কীভাবে এতটা নৈতিক অবক্ষয়ে নিমজ্জিত হলাম আমরা?

ইলাস্ট্রেশন: বিপ্লব চক্রবর্তী

গুমবিরোধী আন্তর্জাতিক সনদে যুক্ত হওয়ায় আমরা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সরকারকে অভিনন্দন জানাই। একইসঙ্গে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও গুমের ঘটনার তদন্তে গত মঙ্গলবার গঠিত কমিশনকেও অভিনন্দন জানাই। পাঁচ সদস্যের এই কমিশন ৪৫ দিনের মধ্যে তদন্ত প্রক্রিয়া শেষ করে প্রতিবেদন জমা দেবে। হাইকোর্টের একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির নেতৃত্বাধীন এই কমিশন পুলিশ, র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব), বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি), পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), বিশেষ শাখা (এসবি), জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা (এনএসআই) ও সামরিক বাহিনীর প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরের (ডিজিএফআই) কার্যক্রম নিয়ে তদন্ত পরিচালনা করবে। এসব গোয়েন্দা সংস্থা রাষ্ট্র, সরকার বা সমাজের সুরক্ষা দেওয়ার বদলে ভিন্নমত দমন, বিরোধীদের নির্মূল ও স্বাধীন গণমাধ্যমের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার সরকারি নীতি বাস্তবায়নের হাতিয়ারে পরিণত হয়েছিল।

অন্তর্বর্তী সরকার যতগুলো উদ্যোগ নিতে পারত, তার মধ্যে এটি সবচেয়ে জরুরি, গুরুত্বপূর্ণ ও জনবান্ধব উদ্যোগের একটি। এই উদ্যোগের জন্য আমরা সংশ্লিষ্ট উপদেষ্টা বা উপদেষ্টাদের অভিনন্দন জানাই। গণমাধ্যম, বিশেষত এই পত্রিকার পক্ষ থেকে আমরা কমিশনের অশেষ সাফল্য কামনা করছি। শুধু ভুক্তভোগীদের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করলেই হবে না। ভবিষ্যতে যাতে এ ধরনের ঘটনা আর না ঘটে, সেটাও নিশ্চিত করতে হবে।

পরের কাজটির সঙ্গে আমাদের সংশ্লিষ্টতা বেশি। ক্ষমতাসীন দলের আধিপত্য বৃদ্ধি, বিশেষত, বিরোধীদলকে নির্মূলের কাজে নিরাপত্তা বাহিনীকে ব্যবহারের এই চর্চা দুর্ভাগ্যজনকভাবে আওয়ামী লীগ শুরু করেনি। গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বহুল ব্যবহারের এই চর্চা শেখ হাসিনার শাসনামলে চরম পর্যায়ে পৌঁছালেও এর সূত্রপাত হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড ও সক্রিয় রাজনীতিতে সশস্ত্র বাহিনীর প্রবেশের মাধ্যমে। আমরা নিশ্চিতভাবে জানি, সত্তরের দশকের শেষের দিকে যখন রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপিকে গঠন করা হচ্ছিল, তখন রাজনীতিবিদ ও নাগরিক সমাজের সদস্যদের এই দলে যোগ দিতে বাধ্য করার জন্য একাধিক নিরাপত্তা বাহিনীকে নিয়োজিত করা হয়েছিল। পরবর্তীতে জেনারেল এরশাদের এক দশকের শাসনামলেও এই ধারাবাহিকতা অটুট ছিল। সেই সময় তিনি নিজেও এসব বাহিনী তার নিজের দল গঠনে ও বিরোধীদের নিয়ন্ত্রণে কাজে লাগান। আমরা সবাই আশা করেছিলাম যে ১৯৯১ সালে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও প্রতিনিধিত্বমূলক সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের মাধ্যমে এই অন্যায়ের অবসান ঘটবে।

দুর্ভাগ্যজনকভাবে পরবর্তীতে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ, নির্বাচিত এই দুই দলের সরকারের আমলেও এই চর্চা অব্যাহত থাকে এবং এর সবচেয়ে ন্যক্কারজনক অধ্যায়টি রচিত হয় ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টার মাধ্যমে। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে এই হামলার সঙ্গে নিরাপত্তা বাহিনী ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল। আওয়ামী লীগের নারী শাখার প্রধানসহ মোট ২৩ জন নিহত হন এই ঘটনায়।

অর্থাৎ, ১৯৯১ সাল থেকে শুরু করে গত তিন দশকে যখনই আমরা পর্দার আড়ালের কারসাজির বদলে স্বচ্ছ, নাগরিক-কেন্দ্রিক রাজনীতি প্রতিষ্ঠা হবে বলে আশা করেছি, তখনই নিরাপত্তা বাহিনীর হস্তক্ষেপ বেড়েছে এবং ক্ষমতাসীন সরকারগুলো জনগণের আস্থা হারিয়েছে। কীভাবে আওয়ামী লীগের মতো একটি ঐতিহ্যবাহী, জনপ্রিয় ও সুসংহত রাজনৈতিক দল ধারাবাহিকভাবে নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর বৃহৎ পরিসরে নির্ভরশীল হয়ে পড়তে পারে, তার একটি উজ্জ্বল উদাহরণ হলো শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসনামল। এই নির্ভরতার মধ্যে ছিল তাদেরকে দলের অভ্যন্তরীণ কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা, যার একটি উদাহরণ ছিল দলের প্রায় প্রতিটি পর্যায়ের নেতাদের মনোনয়নে তাদের অনুমোদন নেওয়া। বিষয়টি এতটাই প্রকট হয়ে পড়েছিল যে, ইউনিয়ন ও জেলা পর্যায়ের উদীয়মান নেতাদেরকেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর 'আশীর্বাদ' নিয়ে তাদের লক্ষ্যে পৌঁছাতে হতো।

শেখ হাসিনার পতনের পেছনে অনেকগুলো কারণ আছে। তবে ২০১০ সালের পর থেকে সবচেয়ে হৃদয়বিদারক ঘটনা ছিল মানুষকে তাদের বাসা কিংবা রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে মাসের পর মাস, এমনকি বছরের পর বছরও গুম করে রাখা এবং পরিবারসহ কাউকেই এ বিষয়ে কোনো তথ্য জানানোর সামান্যতম প্রয়োজনও বোধ না করা। কখনো সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত কোনো জায়গায় সেসব ব্যক্তির মরদেহ খুঁজে পাওয়া যেত। কখনো কখনো তারা বাড়ি ফিরে আসতেন, কিন্তু ভবিষ্যৎ পরিণামের কথা ভেবে নিশ্চুপ থাকতেন। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তারা কয়েক সপ্তাহ, মাস বা বছরের জন্য নিখোঁজ থাকতেন কিংবা কখনোই ফিরে আসতেন না।

তাদের আপনজনের দুর্বিষহ অবস্থার কথা ভাবুন। মৃত্যু, তা যত নির্দয়ই হোক না কেন, সেটি একটি মর্মান্তিক সমাপ্তির বার্তা দেয়। কিন্তু গুমের ঘটনায় পরিবারটি আশা-নিরাশার দোলাচলে থাকে। ভাবে, হঠাৎ একদিন দরজা খুলে দেখবে তাদের আপনজন ফিরে এসেছে, যিনি হয়তো কারো বাবা, স্বামী, সন্তান কিংবা বন্ধু। প্রতিবার কেউ দরজায় কড়া নাড়লেই এক চিলতে আশা জেগে ওঠে, আবার পর মুহূর্তেই সেই আশা দপ করে নিভে যেয়ে চরম হতাশার সৃষ্টি হয়। কল্পনা করুন, বছরের পর বছর এ ঘটনা ঘটেই গেছে।

স্বাধীনতার বিষয়টি এক পাশে সরিয়ে রেখে যদি বলি, একটি আধুনিক রাষ্ট্রের প্রাথমিক দায়িত্বের মধ্যে একটি হলো জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। বাংলাদেশে শেখ হাসিনার সরকারের আমলে এই নিশ্চয়তা দেওয়া হয়নি। বিশেষত, ২০১০ সালের পর থেকে। নানা ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে থেকেও মানবাধিকার সংগঠন অধিকার বিগত বছরগুলোয় গুমের ঘটনাগুলো বেশ ভালো করে যাচাই ও নথিবদ্ধ করে রেখেছে। অধিকারের প্রধানকে জেলেও যেতে হয়েছিল, ঘটনাচক্রে যিনি এখন ড. ইউনূসের সরকারের উপদেষ্টাদের একজন। সংস্থাটির মতে, ২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত মোট ৭০৮ ব্যক্তিকে গুম করা হয়। তাদের মধ্যে ৫৭ শতাংশ বেঁচে ফিরেছেন। ১৩ শতাংশকে মৃত অবস্থায় খুঁজে পাওয়া গেছে এবং বাকি ৩০ শতাংশের ব্যাপারে কিছুই জানা যায়নি। বাড়ি বা রাস্তা থেকে 'তুলে নেওয়ার' ঘটনার ৩১ শতাংশ র‍্যাব, ৩০ শতাংশ ডিবি, ২২ শতাংশ ডিজিএফআই (বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সঙ্গে র‍্যাব থাকত) এবং ১৪ শতাংশ পুলিশ ঘটিয়েছে।

২০২২ সালের ৩০ আগস্ট প্রকাশিত ডেইলি স্টারের সাংবাদিক জায়মা ইসলামের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০০৯ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে অন্তত ৫২২ জনকে গুম করা হয়। যারা বেঁচে ফিরে এসেছেন, তাদের বেশিরভাগই আবারও সেই নারকীয় যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় কখনোই আর মুখ খোলেননি। তবে যে অল্প কয়েকজন কথা বলেছেন, তাদের ক্ষেত্রে সেই আশঙ্কাজনক পরিণতিই হয়েছে। ভুক্তভোগীদের একজন বলেন, 'জিজ্ঞাসাবাদের সময় তারা আমার দুই কানের লতির সঙ্গে ব্যাটারির ক্লিপ লাগিয়ে সুইচ চালিয়ে দেয়। ইলেকট্রিক শকে আমার কানের পর্দা ক্ষতিগ্রস্ত হয়'। আরেকজন জানান, তাকে আটকে রাখার সময় তার হাতগুলো দেহের পেছনে নিয়ে হাতকড়া পরিয়ে রাখা হয়। দুই মাস থেকে শুরু করে আড়াই বছর পর্যন্ত এ ধরনের নির্যাতন চলেছে। তাদেরকে একটি আড়াই ফুট চওড়া, চার ফুট লম্বা ও পাঁচ ফুট উঁচু কক্ষে আটকে রাখা হতো। কক্ষটি এতই ছোট ছিল যে ভালো করে বসা বা দাঁড়ানোও যেত না। এ ধরনের নিষ্ঠুরতা মধ্যযুগীয় বর্বরতার কথা মনে করিয়ে দেয়। মাটির নিচে, অন্ধকার ও জানালাবিহীন কক্ষে আটকে রেখেও সারাক্ষণ তাদের চোখ বেঁধে রাখা হতো। কেবল মৌলিক চাহিদা পূরণ বা গোসলের সময় তাদের চোখ খোলা হতো।

সম্প্রতি আমরা 'আয়নাঘরের' যেসব গল্প জানতে পেরেছি, তা এক ভিন্ন মাত্রার নির্যাতন ও নির্মমতার চিত্র উন্মোচন করেছে। এসব ঘটনা মোটা দাগে মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং এতে কিছু গোপন কারাগারের অস্তিত্ব সম্পর্কে সবাই জানতে পেরেছেন, যা পুরোপুরি নজরদারিবিহীন এবং কোনো ধরনের আইনি প্রক্রিয়ার অংশ নয়। এগুলো পরিচালিত হয়েছে সেখানে দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের মর্জি বা সম্পূর্ণ তাদের স্বেচ্ছাচারিতা অনুযায়ী। একজন অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীকে এ ধরনের গোপন কারাগারে আট বছর আটকে রাখা হয়েছিল এবং সরকারের পতন না হলে তারা সম্ভবত সেখানেই আটকে থাকতেন। আটকাবস্থায় পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী নেতা মাইকেল চাকমা টানা পাঁচ বছর (২০১৯-২০২৪ সাল) সূর্যের আলো দেখেননি।

গুম হওয়া ব্যক্তিদের সন্ধানে গঠিত কমিশন ৪৫ দিনের মধ্যে তাদের প্রতিবেদন প্রকাশের জন্য কাজ করবে। ডিজিএফআই যে ২৩টি কারাগারকে গুম হওয়া ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্য ও মানবাধিকারকর্মীদের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়ার কথা বলেছে, তা তাৎক্ষণিকভাবে বাস্তবায়ন করা উচিত। যাদেরকে অবৈধ ও নিষ্ঠুরভাবে আটকে রাখা হয়েছে, তাদের সবাইকে শিগগির পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া উচিত।

আমরা যেন আর কখনোই এ ধরনের নিষ্ঠুর ও অমানবিকতায় নিমজ্জিত না হই, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের মাধ্যমে পাওয়া স্বপ্নকে ভূলুণ্ঠিত করে। চিরদিনের জন্য এই চর্চাকে নিশ্চিহ্ন করতে হবে। জঙ্গিবাদ দমনের নামে নিরাপত্তা সংস্থাগুলোকে মাত্রাতিরিক্ত ক্ষমতা ও স্বেচ্ছাচারিতার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। আমরা আশা করব কমিশন একটি স্পষ্ট আইনি কাঠামো গঠন করবে, যাতে গত ১৫ বছরে মানুষকে যেরকম দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে, তার পুনরাবৃত্তি আর কখনো না হয়।

মাহফুজ আনাম: সম্পাদক ও প্রকাশক, দ্য ডেইলি স্টার

ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান

Comments

The Daily Star  | English

Enforced disappearances: Eight secret detention centres discovered

The commission raised concerns about "attempts to destroy evidence" linked to these secret cells

1h ago