বিদায় আমাদের কালের নায়ক প্রকৌশলী শেখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ
আমাদের কালের নায়ক, স্বপ্ন দেখা অজেয় তারুণ্যের পৃষ্ঠপোষক-সমর্থক-সতীর্থ এক কিংবদন্তি, মেধাবী প্রকৌশলী, পরার্থপর সামাজিক সংগঠক, প্রগতিশীল বৈষম্যহীন সমাজের জন্য আমৃত্যু কাজ করে যাওয়া, তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক প্রকৌশলী শেখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ মৃত্যুবরণ করেছেন। তার আত্মার মঙ্গল কামনা করি।
দেশে নতুন সরকার দায়িত্ব নিয়েছে। গণহত্যাকারী, নিপীড়ক ফ্যাসিস্ট শাসনের ইতি ঘটেছে আপাতত। রক্তপিপাসু এই শাসকের অস্ত্রনির্ভর শাসনের কারণে গত একমাসে নির্ঘুম রাত কেটেছে অন্য অনেকের মতো আমারও। আজকের এই সকালটিতে তাই কিছুটা নির্ভার হয়ে একটা প্রান্তিক জেলাশহরে প্রাতঃভ্রমণ করছিলাম। হাঁটতে হাঁটতেই খবর পেলাম, শহীদুল্লাহ ভাই আর নেই।
বহুজনকে ফোনে চেষ্টা করে অবশেষে জানলাম, সত্যি সত্যিই শহীদুল্লাহ ভাইয়ের জীবনাবসান ঘটেছে। আমাদের জীবনে দেখা শ্রেষ্ঠতম জনবাদি মানুষ, সকল বৈষম্য বিলোপের কাজে আজীবন নিবেদিত এক সংগঠক প্রকৌশলী শেখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ মৃত্যুবরণ করেছেন দেশের বাইরে অবস্থানরত নিজ সন্তানের কাছেই—গত ৯ আগস্ট।
বয়স হয়েছিল তার। শারীরিকভাবে সক্রিয়ও ছিলেন না খুব একটা। আমাদের যোগাযোগও ক্ষীণ হয়েছে নানা কারণেই। তবুও ঘণ্টার পর ঘণ্টা শহীদুল্লাহ ভাইয়ের ইন্টারভিউ নেওয়া, তার জীবনকথা শোনার অভিজ্ঞতার স্মৃতি ভেসে উঠলো নতুন করে।
প্রতি বছর জুলাইয়ের ৩১ তারিখে জন্মদিনে তাকে নিয়ে নিয়মিত লিখেছি গভীরতর ভালোবাসায়। এবারের জুলাইয়েও তাকে নিয়ে লিখতে চেয়েছি। কিন্তু ফ্যাসিস্ট শাসনের বিরুদ্ধে জনমানুষের প্রতিরোধের কঠিনতম দিনগুলোতে যে উৎকণ্ঠা, আর অনিশ্চয়তা ভর করেছিল, তাতে সেই লেখা আর হয়ে ওঠেনি। কিন্তু আজ তার মৃত্যুসংবাদ আমাকে বেদনাবিমূঢ় করে দিলো। আর সাক্ষাতে তার কথা শোনার বিরল সুযোগ হবে না। আর পাওয়া যাবে না হঠাৎ হঠাৎ তার ফোন…।
২.
