প্রেস ইন্সটিটিউটে আধুনিকায়ন জরুরি

১৯৭৬ সালে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ প্রেস ইন্সটিটিউট (পিআইবি)। আটচল্লিশ বছরের কাজের মূল্যায়ন করলে সরকারি প্রতিষ্ঠানটিকে গতানুগতিকই বলতে হবে। যদিও সাংবাদিকদের প্রশিক্ষণ, গণমাধ্যম গবেষণা, সাংবাদিকতায় ডিপ্লোমা কোর্স ও মাস্টার্স প্রোগ্রাম পরিচালনা, গণমাধ্যম বিষয়ক গ্রন্থ ও সাময়িকী প্রকাশনার মাধ্যমে সাংবাদিকতার শিক্ষা ও পেশার উন্নয়নে নানান সীমাবদ্ধতার মধ্যে কাজ করে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এ ধরনের প্রেস ইন্সটিটিউট রয়েছে। যেমন প্রেস ইন্সটিটিউট অব ইন্ডিয়া, আমেরিকান প্রেস ইন্সটিটিউট। প্রেস ইন্সটিটিউট অব ইন্ডিয়া সরকারি প্রতিষ্ঠান হলেও স্বাধীন সংস্থা হিসেবে কাজ করে। আমেরিকান প্রেস ইন্সটিটিউট সম্পূর্ণ বেসরকারি সংস্থা যা দাতব্য অর্থায়নে পরিচালিত। বর্তমান গণমাধ‌্যমঘন যুগের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রয়েছে বেসরকারি সংস্থা 'পয়েন্টার ইন্সটিটিউট'।

এসব প্রতিষ্ঠানের উল্লেখ করলাম এ কারণে যে বাংলাদেশে গণমাধ্যমের উন্নয়নে ও চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় গবেষণামূলক এ ধরনের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেনি।  দেশে বেসরকারি দু-একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে যারা মূলত প্রকল্প-ভিত্তিক সাংবাদিকদের প্রশিক্ষণ ও গণমাধ্যম গবেষণা পরিচালনা করে থাকে। কিন্তু বর্তমান যুগের চাহিদা মোকাবেলায় গণমাধ্যমের উন্নয়নে সরকারি বা বেসরকারিভাবে সত্যিকারের 'ইন্সটিটিউট' এদেশে এখনো গড়ে উঠেনি।  গণমাধ্যমের আধুনিকায়ন, দায়িত্বশীলতা বৃদ্ধি, পেশাগত উৎকর্ষ সাধন ও ডিজিটাল যুগের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় একটি শক্তিশালী ও সুগঠিত অভিভাবকসূলক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান জরুরি হয়েছে বাংলাদেশে।

ইন্সটিটিউট-এর সংস্কার ও আধুনিকায়নের মাধ্যমেই এ চাহিদা মেটানো সম্ভব। পিআইবি'র দায়িত্ব ও কার্যাবলীর ৮ নং কাজ: 'সংবাদপত্র, বার্তা সংস্থা, রেডিও, টেলিভিশন, তথ্যকেন্দ্র এবং গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের উপদেশক ও পরামর্শক সেবা প্রদান।' এ কাজটি করার সক্ষমতা পিআইবি দেখায়নি, অন‌্যদিকে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হিসেবে পিআইবিকে গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলো গণ্যও করেনি। সময়ের সাথে সাথে পিআইবি'র জনবল কাঠামো, কার্যক্রম এবং ভূমিকা পুনর্মূল্যায়নের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।

'জুলাই বিপ্লব' এর মাধ্যমে যে নতুন জনআকাঙ্খা সৃজিত হয়েছে তার সঙ্গে যুক্ত রয়েছে স্বাধীন মত প্রকাশের পুঞ্জীভূত চাহিদা। স্বাধীন মত প্রকাশের ব্যাপারটি সাংবিধানিক অবয়বেই সীমাবদ্ধ সবসময়, প্রকৃত স্বাদ আস্বাদন জনগণ করতে পারেনি কখনোই। গণমাধ্যমের পরিবর্তিত ভূমিকা, ডিজিটাল যুগের চাহিদা এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও দায়বদ্ধতার চ্যালেঞ্জ যেমন রয়েছে, তেমনি গণমাধ্যমের টিকে থাকার নিরন্তর নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি হচ্ছে। পিআইবি সংস্কার ও আধুনিকায়ন আজকের দিনে এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। বাস্তবতার নিরিখে এর কাঠামো ও কার্যক্রমগত রূপান্তর জরুরি।

