গাজী টায়ারস: মাইকে ঘোষণা দিয়ে লোক জড়ো করে লুটপাট-আগুন, নিখোঁজ অন্তত ১৭৪
ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের পূর্বপাশে বিশাল জায়গাজুড়ে দেশের বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠী গাজী গ্রুপের গাড়ির টায়ার প্রস্তুতকারী কারখানা 'গাজী টায়ারস'র অবস্থান৷ কারখানাটির মালিক আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী৷ রোববার ভোররাতে রাজধানীর শান্তিনগর এলাকার একটি বাসা থেকে গ্রেপ্তার হন আওয়ামী লীগের এ নেতা৷
গ্রেপ্তারের খবর তার নির্বাচনী এলাকা নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলায় ছড়িয়ে পড়লে সকাল থেকেই সেখানে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়৷ দুপুরের দিকে টায়ার প্রস্তুতকারী কারখানাটির অদূরে একটি মসজিদ থেকে মাইকে ঘোষণা দিয়ে লোক জড়ো করা হয়। এ ঘোষণার পর কয়েকশ মানুষ জড়ো হন কারখানাটির সামনে, শুরু হয় লুটপাট৷ দিনভর লুটপাটের পর রাত ৯টার দিকে কারখানাটির ভেতরের একটি ছয়তলা ভবনে আগুন দেয় লুটপাটকারীদের একটি দল৷
সোমবার সারাদিনে প্রত্যক্ষদর্শী, স্থানীয় বাসিন্দা, কারখানা কর্তৃপক্ষ ও প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে৷
রোববার রাতে দেওয়া আগুন জ্বলেছে প্রায় ২৪ ঘণ্টা। এ ঘটনায় অন্তত ১৭৪ জন নিখোঁজ রয়েছেন বলে দাবি করেছেন তাদের স্বজনরা৷
নিখোঁজদের মধ্যে কয়েকজন নারীর নামও পাওয়া গেছে৷ তাদের প্রাথমিক একটি তালিকাও করেছে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা৷
তবে, নিখোঁজদের কেউ কারখানাটির কর্মী নন। সকলেই আশেপাশের বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দা৷ তারা লুটপাটের সময় ভবনটির ভেতরে ছিলেন, কিন্তু আগুন লাগার পর বের হতে পারেননি বলে দাবি স্বজনদের৷
ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল রেজাউল করিম সোমবার সাংবাদিকদের জানান, সন্ধ্যা ৭টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে এসেছে৷ তবে, এখনও নেভানো সম্ভব হয়নি৷ আগুন নেভাতে তাদের কার্যক্রম চলমান রয়েছে৷
সোমবার রাত ১১টার দিকেও ভবনটিতে আগুন জ্বলতে দেখা গেছে৷
মাইকে ঘোষণা দিয়ে লুটপাট
'বীর প্রতীক' খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা গোলাম দস্তগীর গাজী রূপগঞ্জ উপজেলা নিয়ে গঠিত নারায়ণগঞ্জ-১ আসন থেকে টানা চারবারের নির্বাচিত সংসদ সদস্য৷ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতিও তিনি৷ ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন৷ রূপগঞ্জে তার একাধিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে৷
গত ৫ আগস্ট গণঅভ্যূত্থানের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর উপজেলার রূপসী এলাকার 'গাজী টায়ারস' এবং কর্নগোপের 'গাজী পাইপস' নামে দুটি কারখানায় লুটপাট ও ভাঙচুর চালানো হয়৷ লুটপাটের পর আগুন দেওয়া হয় দুটি প্রতিষ্ঠানেই৷
রোববার গাজীর গ্রেপ্তার হলে রূপসীর কারখানাটিতে দ্বিতীয় দফায় লুটপাট চলে৷