তার সামাজিক আন্দোলন, পেশাগত জীবন, ব্যক্তিজীবনকে কিছুটা হলেও জানার সুযোগ হয়েছিল। সে এক অনন্যসাধারণ ও ব্যতিক্রমী অভিজ্ঞতা। অসাধারণ নরম হৃদয়ের ঠোঁটকাটা শহীদুল্লাহ ভাই আমাদের গড়পড়তা বাঙালির দোদুল্যমান চরিত্রের বাইরে এক দৃঢ়চেতা, ইস্পাতসম মানুষ ছিলেন। ছিলেন প্রগতিশীল, মার্কসবাদী চিন্তাধারার মানুষ কিন্তু ধর্ম সম্পর্কে ছিল অগাধ জ্ঞান ও নির্মোহ ব্যাখ্যার ক্ষমতা। খুব বাস্তববাদী ছিলেন। নিজের মেধার ক্ষমতার ব্যাপারে থাকতেন খুবই আস্থাশীল।
খুলনার দৌলতপুরে ১৯৩১ সালের ৩১ জুলাই তার জন্ম। বাবার নাম শেখ মুহাম্মদ হানিফ। বাবা দৌলতপুর মুহসীন উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন। মায়ের নাম মরিয়ম খাতুন। ছয় ভাই এক বোন। দৌলতপুর মুহসীন উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৪৬ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় আরবিতে লেটারসহ প্রথম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হন।
১৯৪৮ সালে তৎকালীন ব্রজলাল একাডেমী (পরে যার নাম হয় বিএল কলেজ) থেকে ইন্টারমিডিয়েট (সায়েন্স) পরীক্ষায় পূর্ব পাকিস্তান বোর্ডে সম্মিলিত মেধা তালিকায় ১৯তম স্থান অধিকার করেন। ১৯৫০ সালে একই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ডিস্টিংশনসহ বিএসসি পাস কোর্সে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তান বোর্ডের মধ্যে দ্বিতীয় স্থান লাভ করেন। ওই একই বছর ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম হয়ে আহসান উল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি হন। ১৯৫৪ সালে আহসান উল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ (বর্তমান বুয়েট) থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ৭৯ শতাংশ নম্বর পেয়ে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে গোল্ড মেডেলিস্ট হিসেবে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন।
৩.
খুবই সাধারণ বেশভূষায় ব্যক্তিজীবনে পরিমিত জীবনাচারে অভ্যস্ত মাঠের মানুষ শেখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ জনকল্যাণে নিবেদিত ছিলেন আমৃত্যু। দেশের তেল-গ্যাস-খনিজসম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষার আন্দোলনের ছিলেন পথিকৃৎ। শেখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ সমাজ বদলের লড়াইরত তরুণ সমাজের একটা বড় অংশের কাছে প্রেরণা আর ভালোবাসাময় শ্রদ্ধার 'শহীদুল্লাহ ভাই' হয়ে থেকেছেন সবসময়।
একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম, নানারকম সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন এবং ব্যক্তিকে প্রকাশ্য ও গোপনে আপনি বহু বছর ধরে আর্থিক সহায়তা দিয়ে এলেন। এ ক্ষেত্রে আপনার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা কী? ফলাফল কী?
শহীদুল্লাহ ভাইয়ের সহাস্য উত্তর, 'খুব সুন্দর অভিজ্ঞতা। এটা খুব কাজে দিয়েছে। আমি একা যে কাজটা করতে পারতাম না, এখন সবাই মিলে তা করি। এই কাজটা সবাই মিলে করাটা খুব দরকার। একজনের কাজে তো হবে না। সেজন্য এই প্রচেষ্টাটা খুবই কাজে লেগেছে। আমার যেটুকু অর্থ ব্যয়, যেটুকু শ্রমব্যয়, এগুলো যত বেশি মানুষের ভেতরে শেয়ার করতে পারি ততই মঙ্গল। একা কতটুকু করা যায়। একা কিছুই করা যায় না। সেজন্য এটা একটা শেয়ারড এক্সপেরিয়েন্স। সবাই যেন মঙ্গলটা পায়। আমার ব্যর্থতা হচ্ছে, আরও বেশি পারলাম না কেন?'
আমার কৌতূহল বাড়ল। প্রশ্নটা করেই ফেললাম, যেসব জায়গায় এভাবে সহায়তা করেছেন তা ব্যর্থ হয়নি কোথাও?
এবার শেখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর আত্মবিশ্বাসী উত্তর, 'এটা ফেইল করার জিনিস না। এটা তো এমন না যে কাউকে বিশ্বাস করে কিছু টাকা দিলাম, সে আর ফেরত দিল না, এরকম ব্যাপার তো না। জনগণকে বিশ্বাস করা, এই বিনিয়োগ কোনো দিন ফেইল করে না। মানুষের মঙ্গলের জন্য বিনিয়োগ কোনো দিন ফেইল করে না। মানুষের কল্যাণের জন্য যেকোনো প্রচেষ্টার সঙ্গে থেকে, তাকে সাহায্য করা কোনো দিন ফেইল করতে পারে না। এই ইনভেস্টমেন্ট কোনো দিন ফেইল করতে পারে না।'
৪.
