হিন্দু বাড়িতে হামলা চালিয়ে সর্বস্ব লুটের অভিযোগ বিএনপি নেতার বিরুদ্ধে

সরেজমিনে বাড়িটির প্রতিটি কক্ষে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা কাগজপত্র দেখা যায়। ছবি: স্টার

কিশোরগঞ্জ জেলা শহর থেকে মাত্র পাঁচ কিলোমিটার দূরত্বের ব্রাহ্মণকচুরি গ্রামের একটি হিন্দু পরিবারে হামলা চালিয়ে কোটি টাকা মূল্যের স্বর্ণালংকার, নগদ অর্থ ও আসবাবপত্র লুট করার অভিযোগ উঠেছে স্থানীয় এক বিএনপি নেতার বিরুদ্ধে। একইসঙ্গে উল্টো ওই পরিবারের এক সদস্যকে রাজনৈতিক হত্যা মামলায় ফাঁসানোর অভিযোগও উঠেছে।

পরিবারটির পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে এই ঘটনায় মামলা করার পাশাপাশি প্রতিকার চেয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কাছে লিখিত আবেদনও করা হয়েছে।

অভিযোগে জানা গেছে, ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পদত্যাগের দিন স্থানীয় রশিদাবাদ ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান, ইউনিয়ন বিএনপির সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক ও কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলা বিএনপির সদস্য ইদ্রিস মিয়ার নেতৃত্বে একদল লোক ব্রাহ্মণকচুরি গ্রামের প্রয়াত জয় কৃষ্ণ বর্মনের বাড়িতে হামলা-লুটপাট চালায়।

পরিবারটির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সন্ত্রাসীদের ভয়ে ওই বাড়ির বৃদ্ধা গৃহকর্ত্রী গীতা রাণী বর্মন, তার বড় ছেলে সফল বর্মন, বড় ও ছোট ছেলের বউ এবং এইচএসসি পরীক্ষার্থী নাতি অপূর্ব বর্মন জয় ও স্কুলপড়ুয়া নাতনি নিজেদের বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে আছেন। গীতা রাণীর ছোট ছেলে চন্দন বর্মন সিঙ্গাপুরপ্রবাসী। হামলার ঘটনার প্রায় ৬০ দিন অতিবাহিত হলেও এখনো তারা প্রাণভয়ে বাড়ি ফিরতে সাহস পাচ্ছেন না।

গীতা রাণী বর্মন দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, ৫ আগস্ট বিকেল ৩টা নাগাদ ইদ্রিসের নেতৃত্বে ১৫-২০ জনের একটি দল তাদের বাড়িতে ঢুকে হামলা-ভাঙচুর শুরু করে। তাদের কাছে হকিস্টিক, ককটেল ও পিস্তল ছিল। তারা সেখানে ককটেল বিস্ফোরণ ঘটায় ও পিস্তল দিয়ে কয়েক রাউন্ড গুলিও ছুঁড়ে। পরে সন্ধ্যার পর পিকআপে করে ইদ্রিসের নেতৃত্বেই ৩০-৪০ জন এসে বাড়ির প্রধান ফটক খুলে নেওয়াসহ ঘরে থাকা স্বর্ণালংকার, নগদ অর্থ, খাট, সোফা, আলমিরা, শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র, ফ্রিজ, টেলিভিশন, পানির সাবমারসিবল মোটরসহ সবকিছু গাড়িতে তুলে নিয়ে যায়।

মঙ্গলবার সরেজমিনে ওই গ্রামে গিয়ে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে বাড়িটিতে হামলা ও লুটপাটের ঘটনার সত্যতা পাওয়া গেছে। সরেজমিনে পাকা বাড়িটির ছয়টি কক্ষেই ভাঙচুরের আলামত দেখা গেছে। বাড়িটির প্রতিটি কক্ষে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা কাগজপত্র ছাড়া আর কিছুই দেখা যায়নি।

গ্রামবাসীর ভাষ্য, প্রয়াত জয় কৃষ্ণ বর্মনের পরিবারের সঙ্গে সাবেক চেয়ারম্যান ইদ্রিস আলীর কোনো ধরনের শত্রুতা ছিল না। কেবল 'ধনাঢ্য হিন্দু পরিবার' হওয়ায় লুট করার উদ্দেশ্যে ইদ্রিস দলবল নিয়ে এ হামলা চালিয়েছে।