বিষয়টি নিয়ে কারখানাটির আশেপাশের অন্তত ১৫ জনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ৫০ একরেরও বেশি জায়গাজুড়ে 'গাজী টায়ারস' কারখানাটির কিছু জমি নিয়ে স্থানীয়দের সঙ্গে গাজী গ্রুপের দ্বন্দ্ব রয়েছে৷ গাজীকে গ্রেপ্তারের পর রোববার দুপুরে জমি ফেরত পেতে এসব জমির মালিকরা একত্র হয়ে প্রতিবাদ সমাবেশের প্রস্তুতি নেয়৷ এ জন্য স্থানীয় একটি মসজিদের মাইক থেকেও ঘোষণা দিয়ে সকলকে জড়ো হওয়ার জন্য আহ্বান জানানো হয়৷ এরপর বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজন জড়ো হলে কারখানাটিতে লুটপাট শুরু হয়৷
খাদুন উত্তরপাড়া (খাঁ পাড়া) জামে মসজিদের ইমাম লুৎফর রহমান বলেন, যোহরের নামাজের আগে মসজিদের মাইক থেকে ঘোষণা দিয়ে একদল লোক গাজী গ্রুপের দখলে থাকা 'জমির মালিকদের' জড়ো হতে আহ্বান জানান৷ তাদের সবাইকে রূপসী মোড়ে জড়ো হতে বলা হয়৷
তিনি বলেন, 'মাইকে তখন বলা হয়, তারা গাজী গ্রুপের বিরুদ্ধে মানববন্ধন করবেন কিন্তু কেউ যেন আগের মতো (৫ আগস্টের ঘটনা) লুটপাট না করেন।'
স্থানীয় এক চায়ের দোকানদার নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, 'মসজিদের মাইকে এ ঘোষণার পর কারখানাটির সামনে কয়েকশ লোক জড়ো হলে তারা কারখানাটির ভেতরে ঢুকে লুটপাট শুরু করে৷ সময় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে লুটপাটকারীর সংখ্যাও বাড়তে থাকে।'
'যে যা পেরেছে লুট করেছে৷ কেউ মাথায় করে, কেউ গাড়ি করে নিয়ে গেছে৷ কারো হাতে টিন দেখেছি, কারো হাতে এসি। সরকার যেদিন পড়েছে সেইদিনের মতোই। সারাদিন কোনো পুলিশ দেখিনি। পুলিশ থাকলে কী এসব হয়?,' বলেন তিনি।
লুটপাটের সময় কারখানাটির ভেতরে ছিলেন এবং লুটপাটে অংশ নিয়েছেন এমন কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলেছে এ প্রতিবেদক৷ তবে তাদেরও কেউই নিজেদের পরিচয় প্রকাশে রাজি হননি।
তাদের ভাষ্য, আশেপাশের বিভিন্ন এলাকার হাজারো মানুষ লুটপাটে অংশ নিয়েছে৷ বিকেলের দিকে একদল যুবক ধারালো অস্ত্র ও লাঠিসোটা হাতে কারখানার ভেতর ঢোকেন৷ তারা কারখানাটির নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার চেষ্টা করেন৷ এ নিয়ে লুটপাটে লিপ্ত থাকা আরেকটি দলের সঙ্গে তর্কবিতর্ক হয়, যা পরে হাতাহাতিতেও রূপ হয়৷ পরে অস্ত্রধারী দলটি পিছু হটে৷
এ ঘটনার কয়েকঘণ্টা পর রাত ৯টার দিকে কারখানাটির ছয়তলা একটি ভবনের নিচতলায় আগুন ধরিয়ে দেয় লুটপাটকারীদের একটি দল৷ এ ভবনটিতে তৈরি টায়ার, টায়ার তৈরির কাঁচামাল ছিল৷ এসব কাচামাল সহজে দাহ্য হওয়ায় মুহুর্তেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে পুরো ভবনজুড়ে৷
নিচে আগুন জ্বলছে টের পাননি ভবনের উপরে থাকা লোকজন
আগুন দেওয়ার আগে সন্ধ্যায় কারখানাটিতে যখন লুটপাট চলছিল তখন চার বন্ধুর সঙ্গে সেখানে গিয়েছিলেন পোশাক কারখানার কর্মী ৩০ বছর বয়সী জনি মিয়া৷ জনি ও তার তিন বন্ধু এখন নিখোঁজের তালিকায়৷
রাত ১০টার দিকে জনির খোঁজ করতে আসা তার স্বজনদের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের৷ তারা জানান, তারা পাঁচ বন্ধু আগুন দেওয়ার সময় ভবনটির ভেতরে ছিলেন৷ একজন ছিলেন কারখানার নিচের অংশে৷ উপরে থাকা বন্ধুরা তখনও জানতেন না যে ভবনটিতে আগুন দেওয়া হয়েছে৷
জনির ছোট বোন মনি আক্তার জনির বেঁচে ফেরা বন্ধুর বরাতে বলেন, 'কারখানার ভেতরে তখন ঘুটঘুটে অন্ধকার৷ ভাইয়ারা চার বন্ধু ছিলেন উপরে৷ নিচে আগুন দিলে এক বন্ধু তাদের মোবাইলে ফোন করে আগুনের কথা জানিয়ে বেরিয়ে আসতে বলেন। কিন্তু আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়লে তারা আর বের হতে পারেননি৷ কিছুক্ষণ পরই ভাইয়ার নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়৷'
