রতন টাটার যত অর্জন

রতন টাটা ছিলেন ভারতের অন্যতম প্রধান শিল্প গ্রুপ টাটা সন্স-এর চেয়ারম্যান এমিরেটাস। দুই দশকের বেশি সময় ধরে তিনি এই শিল্প গ্রুপ পরিচালনা করেছেন। তাকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। তবে শুধু এটুকু বললে তার পরিচয় সম্পূর্ণ হবে না।
ডেট্রয়েটে অটোমোটিভ হল অব ফেইম অনুষ্ঠানে রতন টাটা। ফাইল ছবি: রয়টার্স
ডেট্রয়েটে অটোমোটিভ হল অব ফেইম অনুষ্ঠানে রতন টাটা। ফাইল ছবি: রয়টার্স

বুধবার দিবাগত রাতে মুম্বাইয়ের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ভারতের শীর্ষ শিল্পপতি এবং টাটা গ্রুপের কর্ণধার রতন টাটার মৃত্যু হয়েছে।

আজ বৃহস্পতিবার প্রকাশিত ডয়চে ভেলের এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে রতন টাটার জীবনের নানা অর্জন।

রতন টাটা ছিলেন ভারতের অন্যতম প্রধান শিল্প গ্রুপ টাটা সন্স-এর চেয়ারম্যান এমিরেটাস। দুই দশকের বেশি সময় ধরে তিনি এই শিল্প গ্রুপ পরিচালনা করেছেন। তাকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। তবে শুধু এটুকু বললে তার পরিচয় সম্পূর্ণ হবে না।

টাটা ন্যানো গাড়ি ও রতন টাটা। ছবি: রয়টার্স
টাটা ন্যানো গাড়ি ও রতন টাটা। ছবি: রয়টার্স

তিনি ছিলেন একজন দূরদর্শী শিল্পপতি। ভারতের টাটাকে আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডে পরিণত করেছিলেন তিনি। সংস্থাটিকে অত্যন্ত লাভজনক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত করেছিলেন, সেবার দিক দিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন নতুন উচ্চতায়। পাশাপাশি, এই পুরোটা সময় তিনি অত্যন্ত মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি বজায় রেখেছিলেন। 

একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে কীভাবে মানবিক দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিচালনা করতে হয়, তার উজ্জ্বল উদাহরণ ছিলেন রতন টাটা।

দীর্ঘ কর্মজীবনে অসংখ্য মানুষকে সাহায্য করেছেন। তিনি যদি বুঝতেন, কেউ সৎভাবে পরিশ্রম করে কোনো ভালো কাজ করতে যাচ্ছে, তিনি তখন সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতেন। আর এটাই তাকে অন্য শিল্পপতিদের থেকে আলাদা করে দিয়েছিল। তিনি যখন টাটা গ্রুপর পরিচালক, তখন তা জাগুয়ার ল্যান্ড রোভারকে অধিগ্রহণ করে। টাটা স্টিল কোরাসকে নিয়ে নেয়। এভাবেই বিশ্বের শিল্প মানচিত্রে টাটা নিজেদের গুরুত্ব অনেকটাই বাড়িয়ে নেয়।

রতন টাটার কর্মজীবন

টাটার এজিএম অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখছেন রতন টাটা। ছবি: রয়টার্স
টাটার এজিএম অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখছেন রতন টাটা। ছবি: রয়টার্স

১৯৯১ সালে জাহাঙ্গীর রতনজি দাদাভাই (জেআরডি) টাটা চেয়ারম্যানের পদ ছেড়ে দেন, আর সেই পদে অভিষেক হয় রতন টাটার।

তিনি চেয়ারম্যান হিসাবে দুইটি কাজ করেন। প্রথমত, সংস্থার ভেতর প্রশাসনিক সংস্কার এবং বিভিন্ন খাতে টাটার ব্যবসার বিস্তার ঘটানো। তার আমলে টাটা গ্রুপের ছাতার নিচে ৩২টি নতুন সংস্থা তৈরি হয়। এগুলোর মাধ্যমে নতুন নতুন খাতে প্রবেশ করে টাটা।

রতন টাটার দূরদর্শিতার ফলে গাড়ি, বিমা, সার, টেলিযোগাযোগ, বিদ্যুৎ, হোটেল, সফটওয়ার, কনসালটেন্সির ক্ষেত্রে ভারতে অন্যতম প্রধান সংস্থায় পরিণত হয় টাটা।

ছোট গাড়ি তৈরি

টাটা ন্যানো গাড়ির উদ্বোধন করছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও রতন টাটা। ছবি: রয়টার্স
টাটা ন্যানো গাড়ির উদ্বোধন করছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও রতন টাটা। ছবি: রয়টার্স

রতন টাটার স্বপ্ন ছিল সাধারণ মধ্যবিত্তের জন্য চার চাকার গাড়ির ব্যবস্থা করবেন। সেখান থেকেই ন্যানো গাড়ি তৈরির পরিকল্পনা শুরু। তিনি বলেছিলেন, একবার তিনি মোটরসাইকেলে একজনকে পুরো পরিবার নিয়ে যেতে দেখেন। বাবা, মা ও তাদের দুই সন্তান সেই মোটর সাইকেলের আরোহী ছিলেন। এই ঘটনা দেখেই তার মনে চিন্তার উদ্রেক হয়—এমন একটি গাড়ি নির্মাণ করবেন, যা মধ্যবিত্তের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যেই থাকবে।

আর কাউকে কখনো এভাবে দ্বিচক্রযানে করে বিপদের ঝুঁকি নিয়ে পুরো পরিবারসহ কোথাও যেতে হবে না। সেই চিন্তা থেকেই এক লাখ টাকার ন্যানো গাড়ি তৈরির উদ্যোগ নেন তিনি।

সিঙ্গুরে ন্যানো কারখানা তৈরি করার জন্য জমি দেয়া নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সঙ্গে টাটা মোটরসের সমঝোতা হয়। তারপর সেই জমি অধিগ্রহণ, বিক্ষোভ, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সহ অন্যদের আন্দোলন, শেষপর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গ থেকে ন্যানো কারখানা বন্ধ করে টাটার চলে যাওয়া, এই পুরোটাই হয়েছে রতন টাটার সময়েই। 

তবে তারপরও ন্যানো গাড়ি সড়কে নামিয়েছেন তিনি। তবে তার এই উদ্যোগ পুরোপুরি সফল হয়নি।

ন্যায়পরায়ণ রতন টাটা

মুম্বাইয়ে রতন টাটার প্রতি শেষ শ্রদ্ধান নিবেদন করতে মানুষের ঢল নামে। ছবি: রয়টার্স
মুম্বাইয়ে রতন টাটার প্রতি শেষ শ্রদ্ধান নিবেদন করতে মানুষের ঢল নামে। ছবি: রয়টার্স

২০১২ সালে ৭৫ বছর বয়সে তিনি টাটা গ্রুপের চেয়ারম্যানের পদ ছেড়ে দেন। কারণ, টাটার নীতি হলো চেয়ারম্যান ৭৫ বছর পর্যন্ত পদে থাকেন। এই নীতি তিনিই তৈরি করেছিলেন।

জন্মলগ্ন থেকে টাটা গ্রুপ জনহিতকর কাজের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত রেখেছে। রতন টাটার আমলে সেই কাজের আরো বিস্তার হয়েছে। গ্রামোন্নয়ন, চিকিৎসা, শিক্ষা, জলের সমস্যার সমাধান, মেয়েদের স্বনির্ভর করে তোলার মতো কাজ অক্লান্তভাবে করেছেন রতন টাটা। তিনি রতন টাটা ট্রাস্টের মাধ্যমেও জনসেবার কাজ করে গেছেন।

২০০৮ সালে মুম্বাইতে তাজমহল হোটেলে জঙ্গি হামলার পর যেভাবে তিনি কর্মীদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, তা অতুলনীয়।

তিনি নিজেই গাড়ি চালিয়ে অফিসে যেতেন। উড়োজাহাজও চালাতে পারতেন। মানুষকে প্রত্যাশার থেকে বেশি দিতে চাইতেন। তিনি বলেছিলেন, টাটা গ্রুপকে তিনি পিতৃতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের বেড়াজাল থেকে বের করে এনে পেশাদারি সংস্থায় পরিণত করবেন।

এই অকৃতদার, ব্যতিক্রমী মানুষটি ভারতীয় শিল্পমহলে বিশাল শূন্যতা সৃষ্টি করে চলে গেলেন।

পিটিআই, এএনআই

Comments