ওই বাড়িটির ঠিক পাশেই বসবাসকারী দুইজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডেইলি স্টারকে জানান, ইদ্রিসের নেতৃত্বে ৫ আগস্ট দুই দফায় ওই বাড়িটিতে হামলা চালিয়ে সব লুটপাট করে নিয়ে যাওয়া হয়।

গীতা রাণী জানান, এই ঘটনায় প্রতিকার চেয়ে তার নাতি অপূর্ব বর্মন জয় গত ২৭ সেপ্টেম্বর বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে গিয়ে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কাছে লিখিত আবেদন করেছেন। এ ছাড়া, তারা কিশোরগঞ্জের পুলিশ সুপার ও জেলা প্রশাসকের কাছেও লিখিত আবেদন করেছেন।

তিনি আরও জানান, এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন নম্বর থেকে ফোন করে এখনো তার নাতিকে হুমকি-ধামকি দেওয়া হচ্ছে।

ইদ্রিস মিয়া। ছবি: সংগৃহীত

'মামলা নিতে চায়নি পুলিশ'

পরিবারটির ভাষ্য, এই ঘটনার পর পুলিশের কাছে গেলেও শুরুতে মামলা নিতে চায়নি তারা। পরে সদর দপ্তরের হস্তক্ষেপে স্থানীয় পুলিশ মামলা নিয়েছে।

গীতা রাণীর ভাই প্রদীপ বর্মন ডেইলি স্টারকে বলেন, এ ঘটনার পরদিন তারা থানায় মামলা করতে যান। কিন্তু শুরুতে পুলিশ বিষয়টি আমলে নেয়নি। পরে পুলিশের সদর দপ্তরের যোগাযোগ করা হয়। পরবর্তীতে ঘটনার ৪৮ দিন পর ২৩ সেপ্টেম্বর মামলা এফআইআরভুক্ত করে কিশোরগঞ্জ সদর থানার পুলিশ।

জানা গেছে, গীতা রাণী বর্মনের বাদী হয়ে করা ওই মামলায় ইদ্রিসসহ ১০ জনের নাম উল্লেখ ও অজ্ঞাতনামা আরও ৪০ থেকে ৫০ জনকে আসামি করা হয়েছে।

কিন্তু এই মামলায় এখন পর্যন্ত কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। বরং আসামিরা প্রকাশ্যেই ঘুরে বেড়াচ্ছেন বলে অভিযোগ ভুক্তভোগী পরিবারের।

কে এই ইদ্রিস

২০১৬ সালের ২২ মার্চ অনুষ্ঠিত ইউপি নির্বাচনে বিএনপির মনোনয়ন নিয়ে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন ব্রাহ্মণকচুরি গ্রামের বাসিন্দা ইদ্রিস মিয়া। মূলত ঢাকা শহরে ভাঙ্গারি পণ্যের ব্যবসা রয়েছে তার। সেই সূত্রে বিভিন্ন চোরাই মালামাল কেনাবেচায় তিনি জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে। বিগত সময়ে ঢাকা ও টাঙ্গাইলে মোবাইল ফোন টাওয়ারের চোরাই মালামাল কেনার অপরাধে তার নামে একাধিক মামলা হয় এবং পরবর্তীতে তিনি জেলও খাটেন। এ ছাড়া প্রায় ১৮ বছর আগে ঢাকায় নিজ গ্রামের একজনকে খুন করার অপরাধে তিনি কারাভোগও করেছিলেন।

নিজ এলাকায় ইদ্রিসের পেশীশক্তির প্রভাব থাকায় কিশোরগঞ্জ জেলা বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সদর উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক খালেদ সাইফুল্লাহ সোহেলের ঘনিষ্ঠভাজন হয়ে ওঠেন তিনি। স্থানীয়ভাবে 'ভিপি সোহেল' নামে পরিচিত এই বিএনপি নেতার রশিদাবাদ এলাকায় একাধিক মুরগি ও মাছের খামার থাকার কারণে তাদের মধ্যে নিয়মিত যোগাযোগ রয়েছে। ফলে জেলা বিএনপির প্রভাবশালী নেতার 'আশীর্বাদ' কাজে লাগিয়ে ইদ্রিস এলাকায় দাপট দেখান বলে অভিযোগ।

ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যকে উল্টো মামলায় ফাঁসানোর অভিযোগ

ভুক্তভোগী পরিবারটি জানায়, হামলা-লুটপাটের ঘটনার দুদিন পর ৭ আগস্ট জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মাজহারুল ইসলাম, সদর উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক খালেদ সাইফুল্লাহ সোহেল ও সাংগঠনিক সম্পাদক হাজী ইসরাইলের নেতৃত্বে বিএনপি নেতারা তাদের বাড়িটি সরেজমিন পরিদর্শন করেন। কিন্তু ৩০ আগস্ট কিশোরগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশফাকুল ইসলাম টিটুর বাড়িতে আগুনে পুড়িয়ে দুজনকে হত্যার ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলায় এই পরিবারের সদস্য সফল বর্মনকে ফাঁসিয়ে দেওয়া হয়। মামলাটির এজাহারনামীয় ৮৮ জনের মধ্যে ৪৩ নম্বর আসামি করা হয় সফলকে।

গীতা রাণী বলেন, আমাদের বাড়িতে হামলা-লুটপাট করা হলো, আমাদের বাড়িছাড়া করা হলো। এখন উল্টো আবার আমার ছেলেকে মিথ্যা হত্যা মামলায় ফাঁসানো হলো।

এদিকে ইতোমধ্যে দলীয় সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে গত মঙ্গলবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ইদ্রিস মিয়াকে দল থেকে বহিষ্কার করে কিশোরগঞ্জ জেলা বিএনপি।

কিশোরগঞ্জ জেলা বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক খালেদ সাইফুল্লাহ সোহেল ডেইলি স্টারকে বলেন, 'যত কাছেরই হোক, আমরা যখন জানতে পারলাম ইদ্রিস কাজটা ভালো করেন নাই, তখন তাকে দল থেকে অব্যাহতি এবং বহিষ্কার করে দিয়েছি। এ ছাড়া তার বিরুদ্ধে যে মামলা, তা আইনগতভাবে প্রসেডিং হচ্ছে।'

তিনি আরও জানান, কেন্দ্রীয় বিএনপি থেকে এই বিষয়টি দেখার নির্দেশনা আসার পর ইদ্রিসের বিরুদ্ধে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ইদ্রিস মিয়া ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীরা আমাকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসানোর জন্য ষড়যন্ত্র করছে।'

কিশোরগঞ্জ সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার (ওসি) নম্বরে ফোন করলে ইন্সপেক্টর (তদন্ত) মো. শ্যামল মিয়া ধরে জানান, আজকেই (বৃহস্পতিবার) ওসিকে অন্যত্র বদলি করা হয়েছে।

মামলার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, তদন্ত সাপেক্ষে এই মামলায় আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

কিশোরগঞ্জের পুলিশ সুপার (এসপি) মো. হাছান চৌধুরী ডেইলি স্টারকে বলেন, ব্রাহ্মণকচুরি গ্রামে হামলার বিষয়টি আমি জানি। এ ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের আইনের আওতায় নিয়ে আসতে পুলিশ কাজ করছে।

কিন্তু এতদিনেও কেন কাউকে গ্রেপ্তার করা যায়নি বা শুরুতে মামলা নিতে না চাওয়ার কারণে জানতে চাইলে এসপি বলেন, পুলিশ কাজ করছে। যত দ্রুত সম্ভব আসামিদের ধরা হবে। আর কেন মামলা নিতে দেরি হলো, তা খতিয়ে দেখা হবে।

এই বিষয়ে জানতে কিশোরগঞ্জের জেলা প্রশাসক ফৌজিয়া খানকে অন্তত পাঁচবার ফোন করলেও তিনি ধরেননি। ক্ষুদেবার্তা পাঠালেও কোনো জবাব দেননি।

Comments

The Daily Star  | English

Moody's downgrades Bangladesh's ratings to B2, changes outlook to negative

“The downgrade reflects heightened political risks and lower growth, which increases government liquidity risks, external vulnerabilities and banking sector risks, following the recent political and social unrest that led to a change in government,” said Moody’s.

51m ago