ভুনা না ল্যাটকা: কোন খিচুড়ি বেশি জনপ্রিয়?
মুষলধারে বৃষ্টি নামার সঙ্গে সঙ্গে খাদ্যরসিকদের মাঝে একটি বিতর্কের সৃষ্টি হয়, কোন খিচুড়িটি বেশি সুস্বাদু? ভুনা খিচুড়ির জনপ্রিয়তা বেশি নাকি ল্যাটকা খিচুড়ির? খিচুড়ি নিয়ে এই বিতর্কের অবসান ঘটাতে আমরা আলাপ করি ঢাকার কয়েকজন খিচুড়িপ্রেমীদের সঙ্গে।
স্থানীয় একটি রেস্টুরেন্টের মালিক সঞ্চয় ইসলাম বলেন, 'ভুনা খিচুড়িই হল আসল খিচুড়ি, বাকিগুলো কেবল নামেই খিচুড়ি। অনেক রকম ফ্লেভারের সংমিশ্রণে তৈরি ভুনা খিচুড়ির মধ্যে একটা অভিজাত ব্যাপার আছে, অন্যদিকে ল্যাটকা খিচুড়িকে ভুনা খিচুড়ির বেরসিক খালাতো ভাই বলা যায়।'
ভুনা খিচুড়ির পক্ষে এই কথাগুলো বলতে গিয়ে সঞ্চয় ছিলেন বেশ আত্মবিশ্বাসী। এভাবেই খিচুড়ি নিয়ে তুমুল একটি বিতর্কের সৃষ্টি হয়!
খিচুড়ি পরিবারের মধ্যে আভিজাত্যের তকমা ভুনা খিচুড়িকেই দিতে হবে। সাধারণত ডাল-চাল একসঙ্গে মিশিয়ে খিচুড়ি রান্না করা হয়, প্রধান উপকরণ ডাল এবং চাল হলেও ভুনা খিচুড়ি রানার প্রক্রিয়া কিছুটা ভিন্ন। প্রথমেই উপকরণগুলোকে ঘি দিয়ে হালকাভাবে ভেজে নেওয়া হয়, সঙ্গে থাকে গোটা মশলার সুবাস। এর ফলে ভুনা খিচুড়িতে একটি মশলাদার স্মোকি ফ্লেভার সৃষ্টি হয় যা এই খিচুড়ির বিশেষত্ব। ভুনা খিচুড়ির ডাল আর চালগুলো হয় ঝরঝরে এবং বিভিন্ন ধরনের মশলার ফ্লেভারের জন্য এটি বেশ জনপ্রিয়।
সাংবাদিক মেজবাহ স্মরণ বলেন, 'ভুনা খিচুড়িই আমার জন্য আসল খিচুড়ি। এই খিচুড়ির স্বাদ এবং মশলার সুবাসের জন্য আমি এর লোভ সামলাতে পারি না। গরুর মাংস বা আচার দিয়ে ভুনা খিচুড়ি খেলে যে কেউ এর প্রশংসায় পঞ্চমুখ হতে বাধ্য।'
তবে ভুনা খিচুড়ির বিপক্ষেও আছেন অনেকে। নিজেকে খিচুড়ি বিশেষজ্ঞ দাবি করা তাহসিন তাহিরা বিভার মতে, ভুনা খিচুড়ি অতিরিক্ত মশলাদার।
তিনি আরও বলেন, 'আসল খিচুড়ির মধ্যে একটা আভিজাত্য থাকা উচিৎ। খিচুড়ি হতে হবে সাধারণ আবার এর সঙ্গে থাকবে বিভিন্ন রকম মশলার সঠিক সংমিশ্রণ।'
তার মতে, ভুনা খিচুড়ির ফ্লেভার ল্যাটকা খিচুড়ির তুলনায় বেশি তীব্র যা খিচুড়ির আসল অকৃত্রিম স্বাদকে নষ্ট করে ফেলে।
এখন কথা বলা যাক সাধাসিধা ল্যাটকা খিচুড়ি নিয়ে। ল্যাটকা খিচুড়ির মূল বৈশিষ্ট্য হলো এর সাধাসিধে ও ঝামেলামুক্ত স্বভাব। সাধাসিধে মজাদার এই খাবারটির জন্য কোনো বিশেষ দিন লাগে না, বিশেষভাবে পরিবেশনেরও কোন ঝামেলা নেই।
সাবেক স্কুল শিক্ষক নাজমুন নাহার বলেন, 'খিচুড়ি খাওয়ার অভিজ্ঞতা হওয়া উচিত সহজ, সাধারণ ও ঝামেলামুক্ত। মশলাদার ও অনেক ফ্লেভার পেতে চাইলে তার জন্য আছে তেহারি বা বিরিয়ানি!'
