হচ্ছে। এই শরতের ঘ্রাণ আমার চেনা, আমার মাটির। মাঝে শুধু দুবছর পাইনি, তবে মনে করেছি সবসময়।

এ দুধরনের শরত পরখ করে মনে হয়েছে, পূর্ব বা পশ্চিম, যেটাই হোক সবখানেই শরতের ঘ্রাণ মনে হয় একই। একটু আলসেমি, কুয়াশা, ঠান্ডা। শুধু এখানে নেই রঙিন ম্যাপল লিফ। কিন্তু এখানে আবার আছে শিউলি, পুরোনো ক্যাম্পাস, শহরে সন্ধ্যায় শীত-শীত আমেজে থিয়েটার দেখার আমেজ। এ সব কিছুই হোক উপভোগের।

 

Comments

The Daily Star  | English

Exports under strain as India slaps more restrictions

Industry insiders say the new restrictions could deepen Bangladesh's export woes at a time when global demand remains fragile and other sectors—from garments to processed foods—also face trade hurdles

46m ago