চাকিরপশার নদী, মুক্তি তোমার কতদূরে?
কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলায় একটি নদী আছে। স্থান বিশেষে এর নাম চাকিরপশার, মরাতিস্তা এবং বুড়িতিস্তা। ২০ কিলোমিটার দীর্ঘ এ প্রবাহের মধ্যবর্তী ছয়টি মৌজার দখল উচ্ছেদ পাঁচ বছরেও সম্ভব হয়নি।
এরই মধ্যে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চারজন চেয়ারম্যান, কুড়িগ্রামের তিনজন জেলা প্রশাসক পরিবর্তন হয়েছে। চতুর্থ জেলা প্রশাসক এসেছেন। রাজারহাটের ইউএনও বদলি হয়েছেন অন্তত ছয়জন। সহকারী কমিশনার (ভূমি) বদলি হয়েছেন কয়েকজন। তারা সবাই মিলেও চাকিরপশার নদীর মধ্যবর্তী ছাটমল্লিকবেগ, নাফাডাঙা, সদাগড়, খালিসা, চাকিরপশার তালুক এবং চান্দামারী মৌজার দখল উচ্ছেদ করতে পারেনি।
দখলকৃত ছাটমল্লিখবেগ ছাড়া পাঁচটি মৌজার জমি বিলশ্রেণিভুক্ত। ক্যাডাস্ট্রাল সার্ভে (সিএস) যখন করা হয়েছে, তখন নদীর ভেতরের প্রশস্ত ও তুলনামূলক অধিক গভীর এলাকা সাধারণত বিল শ্রেণি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
পাঠানহাট নামক স্থানে এলজিইডি চাকিরপশারের প্রবাহে আড়াআড়ি সেতুবিহীন সড়ক নির্মাণ করেছে। ফলে প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়েছে। হাজার হাজার একর তেফসলি জমিতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে।
পাঁচ বছরে নদীটি দখলমুক্ত করতে চাকিরপশার নদী সুরক্ষা কমিটির যারা আন্দোলন করছেন, তাদের অনেককে অবৈধ দখলদাররা শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করেছে। অনেকগুলো মামলা করেছে দখলদাররা। আন্দোলনকারীদের নামে যখন যে অপবাদ দিলে সুবিধা হয়, সেই অপবাদ দিয়ে যাচ্ছে। আগে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সর্বদলীয় দখলদার জোট ছিল। এখন সেখানে বিএনপির পাড়া-মহল্লার পাতি নেতারা নেতৃত্ব নেওয়ার চেষ্টা করছে। উপজেলা-জেলা পর্যায়ের নেতাদের দায়িত্ব তাদের থামানো। কিন্তু থামানো হবে কি না, বোঝা যাচ্ছে না।
আওয়ামী লীগের নেতা ও মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়ে একজন অবৈধ দখলদার যা করেছে তা সারা দেশে বিরল। দখলকৃত জমি একটি সংস্থার নামে দিয়েছে। কেউ এই নামসর্বস্ব সংস্থাটি দেখেনি। অদৃশ্য এই সংস্থা কেবল দেখতে পেয়েছে একটি সরকারি ব্যাংক।
বিল শ্রেণিভুক্ত জমির মালিক জনগণ। ব্যক্তিগতভাবে কারো মালিকানা লাভের সুযোগ নেই। সেই জমি বন্ধক রেখে অদৃশ্য সংস্থার নামে ওই ব্যাংক প্রায় কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে। ঋণ পরিশোধ না করে বন্ধক থাকা অবস্থায় জমি বিক্রি করে দিয়েছে সেই মুক্তিযোদ্ধা। নামের সামনে বীর মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় এবং আওয়ামী লীগ নেতা হওয়ার কারণে তার সব অপরাধ মাফ করা হয়েছে। যদিও তিনি প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা কি না, এ নিয়ে বিতর্ক আছে।
কথায় কথায় সবার নামে মামলা দিতে কোনো বিলম্ব হয় না ওই আওয়ামী লীগ নেতার। চাকিরপশার নিয়ে কলাম লিখেছি বলে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে আমার বিরুদ্ধে মামলা দিয়েছে। প্রথম আলোয় প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ায় প্রতিবেদক, বার্তা সম্পাদক এবং সম্পাদকের নামেও মামলা দিয়েছে। মিথ্যা মামলা দেওয়ায় তার জুড়ি মেলা ভার। দেশে ন্যূনতম আইনের প্রয়োগ থাকলে যার জেলে থাকার কথা, তিনি সগর্বে নদী রক্ষার আন্দোলনকারীদের হেনস্থা করে চলেছেন।
বিলের জমি শ্রেণি পরিবর্তন করা কিংবা ব্যক্তির নামে দলিল হওয়া আইন তথা সংবিধান পরিপন্থী। যদি কখনো ব্যক্তির নামে লিপিবদ্ধ হয়, তাহলে কীভাবে সেটা উদ্ধার করতে হবে তাও আইনে পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। আমলারা ভূমিবিষয়ক যে সামান্য লেখাপড়া করেন, তাতে এটুকু বোঝার কথা। এরপরও কেন হয়নি এটি যতই বিশ্লেষণ করা যাবে, দায়িত্বশীল সবার সম্পর্কে কদর্য ধারণা ততই বাড়তে থাকবে। প্রকাশ্যে ও গোপনে এর অনেক কারণ থাকতে পারে।