তিনি বলেন, 'রোববার সারারাত আমরা ভাইয়ার খোঁজ করেছি, পাইনি৷ বাকি তিন বন্ধুও নিখোঁজ৷ তারা বুঝতেই পারেননি আগুন এত ভয়াবহ৷ আমরা ভাইয়ার লাশটা পাবো কিনা তাও এখন সন্দেহ।'
ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরাও জানিয়েছেন, কারখানাটির ভেতরে টায়ার তৈরির রাবার ও প্ল্যাস্টিক জাতীয় সহজে দাহ্য বস্তু থাকায় আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে ভয়াবহ আকার ধারণ করে৷
লুটপাট থেকে আগুন দেওয়া পর্যন্ত প্রশাসনের সহযোগিতা পাননি দাবি কারখানা কর্তৃপক্ষের
সোমবার সকালে মুঠোফোনে গাজী টায়ারস কারখানার সহকারী মহাব্যবস্থাপক সাইফুল ইসলাম বলেন, 'দুটি গ্রুপে কয়েকশ লোক রূপসীর কারখানায় ঢুকে পড়ে৷ আমাদের কর্মীদের সক্ষমতা অনুযায়ী তাদের বাধা দেওয়ার মতো পরিস্থিতি ছিল না৷ দিনভর লুটপাটের পর রাত ৯টার দিকে কারখানাটির একাধিক ভবনে আগুন লাগিয়ে দেয়৷ আগুন দেওয়ার পর ফায়ার সার্ভিসের কয়েকটি ইউনিট এলেও তারা আগুন নেভাতে পারেননি৷'
হামলার ঘটনার পর পুলিশে ফোন দিয়েও সহযোগিতা পাননি বলে অভিযোগ করেন তিনি৷
সাইফুল বলেন, 'থানা পুলিশসহ প্রশাসনিক বিভিন্নজনকে ফোন দিলে সেনাবাহিনীর একটি টিম আসে গেটের সামনে৷ কিন্তু ১০ মিনিটের বেশি তারা দাঁড়াননি৷ পরে আগুন দেওয়ার পর ফায়ার সার্ভিস ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আসে৷'
'ছয়তলা একটি ভবনের নিচে যখন আগুন দেওয়া হয় তখন লুটপাটকারীদের কয়েকজন ভবনটির উপরে ছিলেন৷ কয়েকজন দাবি করছেন, তাদের স্বজনরা ভবনে আটকা পড়েছেন', যোগ করেন গাজী গ্রুপের এই কর্মকর্তা৷
তবে পুলিশের পক্ষ থেকে এই অভিযোগ অস্বীকার করা হয়েছে। নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ-আড়াইহাজার সার্কেলের ('সি' সার্কেল) সহকারী পুলিশ সুপার হাবিবুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, 'পুলিশ কোনো অবহেলা করেনি। আমরা কারখানার নিরাপত্তা দেওয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি।'
রাতভর লাশের অপেক্ষা স্বজনরা
সোমবার সকাল থেকে কারখানাটির ভেতরে নিখোঁজ ব্যক্তিদের স্বজনদের ছোটাছুটি করতে দেখা যায়৷ অনেকের হাতে নিখোঁজ ব্যক্তিদের ছবি ও জাতীয় পরিচয়পত্রও ছিল৷ দিনভর নিখোঁজ সদস্যদের খবর না পেয়ে রাতেও অপেক্ষা শেষ হয়নি তাদের৷
রাত ১০টার দিকে কারখানাটির প্রধান ফটকের সামনে বসে ছিলেন মধ্যবয়সী আয়েশা বেগম৷ তার ছেলের স্ত্রী রোমানা রোববার রাতে কারখানাটিতে এসেছিলেন৷ তখন থেকে তার কোনো খোঁজ মিলছে না৷
স্বামী ও সন্তান নিয়ে রূপসীর মীরবাড়ি এলাকায় থাকতেন রোমানা৷
আয়েশা বলেন, 'এলাকার সবাই যাইতেছে, তা দেইখা রাতে গাজীর ফ্যাক্টরিতে আইছিল রোমানা৷ আগুন লাগার পর থেইকা খোঁজ নাই৷ কাইল (রোববার) নাতিডারে লইয়া সারারাত এইখানে বইসা ছিলাম৷'
রোমানার দুটি শিশু সন্তান রয়েছে। একজনের বয়স আট মাস জানিয়ে তার শাশুড়ি বলেন, 'আইজ সারাদিনই এইহানে৷ জীবিত পাওনের আশা নাই৷ তারপরও আল্লার কাছে কই, শিশু বাচ্চাটার লাইগাও তার মারে যে বাচাইয়া রাখে৷'
Comments