তবে সবাই এরকম হালকা স্বাদ পছন্দ করেন না। ল্যাটকা খিচুড়ির কড়া সমালোচক ইসমত হাসনিন বলেন, 'ল্যাটকা খিচুড়ি এতই স্বাদহীন যে এটিকে খিচুড়ি বলাই যায় না। খিচুড়িতে মশলা কোথায়? আমি কি অসুস্থ যে এরকম খিচুড়ি খাব?' মজার ছলে বলা ইসমত হাসনিনের এই কথাগুলো যেন ভুনা খিচুড়িপ্রেমীদের মনের কথা!
আরেক খিচুড়িপ্রেমী সুবাহ তারান্নুম বলেন, 'ল্যাটকা খিচুড়ি আমার কাছে ভীষণ আরামদায়ক একটি খাবার, অন্যদিকে ভুনা খিচুড়ি যেকোনো আয়োজন বা অনুষ্ঠানে থাকা চাই। আপনি যেমন নিজের বাড়িতে একান্তে কাটানো একটি সুন্দর নিরিবিলি সন্ধ্যা এবং রাতে শহরে ঘুরে বেড়ানোর আনন্দের কোন তুলনা করতে পারবেন না, তেমনি ল্যাটকা ও ভুনা খিচুড়ি- এই দুটোর মধ্যেও তুলনা হয় না।'
তিনি আরো যোগ করেন, 'সাধাসিধে ল্যাটকা খিচুড়ি হোক বা মশলাদার ভুনা খিচুড়ি, দুটোই অসাধারণ। কোনো একটিকে বাদ দিয়ে আমি থাকতে পারব না।'
এই কথার সঙ্গে একমত পোষণ করে খাদ্যরসিক ড. মিতুল বলেন, 'দুই ধরনের খিচুড়ি কিন্তু এক শেকড় থেকেই এসেছে এবং পরে এটি ভিন্ন রূপ নিয়েছে। ল্যাটকা খিচুড়ির মূল বৈশিষ্ট্য হলো এটি খুব সাধারণভাবে খাওয়ার জন্য প্রস্তুত করা হয়। আর ভুনা খিচুড়ি যেকোনো আয়োজন উদযাপনে বিশেষভাবে তৈরি করা হয়।'
শেষ পর্যন্ত বলা যায় যে, আসল বিজয়ী সেই যে জানে কখন কোন ধরনের খিচুড়ি উপভোগ করতে হবে। তাই পরের বার যখন দুই ধরনের খিচুড়ির মধ্যে একটিকে বেছে নিতে হবে তখন নিজেকে প্রশ্ন করুন, আপনি কি নিজের ঘরে একান্ত নিরিবিলি সময় কাটাতে চাইছেন নাকি মশলাদার ভারী কোনো খাবার খেতে চাইছেন? যেটাই বেছে নেন না কেন, খিচুড়ি আপনাকে নিরাশ করবে না!
অনুবাদ করেছেন সৈয়দা সুবাহ আলম
Comments