কে এই শীর্ষ সন্ত্রাসী সুইডেন আসলাম

সময়টা ১৯৯৬-৯৭ সাল। কারওয়ান বাজার, ফার্মগেট, রাজাবাজার, তেজগাঁও, তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল ও শেরেবাংলা নগরসহ ঢাকায় বিভিন্ন এলাকায় আলোচিত যেসব হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, এসবের পেছনে এসেছে একজনের নাম। নাম বারবার এলেও তাকে দেখা যেত না। শোনা যেত, ছদ্মবেশে ঘুরে বেড়াতেন তিনি। সবসময় পরে থাকতেন বুলেট প্রুফ জ্যাকেট। তার নাম শেখ মোহাম্মদ আসলাম ওরফে সুইডেন আসলাম।

ঢাকার একসময়ের শীর্ষ সন্ত্রাসীদের মধ্যে অন্যতম এই সুইডেন আসলাম। দীর্ঘ চেষ্টা ও নানা পরিকল্পনার পর ১৯৯৭ সালের ২৬ মে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী তাকে গ্রেপ্তার করে। সেই সময় তার বয়স ছিল ৩৫ বছর।

আসলাম ঢাকার নবাবগঞ্জ উপজেলার ছাতিয়ার এলাকার মৃত শেখ জিন্নাত আলীর ছেলে। পরিবারসহ তারা থাকতেন ঢাকার ইন্দিরা রোডে। তেজগাঁও পলিটেকনিক স্কুল (বর্তমানে তেজগাঁও সরকারি বিদ্যালয়) থেকে এসএসসি পাস করেন তিনি।

বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, ১৯৮৬-৮৭ সালের দিকে আসলামের উত্থান। শুরুতে রাজাবাজার ও ইন্দিরা রোড এলাকায় ছিল তার আধিপত্য। ১৯৮৭ সালে পূর্ব রাজাবাজারে নাজনীন স্কুলের ভেতরে মায়ের সামনে কিশোর শাকিলকে খুন করার অভিযোগে ব্যাপক আলোচনায় আসেন আসলাম।

সেই সময় কারওয়ান বাজার ও তৎসংলগ্ন এলাকার অপরাধ কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করত জাতীয় তরুণ পার্টির রানা গ্রুপ। সেই গ্রুপের একজন ক্যাডার ছিলেন পিচ্চি হান্নান। আধিপত্য বিস্তার নিয়ে ১৯৯০ সালের পর রানা গ্রুপের সঙ্গে সুইডেন আসলাম গ্রুপের দ্বন্দ্ব বাড়তে থাকে। সেই সময় রানার ক্যাডার বাহিনী বেশ শক্তিশালী ছিল। নিয়মিতই এই দুই গ্রুপের মধ্যে হামলা পাল্টা-হামলার ঘটনা ঘটত। তাদের হামলা পাল্টা-হামলার মধ্যে ককটেল বিস্ফোরণ ও গোলাগুলিতে অনেকেই হতাহত হয়েছিলেন।

এক পর্যায়ে ১৯৯৬ সালে রানা গ্রুপের অন্যতম ক্যাডার পিচ্চি হান্নানকে নিজদলে নেন আসলাম। পরে একই বছর হান্নানকে দিয়ে আসলাম কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউয়ের সুপারস্টার হোটেলের সামনে রানাকে খুন করেন বলে অভিযোগ ওঠে। এই ঘটনার পরই কারওয়ান বাজার, তেজতুরি বাজারসহ তেজগাঁও ও তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলসহ শেরেবাংলা নগর এলাকার নিয়ন্ত্রণ নেন আসলাম। এর মধ্যে আসলাম কারওয়ান বাজার, তেজতুরি বাজারের নিয়ন্ত্রণ দেন হান্নানের হাতে। ওইসব এলাকার নিয়ন্ত্রণ হান্নানের কাছে থাকলেও কার্যক্রম চলত আসলামের নামেই।

