অনাকাঙ্ক্ষিত উৎপাত

খুব সম্ভবত বড় ধরনের কোনো পরিবর্তনে মানুষের চিন্তা ও কাজে কিছুটা ছন্দপতন বা বৈকল্য চলে আসে। যার ফলে ব্যক্তি বা প্রশাসন অনেকক্ষেত্রে অবিবেচক, অবাস্তব ও কঠোর নিবর্তনমূলক অনেক কিছু চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে থাকে। যার সব শেষ সংযোজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে বহিরাগতমুক্ত করতে মোবাইল কোর্ট পরিচালনার ঘোষণা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী হিসেবে আমি এই সিদ্ধান্তের তীব্র প্রতিবাদ জানাই। এই সিদ্ধান্ত দ্রুত প্রত্যাহার করতে হবে। এই সিদ্ধান্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্য, ইতিহাস ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য বিরোধী। এ ছাড়া চাকরিপ্রার্থী শিক্ষার্থীদের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।

প্রথমে চাকরিপ্রার্থীদের কথাতেই আসি। দলীয় ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মী ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশিরভাগ শিক্ষার্থীই হল ছেড়ে যান। তবে সরকারি চাকরি সংক্রান্ত পড়াশোনার জন্য হল ছাড়ার পরের এক-দেড় বছর তারা নিয়মিত ক্যাম্পাসে যাতায়াত করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে পড়াশোনা করেন। ক্যারিয়ার, চাকরিসহ নানা বিষয়ে দলগত আলোচনা করেন। অনেকেই প্রেম ও বন্ধুত্বের সম্পর্কের নির্মল সময়গুলো কাটাতেও নিজ ক্যাম্পাসকেই সবচেয়ে নিরাপদ স্থান মনে করে থাকেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অফিসের বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, তাদের এখন বিচার করতে পারবে মোবাইল কোর্ট। কী অদ্ভুত, অসংবেদনশীল, আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত!

আমার মতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থীর কাছে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস এখনো আবেগের নাম। আমরা জীবনের সেরা সময়গুলো এই ক্যাম্পাসে পার করেছি। প্রেম করেছি, প্রতিবাদ মিছিল করেছি, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা-খুনসুটি, এমনকি মধ্যরাতে মল চত্বরে ফুটবলও খেলেছি। এখনো কোনো কাজে ক্যাম্পাসের পাশ দিয়ে গেলে আবাসিক হলে যাই, ক্যাম্পাসে আড্ডা দেওয়ার চেষ্টা করি। এই সিদ্ধান্তের পর এখন ক্যাম্পাসে গেলে কি আমাকে বহিরাগত হিসেবে চিহ্নিত করে মোবাইল কোর্টের মুখোমুখি হতে হবে? কী নিদারুণ অনাকাঙ্ক্ষিত শঙ্কা!

এ ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস একটি জনপরিসর, এটা সেনানিবাস বা সংরক্ষিত কোনো এলাকা নয়। এখানে নানা শ্রেণি-পেশা-বয়সের মানুষ নানা প্রয়োজনে সমবেত হন। প্রতিবাদ, আন্দোলন, সংগ্রাম, আলোচনা সভা, কর্মশালা, মানববন্ধন, সম্মেলনসহ নানা কারণে মানুষ এই ক্যাম্পাসে আসেন। প্রতিদিনই আসেন। নতুন এই বিজ্ঞপ্তির পর কি মানুষের এই আসা-যাওয়া বন্ধ হয়ে যাবে? এমন অনাকাঙ্ক্ষিত সিদ্ধান্ত কেন নেওয়া হলো?

কয়েকদিন আগেই হাজারো মানুষের ঢল নেমেছিল টিএসসিতে। বন্যার্ত মানুষের পাশে দাঁড়াতে ঢাকার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ ছুটে এসেছেন এই ক্যাম্পাসে। প্রক্টর অফিসের ভাষ্য অনুযায়ী তারা তো এখন বহিরাগত! বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কোন বিবেচনায় এই রকম অবিবেচক সিদ্ধান্ত নেন, সেটাই ভাববার বিষয়।

শেষ কথা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে দেশের গৌরবজনক ইতিহাস ও ঐতিহ্য যুক্ত। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সড়কে সড়কে ইতিহাস। সারাদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বিভিন্ন বয়সী মানুষ এই ক্যাম্পাসে আসেন ইতিহাসের সাক্ষাৎ পেতে। নিজেকে একাত্ম করতে। কিন্তু হায়! এখন তো তারা বহিরাগত। যেকোনো সময় মোবাইল কোর্টের মুখোমুখি হতে পারেন।

শেখ হাসিনা-পরবর্তী সময়ে ঠিক কোন বিবেচনায় বর্তমান প্রশাসন এই সিদ্ধান্ত নিল, তা হয়তো আমার মতো অনেকের অজানা। হয়তো দুয়েক দিন পর এ বিষয়ে জানা যাবে। হয়তো প্রশাসন অনেক অজুহাতও দেখাবে। কিন্তু পরিস্থিতি যাই হোক না কেন, নতুন বাংলাদেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে মোবাইল কোর্ট পরিচালনার হুমকি নিশ্চিতভাবেই অর্বাচীন সিদ্ধান্ত। এই অনাকাঙ্ক্ষিত উৎপাতের বিজ্ঞপ্তি বাতিল হোক আজই, এখনই।

রাহাত মিনহাজ: সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

Comments

The Daily Star  | English

Managing expectations the challenge for EC

The EC was a rubber stamp to legalise AL's usurpation of power in last three elections

1h ago