আজকের প্রজন্ম হয়তো সেভাবে তাকে চেনেন না। কিন্তু শহীদুল্লাহ ভাই জীবনভর তরুণদের সঙ্গে থেকেছেন গভীরভাবে। তরুণরা যখন যেখানেই জনকল্যাণে কাজ করেছে, সেখানেই স্বেচ্ছায়-স্বপ্রণোদিত হয়ে তিনি জড়িয়েছেন তাদের সঙ্গে নানা সহায়তা হাতে নিয়ে।
শেখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর শিক্ষাজীবন দারিদ্র্য, সংগ্রাম আর কষ্টের মধ্যে কাটলেও সকল প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন আজীবন লড়াকু এক মানুষ। মেধাবী শেখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে গোল্ড মেডেলিস্ট হওয়া স্বত্বেও আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের (আজকের বুয়েট) তৎকালীন প্রিন্সিপাল ড. এমএ রশীদের অনাগ্রহে সেখানে লেকচারার হিসেবে যোগদান করতে পারেননি।
এরপর তার পেশাগত জীবন শুরু হয় পূর্বপাকিস্তান ইরিগেশন ডিপার্টমেন্ট, জিকে প্রজেক্টের ডিজাইন অফিসে ডিজাইন ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে। পরে কর্ণফুলী হাইড্রো ইলেকট্রিক প্রজেক্টে চাকরিতে যোগদান করেন। পরবর্তীতে নানা জায়গায় কাজ করার পর খ্যাতিমান স্থপতি মাযহারুল ইসলামের সঙ্গে পার্টনারশিপে 'বাস্তুকলাবিদ' নামে পরামর্শক ফার্ম প্রতিষ্ঠা করেন।
তার প্রতিষ্ঠিত প্রকৌশল উপদেষ্টা প্রতিষ্ঠান 'শহীদুল্লাহ অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস' এক সময় দেশের শীর্ষ প্রকৌশল প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা পেয়েছে। রেট্রোফিটিং কৌশল উদ্ভাবন করে শহীদুল্লাহ অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস দেশজুড়ে এক নির্ভরতার অগ্রপথিক হয়ে দাঁড়িয়েছিল। যেকোনো পুরানো ভবনের পরিসর বাড়াতে হবে, অথচ ভবন ভাঙা পড়বে না, ভবনের স্থাপনাগুলোর কোনো ক্ষতি করা যাবে না, ব্যবহারকারীদের অসুবিধা ঘটানো যাবে না—এর জন্য অন্যতম ভরসা ছিলেন দেশের সেরা প্রকৌশলীদের অন্যতম শেখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ।
ঢাকা স্টেডিয়ামসহ দেশের অনেক ছোট বড় স্থাপনায় শেখ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এ কৌশল প্রয়োগ করেছেন সফলতার সঙ্গেই। পরবর্তীতে তার বানানো নতুন প্রতিষ্ঠান 'শহীদুল্লাহ অ্যান্ড নিউ অ্যাসোসিয়েটস'।
পেশাগত প্রকৌশলী জীবনে তিনি অনন্য মেধায়, অসাধারণ দক্ষতায়, সততা, নিষ্ঠা ও শ্রমে দেশের প্রকৌশলী সমাজের গুরুত্বপূর্ণ ও স্মরণীয় স্থানে নিজেকে আসীন করেছেন। ঢাকা মহানগরসহ দেশের নানা প্রান্তে গুরুত্বপূর্ণ অনেক বৃহৎ সরকারি ও বেসরকারি স্থাপনার স্ট্রাকচারাল স্ট্রেন্থ গড়ে উঠেছে প্রকৌশলী শহীদুল্লাহর মেধা ও মননে। একটা বড় সময় ধরে দেশের যেকোনো জায়গায় যেকোনো ভবনে, যেকোনো বড় স্থাপনায় ফাটল ধরলে, বিপন্ন হলে তার প্রকৌশলগত সুরক্ষায় শেষ ভরসার দেশি মানুষ ছিলেন প্রকৌশলী শহীদুল্লাহ।
৫.
শেখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ দেশের তেল-গ্যাস-খনিজসম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষার আন্দোলনে আমৃত্যু ছিলেন সক্রিয়। দেশের সক্ষমতায় জনগণের মালিকানায় এ সম্পদ রক্ষা পাবে, সেই আন্দোলনের নিবেদিতপ্রাণ কর্মী, অপরিহার্য নেতাও ছিলেন তিনি। বামপন্থি দলগুলো আদর্শগত, রাজনৈতিক নানা মত পার্থক্যে নিজেদের মধ্যে নানা দূরত্ব তৈরি করলেও শেখ মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে কেন্দ্র করেই তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষার জাতীয় আন্দোলনে নিজেদের সংঘবদ্ধ রেখেছিল তার সক্রিয়তায় ও উদ্যমে।
১৯৯৮ সালেই 'জাতীয় স্বার্থে তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি' গঠিত হলে সর্বসম্মতিক্রমে এই কমিটির আহ্বায়কের পদ গ্রহণ করেন। তারই পৃষ্ঠপোষকতা ও নেতৃত্বে এই কমিটি জাতীয়স্বার্থ সুরক্ষায় এক অভাবিত ও অভূতপূর্ব সামাজিক আন্দোলনের নজির প্রতিষ্ঠা করে। দেশের বৃহত্তর স্বার্থে শেখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ সেই ঐক্য এবং সংগ্রামের দিকচিহ্ন হয়ে থেকেছেন আমৃত্যু।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পূর্বে প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে না জড়ালেও পিকিংপন্থি মার্কসবাদীদের প্রতি দুর্বল হন এবং তাদের কাজকর্মের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে পড়েন। ১৯৬৯ সালের ৯ ডিসেম্বর মার্কসবাদী পত্রিকা ছাপিয়ে গাড়িতে নিয়ে যাওয়ার সময় ঢাকার পিলখানার গেটের সামনে গ্রেপ্তার হন এবং তাকে জেলহাজতে পাঠানো হয়। পাকিস্তানি সামরিক আদালতে বিচার শুরু করতে বিলম্বের দরুন হাজতে সাড়ে পাঁচ মাস অবস্থান করতে হয়। সামারি মিলিটারি কোর্টে এক বছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন। ডিভিশন দিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে তাকে ফাঁসির আসামিদের জন্য নির্দিষ্ট কনডেম সেলে সাধারণ কয়েদিরূপে অবস্থান করতে বাধ্য করা হয়। এরপর বিভিন্ন জেলখানায় বন্দী থাকেন। অবশেষে বাংলাদেশ স্বাধীন হলে ১৯৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বর ঢাকার কেন্দ্রীয় জেল থেকে ছাড়া পান।
স্বাধীন বাংলাদেশে নিজে কখনো কোনো রাজনৈতিক দলের প্রত্যক্ষ সদস্য ছিলেন না। কিন্তু বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন। এ সহানুভূতি শুধু দার্শনিক, আদর্শিক, বুদ্ধিবৃত্তিক নয়, আর্থিকও বটে। প্রতি মাসে তিনি নিজে যা আয় করতেন, তার তিন ভাগের দুই ভাগ এ কাজে ব্যয় করেছেন। বহু বছর ধরেই এ আর্থিক প্রণোদনা জুগিয়ে এসেছেন সমাজ পরিবর্তনের কাজে নিবেদিত রাজনৈতিক ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক দল, ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠানগুলোকে।
৬.
প্রকৌশলী শহীদুল্লাহকে একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম আপনার শক্তির জায়গাটা কী? প্রকৌশলী শেখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ হাসতে হাসতে বললেন, আমি বিবেকানন্দের সেই লাইনটাকে খুব পছন্দ করি, 'জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর'।
জানতে চেয়েছিলাম, এই যে এত কিছুর মধ্যে জড়িয়ে আছেন, হতাশা আসে না? প্রকৌশলী শহীদুল্লাহ তার বিখ্যাত হাসিটা ধরে রেখেই বলেছিলেন, 'হতাশা জিনিসটা যেকোনো মানুষেরই পুরোপুরি ত্যাগ করা উচিত। এরপর মহাভারতের কাহিনী টেনে বললেন, 'অর্জুন শ্রীকৃষ্ণকে জিজ্ঞেস করছে, আমরা কি এই কুরুপাণ্ডবের যুদ্ধে জিতব? আপনি কি আশাবাদী? শ্রীকৃষ্ণ বলল, 'বাছা কর্মে তোমার অধিকার। ফলে অধিকার নাই। আমি মনে করি, কর্ম করে যাওয়াতেই আমার আনন্দ। ফল কতদূর লাভ হলো, কি হলো না, সে সম্পর্কে পুরোপুরি নিস্পৃহ, উদাসীন থাকা উচিত। একজন মানুষ সