‘গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সংহত না হলে বিচার বিভাগও স্বাধীন হবে না’

ছবি: রাশেদ সুমন/স্টার

প্রাণক্ষয়ী গণঅভ্যুত্থানের ভেতর দিয়ে ৫ আগস্ট স্বৈরাচারি আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতায় বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা আনার পাশপাশি বিচারকদের বিচারিক পদে মুক্তভাবে দায়িত্ব পালনের নিশ্চয়তার জন্য যথাযথ উদ্যোগ নেওয়ার জোর দাবি জানিয়েছেন একটি আলোচনা অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া বক্তারা।

এর পাশাপাশি বিচার বিভাগের সংস্কারের অংশ হিসেবে জেলা আদালতগুলোকে সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ অনুসারে আইন মন্ত্রণালয় থেকে সুপ্রিম কোর্টের অধীনে নিয়ে আসা এবং পুলিশ ও কারা সংস্কারের তাগিদও দিয়েছেন তারা। কথা বলেছেন বিচার বিভাগের জন্য আলাদা সচিবালয় ও বিচারক পদায়নের জন্য পৃথক নীতিমালা নিয়েও।

সেইসঙ্গে বক্তারা বলেছেন, এগুলোর সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোকেও সংস্কারের ভেতর দিয়ে যেতে হবে। আর নিয়মিত সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সংহত করতে হবে। নাহলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষা করা যাবে না।

আজ শনিবার রাজধানীর ফার্মগেটে দ্য ডেইলি স্টার সেন্টারে 'অভ্যুত্থান ও আইনি সংস্কার: বিচার বিভাগের স্বাধীনতা' শীর্ষক এ আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। এতে আইনজীবী, সংবিধান বিশেষজ্ঞ, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের শিক্ষক ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা অংশ নেন।

এটি ছিল দ্য ডেইলি স্টারের আয়োজনে সংবিধান বিষয়ক সিরিজ আলোচনার দ্বিতীয় পর্ব।

অনুষ্ঠানে অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল অনিক আর হক বলেন, বিচারকদের বুঝতে হবে যে হেইট স্পিচ কি, আর গঠনমূলক সমালোচনা কোনটা। এ দুটি বিষয় পুরোপুরি বিপরীত। এখানে বিচারকদের প্রশিক্ষণের ব্যাপার আছে, তাদের দৃষ্টিভঙ্গির বিষয় আছে।

অনিক আর হক মনে করেন, বিদ্যমান ব্যবস্থাপনায় মামলা জট ও বিচারিক প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতার জন্য সংশ্লিষ্ট অন্যদের পাশাপাশি আইনজীবীদেরও দায় আছে।

এখনকার অন্তর্বর্তী সরকার গৃহীত বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের সদস্য ও সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী তানিম হোসেন শাওন বলেন, 'আমাদের গত ১৫ বছরের যে গণতন্ত্রহীনতা সেখানে বিচার বিভাগের খুব বড় ভূমিকা ছিল। এটা মূলত উচ্চ আদালতের ক্ষেত্রে। উচ্চ আদালত যদি পুরোপুরি রাজনৈতিকভাবে নিয়ন্ত্রিত হয় তাহলে আমরা কীভাবে প্রত্যাশা করি যে নিম্ন আদালত এর মেরুদণ্ড দেখাবে?'

তানিম হোসেন আরও বলেন, 'আমরা যদি নিয়ন্ত্রণটা সুপ্রিম কোর্টের কাছে দিয়ে দেই তাহলে বিচার বিভাগ মোটামুটি স্বাধীন হিসেবে কাজ করতে পারবে।'

বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সহসম্পাদক রুমিন ফারহানা বলেন, 'অসুস্থ রাজনীতি ও অসুস্থ রাজনীতিবিদ দিয়ে যখন দেশ পরিচালিত হয় তখন বিচার বিভাগ একটি আলাদা প্রতিষ্ঠান হিসেবে শক্তিশালীভাবে দাঁড়াবে—এ চিন্তা করাটাই ভুল।'