বাংলাদেশ প্রেস ইন্সটিটিউট মূল কাজ হিসেবে সারাদেশের সাংবাদিকদের অনলাইন ও অফলাইন প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে। প্রতিনিয়ত সাংবাদিকতায় নতুন নতুন ধরন ও ধারণা যুক্ত হচ্ছে। সাংবাদিকতা শুধু টেক্সট নির্ভর নয়, ছবি, চিত্র, গ্রাফিক্স, অডিও-ভিডিও, প্রভৃতি সহযোগে নির্মিত আধেয়ের সন্নিবেশন ও পরিবেশন। সংবাদগল্প কথনে এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন।  একই ঘটনা ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকের সংবাদ কাহিনী সকল মাধ্যম বা প্লাটফর্মের জন্য পরিবেশিত হচ্ছে যাকে বলা হচ্ছে 'ট্রান্সমিডিয়া গল্পকথন'। আবার একই আধেয় (সংবাদ, অডিও, টেক্সট, চিত্র) ভিন্ন ভিন্ন মাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে যাকে বলা হচ্ছে। এসব সাংবাদিকতার নতুন ধারণা যখন সারাবিশ্বে প্রয়োগ করা হচ্ছে, প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে তখন পিআইবি বেশিরভাগ বুনিয়াদি প্রশিক্ষণের নামে সংবাদের সংজ্ঞা, বৈশিষ্ট্য, সংবাদ কাঠামোর  মতো বিষয়গুলো শিক্ষণ দিয়ে কর্মশালা আয়োজন করছে।

সাংবাদিকতার বুনিয়াদী এই পুরনো প্রশিক্ষণ এই ডিজিটাল যুগে কতটুক কার্যকরী হচ্ছে তা নিয়ে প্রশ্ন করা যেতেই পারে। দৈনিকের সাংবাদিকদের 'মোবাইল জার্নালিজম' ও 'মাল্টিমিডিয়া জার্নালিজম' বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিচ্ছিলাম কিছুদিন আগে। সেখানে ওই পত্রিকার সম্পাদক পিআইবি প্রশিক্ষণ নিয়ে এমন প্রশ্নটিই তুললেন। সাংবাদিকতার নতুন ধারণাগুলোও বুনিয়াদী প্রশিক্ষণে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। ২০১১ সালের দিকে পিআইবি'র জন‌্য অনলাইন জার্নালিজমের প্রশিক্ষণ মডিউল তৈরি করে দিয়েছিলাম, ওই মডিউল ব্যবহার করা হয়েছে সম্ভবত ১০-১২ বছর যা মোটেও ঠিক হয়নি একারণে যে অনলাইন সাংবাদিকতায় প্রতিনিয়ত নতুন ধারণার অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।

পিআইবি সম্প্রতি মোবাইল জার্নালিজম প্রশিক্ষণ শুরু করেছে। স্মার্টফোন সহজলভ‌্য হওয়ার ফলে এখন 'ব‌্যাকপ‌্যাক সাংবাদিকতার' যুগ শুরু হয়েছে। অর্থাৎ এখন প্রশিক্ষণের মাধ্যমে একজন সাংবাদিক হবেন অডিও-ভিডিও-চিত্র ধারণকারী, তথ‌্য সংগ্রহকারী, লিখন শিল্পী, গল্পকথক, সম্পাদনাকারী ও প্রযোজক। তথ‌্য সংগ্রহ থেকে সংবাদ গল্প লিখন, সম্পাদনা ও প্রকাশ সবকিছু্ই করবেন একজন সাংবাদিক।

পিআইবিকে ব‌্যাকপ‌্যাক সাংবাদিকতার প্রশিক্ষণ দিতে হবে। সাংবাদিকতার পুরোনা ধারণা ও কাঠামোর সঙ্গে যুক্ত হয়ে এটাই হবে বর্তমান সাংবাদিকতার মৌলিক প্রশিক্ষণ। ইস‌্যুভিত্তিক প্রশিক্ষণ যেমন তথ্য অধিকার আইন, নির্বাচন রিপোর্টিং, জনসংযোগ, শিশু সাংবাদিকতা প্রভৃতি বিষয়েও প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে পিআইবি।  অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার উপরও প্রশিক্ষণ দেয়।

অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার প্রশিক্ষণ দিতে গিয়ে ব‌্যাখ‌্যামূলক সাংবাদিকতার ধারণা ও কৌশল উদগিরণ করেছেন। এই নিয়ে পিআইবি প্রকাশিত নিরীক্ষায় নিবন্ধও লিখেছি বেশ কয়েক বছর আগে। প্রশিক্ষক ও শিক্ষক এক পেশা নয়, তেমনি প্রশিক্ষণ প্রদান ও শিক্ষা প্রদানও এক জিনিস নয়। তাই প্রশিক্ষক নির্বাচনে খুবই সতর্ক থাকতে হবে। অনেক ভালো প্রশিক্ষকও সংযুক্ত আছেন পিআইবিতে। আরও বিষয়-ভিত্তিক দক্ষ প্রশিক্ষক রাখতে হবে। কেবল তত্ত্ব নয়, গণঅভ্যুত্থানের শক্তিকে ধারণ করে, চাহিদা অনুসারে গবেষণা করতে হবে। পুঁথিগত বিদ্যার চেয়ে বাস্তবিক বোঝাপড়া জ্ঞান বিবেচনায় রাখতে হবে।

এমন প্রশিক্ষণার্থী দেখেছি যারা শুধু সনদ ও প্রশিক্ষণ ভাতা নিতেই প্রশিক্ষণার্থী হন, প্রশিক্ষণ গ্রহণে উদাসীন থাকেন।  সুতরাং প্রশিক্ষণ কর্মশালার পুরো প্রক্রিয়া সংস্কার করে আধুনিক যুগোপযোগী প্রশিক্ষণ পদ্ধতি বিনির্মাণ করতে হবে।  আন্তর্জাতিক মিডিয়া সংস্থা এবং প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের সাথে অংশীদারিত্বের মাধ্যমে পিআইবি'র কার্যক্রমে আন্তর্জাতিক মানের প্রশিক্ষণ প্রবর্তন করা যেতে পারে।

৯০ দশকের পঠন-পাঠন দিয়ে বর্তমান সাংবাদিকতার প্রশিক্ষণ শুধু কর্মশালার আয়োজন করে অর্থের অপচয় হয় মাত্র, কার্যকরী যুগোপযোগী প্রশিক্ষণ কোনভাবেই সম্ভব হয় না। নতুন ধারণার সন্নিবেশনে বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ হবে আধুনিক ও প্রযুক্তিনির্ভর, যুগোপযোগী। 'সাংবাদিকতা: অফলাইন অনলাইন' গ্রন্থে উল্লেখিত নতুন ধারণা 'সংবাদ প্রকৌশলী' ও 'সংবাদ ব্যবস্থাপক'ও তৈরি করতে ভূমিকা রাখবে পিআইবি।

সাংবাদিকদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা, 'সমাধান-কেন্দ্রিক সাংবাদিকতা, সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবস্থাপনা, ডেটা জার্নালিজম, ফ্যাক্ট-চেকিং, ব্লগিং, ভ্লগিং, ইউটিউব রিপোর্টিং, পডকাস্টিং, নিউজ গেমিফিকেশন, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ও রোবোটিক জার্নালিজম, ড্রোন সাংবাদিকতা প্রভৃতি বিষয়ে প্রশিক্ষণ শুরু করতে না পারলে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের ধাক্কা থেকে সাংবাদিকতাকে বাঁচানো কঠিন হবে। দেশে বিভাগ-ভিত্তিক প্রশিক্ষক সংযুক্ত করতে হবে। দরকার হলে প্রশিক্ষকদের জন‌্যও প্রশিক্ষণ কর্মসূচি নিতে হবে। বাড়াতে হবে প্রশিক্ষকদের সম্মানি।

এমন প্রশিক্ষণার্থী দেখেছি যারা শুধু সনদ ও প্রশিক্ষণ ভাতা নিতেই প্রশিক্ষণার্থী হন, প্রশিক্ষণ গ্রহণে উদাসীন থাকেন।  সুতরাং প্রশিক্ষণ কর্মশালার পুরো প্রক্রিয়া সংস্কার করে আধুনিক যুগোপযোগী প্রশিক্ষণ পদ্ধতি বিনির্মাণ করতে হবে।  আন্তর্জাতিক মিডিয়া সংস্থা এবং প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের সাথে অংশীদারিত্বের মাধ্যমে পিআইবি'র কার্যক্রমে আন্তর্জাতিক মানের প্রশিক্ষণ প্রবর্তন করা যেতে পারে।

যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা, এবং যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশগুলোতে প্রেস ইন্সটিটিউটগুলো সাংবাদিকদের জন্যআধুনিক, প্রযুক্তিগত এবং গবেষণামূলক প্রশিক্ষণের উপর জোর দেয়। মাল্টিমিডিয়া ল্যাব, টিভি-রেডিও ব্রডকাস্টিং ল্যাব, প্রিন্ট প্রোডাকশন ল্যাব স্থাপন করে তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক সাংবাদিকতা শিক্ষার তীর্থস্থানে পরিণত করা যেতে পারে পিআইবিকে। প্রতিষ্ঠানটিকে আরও আধুনিক ও কার্যকর করে তুলতে হলে আন্তর্জাতিক মানের প্রশিক্ষণ কর্মসূচি পরিচালনা করতে হবে যা সাংবাদিকদের আন্তর্জাতিক মানের দক্ষতা অর্জনে সহায়তা করবে।