যুবলীগ নেতা গালিবকে হত্যার পর আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ১৯৯৭ সালের ২৬ মে গ্রেপ্তার হন সুইডেন আসলাম। সেই সময় তার কাছ থেকে বুলেট প্রুফ জ্যাকেটও উদ্ধার করা হয়। এরপর জেল থেকেই তিনি অপরাধ জগৎ নিয়ন্ত্রণ করতেন বলে জানা যায়। সেই কাজে মূল ভূমিকায় ছিল ঘনিষ্ঠ সহযোগী পিচ্চি হান্নান।

সূত্রে জানা যায়, কারওয়ান বাজার ও তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলীয় এলাকায় আড়ৎমালিক, গার্মেন্টস মালিক, জায়গা কেনা-বেঁচাসহ নানা কারণে ব্যবসায়ীসহ অনেকের কাছ থেকে আসলামের নামেই চাঁদা তুলতেন হান্নান কিংবা তার বাহিনী। জেলে বসেই সেই টাকার ভাগ পেতেন আসলাম। সেই সময় তার মাদক চোরাকারবার ছিল বলেও শোনা যায়। এ ছাড়া, কন্ট্রাক্ট কিলিং, অর্থের বিনিময়ে জমি দখলসহ নানা অপরাধমূলক কার্যক্রমের সঙ্গে সুইডেন আসলামের জড়িত থাকার তথ্যও শোনা যায়।

কারাগার সূত্রে জানা যায়, গ্রেপ্তারের পর জেল থেকেই হান্নানের মাধ্যমে অপরাধ কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করতেন আসলাম। জেলখানার ভেতরেও তিনি একাধিকবার মারামারি করে আলোচিত হন। কারাগারে তার সেল থেকে দুটি মোবাইল ফোনও উদ্ধার করা হয়। এসব ফোন দিয়ে তিনি কারাগারের বাইরে থাকা সহযোগীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। এমনকি যারা তার বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন, তাদেরসহ মামলার সাক্ষীদের হুমকিও দিতেন। এসব কারণে নানা সময়ে কয়েকবার তার কারাগার পরিবর্তনও করা হয়।

পরবর্তীতে ২০০০ সালের পর পিচ্চি হান্নানের নামও চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এরমধ্যে হান্নান নিজেই শক্তিশালী বাহিনী গড়ে তোলে। এরপর তিনি সুইডেন আসলামের নাম বাদ দিয়ে নিজের আধিপত্য বাড়াতে থাকেন। এক পর্যায়ে হান্নান নিজের নামে সব কার্যক্রম পরিচালনা করতে শুরু করেন।

নামের আগে 'সুইডেন' শব্দটি বসার কারণ হিসেবে জানা যায়, আসলামের প্রথম স্ত্রী ইতি ছিলেন সুইডেনপ্রবাসী। বিয়ের পর আসলামও সুইডেনে গিয়ে কয়েক বছর ছিলেন। সেই সূত্রে 'সুইডেন' শব্দটি তার নামের আগে জুড়ে যায়। একসময় ইতির সঙ্গে তার ছাড়াছাড়িও হয়ে যায়।

আসলামের ঘনিষ্ঠদের কেউ কেউ এমনও বলেন যে, চাইলে ২০১০ সালের পর তিনি কারাগার থেকে বের হতে পারতেন। কিন্তু 'ক্রসফায়ারের' ভয়ে তিনি সেভাবে জামিনের চেষ্টাও করেননি।

বিভিন্ন সময়ে সুইডেন আসলামের নামে ২২টি মামলা হয়েছে, যার মধ্যে নয়টিই হত্যা মামলা বলে জানা গেছে। অস্ত্র মামলায় ১৭ বছরসহ কয়েকটি মামলায় সাজাও হয়েছিল তার।

দীর্ঘ ২৭ বছর পর কারাগার থেকে জামিনে মুক্তি পেয়েছেন শীর্ষ সন্ত্রাসী শেখ মোহাম্মদ আসলাম ওরফে সুইডেন আসলাম। গতকাল মঙ্গলবার রাত ৯টার দিকে তিনি গাজীপুরের কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে বের হন।

২৭ বছর পর মুক্তি পাওয়া শীর্ষ এই সন্ত্রাসীর বয়স এখন ৬২ বছর।

Comments

The Daily Star  | English

‘Shockingly insufficient’

"The proposed decision to allocate USD 250 billion per year for all developing countries is shockingly insufficient," said the adviser

2h ago