এই বিএনপি নেতা মনে করেন, জুডিশিয়ারি পঁচে দুইভাবে। একটা হচ্ছে পুরোপুটি রাজনৈতিক নিয়োগ ও রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ। আরেকটি হলো অর্থ, অন্যায্য সুবিধা। এক্ষেত্রে বিচারকদের পাশাপাশি আইনজীবীদের দায়ও দেখেন তিনি।

তাই রুমিন ফারহানার ভাষ্য, বিচার বিভাগের জন্য পৃথক সচিবালয় করতে হবে, যেটা সুপ্রিম কোর্টের অধীনে থাকবে। বিচারক পদায়নের জন্য পৃথক নীতিমালা করতে হবে।

আলোচনায় অংশ নিয়ে গণসংহতি আন্দোলনের কেন্দ্রীয় পরিচালনা কমিটির সদস্য ও প্রাবন্ধিক ফিরোজ আহমেদ বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিতে পুলিশ, জনপ্রশাসন ও চলতি ধারার রাজনীতিতে সংস্কারের ওপর জোর দেন।

ফিরোজ আহমেদ বলেন, 'আদালত আবমাননার একটা প্রশ্ন আমাদের দেশে আছে যে আদালতের রায়ের সমালোচনা করা যাবে না, পর্যালোচনা করা যাবে না। বরং আমরা দাবি করব যে আদালতের রায়, এর শুনানি এবং বিচারকদের মন্তব্য আরও বেশি গণমাধ্যমে আসতে দেওয়া উচিত।'

নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের প্রভাষক নাফিজ আহমেদ বিচারকদের নিয়োগ ও অপসারণ—দুই প্রক্রিয়াতেই জনসম্পৃক্ততা বাড়ানোর সুপারিশ করেন। জোর দেন তাদের যথাযথ প্রশিক্ষণের ওপর।

বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনাল (বিইউপি)- এর আইনের শিক্ষক ইমরান আজাদ দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আইন শিক্ষার অবস্থা ও এর গুরুত্ব নিয়ে কথা বলেন। 

ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির আইনের সহকারী অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ সজল মনে করেন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নির্ভর করে সার্বিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ওপর।

আলোচনা অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে কারাবরণকারী জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী খাদিজাতুল কুবরা, ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের আইন ও মানবাধিকার বিভাগের শিক্ষক ফারজানা আক্তার, কবি-লেখক কাজল রশীদ শাহীন, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এস এম খালেকুজ্জামান, ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদ, ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক সাঈদ আব্দুল্লাহ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক সাইমি ওয়াদুদ, এক্টিভিস্ট সিলমী সাদিয়া, সংবিধান গবেষক স্নেহাদ্রি চক্রবর্তী ও ডেইলি স্টারের সাংবাদিক ইমরান মাহফুজ।

অনুষ্ঠানের শুরুতে স্বাগত বক্তব্যে ডেইলি স্টারের সম্পাদক ও প্রকাশক মাহফুজ আনাম বলেন, 'বিচার বিভাগ স্বাধীন হলে তা রাজনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্ত থাকবে, দলীয় প্রভাব থেকে মুক্ত থাকবে। স্বাধীনভাবে বিচারকাজ পরিচালনার একটা পরিবেশ তৈরি হবে। এতে মানুষ সুশাসন পাবে।'

মাহফুজ আনাম আরও বলেন, 'আমাদের পুরো উদ্যোগের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে সাধারণ জনগণ যেন ন্যায়বিচার পায়, যেটা না পেতে পেতে সত্যিকার অর্থে বিচার বিভাগের ওপর আমাদের আস্থা একেবারে চলে গেছে।'  

অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন সংবিধান বিশেষজ্ঞ আরিফ খান।

Comments

The Daily Star  | English

Fulfilling sky-high expectations Yunus govt’s key challenge

Says ICG report on completion of interim govt’s 100 days in office

2h ago