পিআইবি'র বর্তমান গবেষণা কার্যক্রম তেমনভাবে শক্তিশালী নয়। এ পর্যন্ত যা গবেষণা করেছে তা মূলত: সংবাদপত্রে প্রকাশিত বিভিন্ন ইস্যুতে আধেয় বিশ্লেষণ। গবেষণার মাধ্যমে গণমাধ্যমের সমস্যা ও সমাধান চিহ্নিত করা এবং তার ভিত্তিতে নীতিমালা প্রণয়ন করতে পারলে গণমাধ্যম আরও কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে। এজন্য ইন্সটিটিউট হিসেবে পিআইবিকে গবেষণায় আরো গুরুত্ব দিতে হবে।

ডিজিটাল যুগে সাংবাদিকতা টিকিয়ে রাখতে ব্রিটিশ কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব জার্নালিজমের অধ্যাপক আলফ্রেড হার্মিডা পঞ্চ-ই যথা-পরীক্ষামূলক সাংবাদিকতা, বাস্তব অভিজ্ঞতাসৃজনী সাংবাদিকতা, ব‌্যাখ‌্যামূলক সাংবাদিকতা, আবেগঘন সাংবাদিকতা, এবং মিতব‌্যায়ী সাংবাদিকতার চর্চার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। সাংবাদিকতায় এসব প্রয়োগে উদ্ভাবন এখন প্রধান শক্তি। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান যেমন রয়টার্স, বিবিসি, নিউইয়র্ক টাইমস ও গণমাধ্যম-সংশ্লিষ্ট গবেষণা ইন্সটিটিউট যেমন পয়েন্টার ইন্সটিটিউট বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও গবেষণা করছে।

উদ্ভাবন অর্জনে অবশ্যই গবেষণা প্রয়োজন। নয়া-ক্ষেত্র চিহ্নিত করে গবেষণার মাধ্যমে গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানকে পরামর্শ প্রদানের কাজটি করতে হবে পিআইবকে যাতে করে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে পারে গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলো। গবেষণার ভিত্তিতে প্রতিবছর 'বাংলাদেশের গণমাধ্যম ও সংবাদ গ্রহণ পরিস্থিতি/প্রবণতা' ও 'ডিজিটাল সংবাদ প্রতিবেশ' প্রভৃতি রিপোর্ট প্রকাশ করা যেতে পারে যা গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের নীতি নির্ধারণে ভূমিকা রাখবে।

পিআইবি শুধু গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নে নয়, সাংবাদিকতা শিক্ষার উন্নয়নেও ভূমিকা রাখে।  বাংলাদেশে প্রায় ৩০টি সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রতিষ্ঠানে সাংবাদিকতায় অ‌্যাকাডেমিক শিক্ষা দিয়ে থাকে। সাংবাদিকতায় প্রায় ১৫০ এর অধিক বাংলা গ্রন্থ পাওয়া যায় কিন্তু সাংবাদিকতা ও যোগাযোগ সংক্রান্ত মানসম্মত পাঠ্য বই খুব বেশি নেই। পিআইবি গ্রন্থ প্রকাশে আরও ভূমিকা রাখতে পারে।

পিআইবি গ্রন্থাগারকে অটোমেশন করে দেশের সকল সাংবাদিক এবং সাংবাদিকতার শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের জন‌্য উন্মুক্ত করা যেতে পারে এর রিসোর্স। সকল পত্রিকা কেন পাওয়া যাবে না? গণমাধ্যম সাময়িকী 'নিরীক্ষা'র আধেয় আরও বৈচিত্র্যময় ও সমৃদ্ধ করা প্রয়োজন। মানহীন লেখা বর্জন করা উচিত। এক সময় গবেষণামূলক পিয়ার-রিভিউ আর্টিকেল প্রকাশের জন‌্য আন্তর্জাতিক মানসম্মত (আইএসএন) জার্নাল প্রকাশের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল তা বন্ধ হলো কেন? বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও গণমাধ্যম গবেষকদের নিয়ে সম্পাদনা পরিষদ গঠন করে উক্ত গবেষণামূলক জার্নালটি প্রকাশের উদ‌্যোগ নেওয়া উচিত। প্রতিবছর আন্তর্জাতিক মিডিয়া কনফারেন্স আয়োজন এবং সাংবাদিকতা শিক্ষা ও পেশায় বিশেষ অবদানের জন‌্য প্রতিযোগিতামূলক অ‌্যাওয়ার্ড প্রচলন করতে পারে পিআইবি।

বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা, দেশি-বিদেশি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগ এবং গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে গবেষণা ও প্রশিক্ষণে সহযোগিতামূলক কর্মসূচি গ্রহণ করা উচিত। পিআইবি সংস্কারের ক্ষেত্রে অন্যান্য দেশের সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান থেকে অনেক কিছু শেখার আছে। যুক্তরাষ্ট্রের পয়েন্টার ইন্সটিটিউট, যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল কাউন্সিল ফর ট্রেনিং অব জার্নালিস্টস, ভারতের ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ মাস কমিউনিকেশন এবং প্রেস ইন্সটিটিউট, সিঙ্গাপুর প্রেস হোল্ডিংস ট্রেনিং ইন্সটিটিউট, এবং জার্মানির ডয়চে ভেলে একাডেমি পিআইবি'র সংস্কারের ক্ষেত্রে মডেল হতে পারে।  পিআইবি'কে আরও আধুনিক, প্রযুক্তিনির্ভর এবং বহুমাত্রিক করতে হলে, আন্তর্জাতিক মানের প্রশিক্ষণ কর্মসূচি ও গবেষণা পরিচালনা করতে হবে।

ডিজিটাল মিডিয়ার প্রসার এবং সোশ্যাল মিডিয়ার কারণে গণমাধ্যমের কার্যক্রমে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে।  সাংবাদিকতা প্রিন্ট বা টেলিভিশন মিডিয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়।  অনলাইন নিউজ পোর্টাল, সোশ্যাল মিডিয়া, ইউটিউব, এবং অন্যান্য প্ল্যাটফর্মগুলো বর্তমানে সাংবাদিকতার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে। এক সময় সাংবাদিকতা শুধু সনাতন গণমাধ‌্যমে সংযুক্ত হওয়ার বিষয় ছিল। ডিজিটাল যুগে সকল নেটিজেনও সাংবাদিকের ভূমিকায় এসেছে যাদেরকে বলা হচ্ছে 'নাগরিক সাংবাদিক'। ব্লগার-ভ্লগার আজ সনাতন সাংবাদিকদের জন‌্য চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিচ্ছে, সাংবাদিকদের আগেই সংবাদ প্রচার করছে। কখনও কখনও সমাজ ও দেশের জন‌্য ক্ষতিকর আধেয় সামাজিক যোগোযোগ মাধ্যমে ছেড়ে দিচ্ছে। কারণ সাংবাদিকতার মতো দায়িত্ববোধ তাদের নেই।  গুজব, অপতথ‌্য, মিথ‌্যাতথ‌্যে ভরপুর নেট দুনিয়া।

এ ব‌্যাধির প্রতিকারে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি। জনগণ যাতে কোনটা গুজব, কোনটা তথ‌্য, কোন অপততথ‌্য নিজেই যাচাই করার ক্ষমতা অর্জন করতে পারেন সেজন্য প্রয়োজন ডিজিটাল মাধ‌্যম সক্ষরতা। সুতরাং শুধু সাংবাদিকদের প্রশিক্ষণ নয়, গুজব, অপতথ‌্য ও মিথ‌্যাতথ‌্য প্রতিরোধ করতে হলে দেশের সবার জন‌্য ডিজিটাল মাধ‌্যম সাক্ষরতা প্রদান করা জরুরি।

ইতোমধ‌্যেই ইউরোপের বিভিন্ন দেশ তাদের জনগণে জন‌্য ডিজিটাল মাধ‌্যম সাক্ষরতা প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চালু করেছে। সরকারও পিআইবি'র মাধ্যমে এ কাজটি করতে পারে। প্রয়োজন গবেষণা, পরিকল্পনা ও কর্মসূচি আর দরকার এর দক্ষ জনবল ও কাঠামোগত আধুনিকায়ন। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, দক্ষতা বৃদ্ধি এবং ডিজিটাল যুগের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় পিআইবি'র কার্যকর ভূমিকা পালন নিশ্চিত করতে এর সংস্কার করা আবশ‌্যক। গণমাধ্যম ও সাংবাদিকদের পরামর্শক ও অভিভাবকসূচক প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে পিআইবিকে স্বাধীন সংস্থা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে।

গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ‌্যালয়

Comments

The Daily Star  | English

Working to make people true source of all power: CA

He also said his government's responsibility is to bind people into a larger family

1h ago