আমলাতান্ত্রিক মনস্তত্ত্ব বোঝা কঠিন। পূর্ববর্তী আমলারা চাকিরপশারের বিল শ্রেণিভুক্ত প্রায় আড়াইশ একর জমি ব্যক্তির নামে লিখে দেওয়ার কাজে সহায়তা করে গেছেন। পরবর্তী আমলারা সেই অবৈধ দখল কি উচ্ছেদ করতে চান না? কুড়িগ্রামের একজন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক—যিনি এখানে তিনজন জেলা প্রশাসকের সঙ্গে কাজ করেছে—এই অবৈধ দখলদারদের রক্ষাকবচ বলে মনে করেন আন্দোলনকারী অনেকে। যতদিন তিনি থাকবেন, ততদিন নদী উদ্ধার হবে না—এমন কথাও প্রচলিত।
নদীটি মুক্ত করতে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন অন্তত ডজনখানেক চিঠি দিয়েছে কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসককে। কমিশন থেকে কর্মকর্তারা সরেজমিন তদন্ত করে প্রতিবেদন দিয়েছে। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের সচিব আরেকবার এসে নির্দেশনা দিয়ে গেছে। মন্ত্রীপরিষদ বিভাগ থেকে নদীটি মুক্ত করার নির্দেশনা আছে। রংপুর বিভাগীয় কমিশনার নদীটি উদ্ধারের জন্য চিঠি দিয়েছে। গণমাধ্যমে প্রচুর প্রতিবেদন হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, ঋণদাতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক, দুদকের কাছে অভিযোগ জানানো হয়েছে।
তারপরও নদীটি মুক্ত করা সম্ভব হয়নি। অবৈধভাবে ১৪১ একর জমি লিজ দেওয়া হতো। সেই লিজ বন্ধ করা হলেও ১৪১ একর জমি মুক্ত করা সম্ভব হয়নি। অল্প পরিমাণ জমিতে জেলেরা এখন মাছ ধরতে পারে। জেলা প্রশাসক ১২৯টি মামলা করেছে রেকর্ড সংশোধনের জন্য। এই রেকর্ড সংশোধনের মামলার যে গতি, তাতে মামলার কাজ সম্পন্ন করতে শতবছর লাগবে বলে মনে হচ্ছে। জেলা প্রশাসকের উচিত, অবৈধ দখলদারদের মালিকানা বাতিল করা। সেটি আজও করা হয়নি।
অন্তর্বর্তী সরকারের পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান যখন বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী ছিলেন, তখন উচ্চ আদালতে মামলা করা হয়। এক বছরের বেশি সময় আগে উচ্চ আদালত বিল শ্রেণিভুক্ত অংশের অবৈধ দখল উচ্ছেদের জন্য নির্দেশনা দিয়েছে। তার একটিও বাস্তবায়ন করা হয়নি।
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর অবৈধ দখলদারদেরকে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের জন্য সাত কর্মদিবস উল্লেখ করে নোটিশ দেওয়া হয়েছিল। সেই নোটিশের সময়ও পেরিয়ে গেছে। কিন্তু অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ হয়নি। আমাদের বলা হয়েছে, বিল শ্রেণিভুক্ত জমিগুলোর খাজনা নেওয়া বন্ধ হয়েছে ২০২০ সালে। জমির খারিজও বন্ধ। এসব কথার কথা। এর মধ্যেও জমির খাজনা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে, এমনকি বিক্রিরও ব্যবস্থা করা হচ্ছে। চাকিরপশারের প্রায় ১৫ একর জমি এক নম্বর খাস-খতিয়ানে ফেরানো হয়েছে। কিন্তু এখনো অবৈধ দখলদারের কাছে আছে।
চাকিরপশার মুক্ত না হওয়ার ক্ষেত্রে একটি শক্তিশালী চক্র সক্রিয়। এই চক্রের অংশ হোক বা না হোক, দায় এড়াতে পারেন না ডিসি, এডিসি (রাজস্ব), আরডিসি, ইউএনও, এসি (ল্যান্ড)। রাজনৈতিক শক্তির দোহাই দিয়ে অনেকে নদীটি উদ্ধারে কালক্ষেপণ করেছেন। অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে তো সেই রাজনৈতিক দাপট নেই। তাহলে কি অন্য কোনো কারণে নদীটি উদ্ধার হচ্ছে না! যে কারণটি হতে পারে উৎকোচ!
কারণ যা-ই থাকুক না কেন, অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে থাকা কর্মকর্তারা দখলদারদের রক্ষাকবচ হয়ে থাকবেন, সেই দিন নেই। আমরা প্রত্যাশা করি, কুড়িগ্রামের নতুন জেলা প্রশাসক কালক্ষেপণ না করে দ্রুত নদীটি মুক্ত করবেন।
তুহিন ওয়াদুদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক এবং নদী রক্ষাবিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলের পরিচালক
wadudtuhin@gmail.com
Comments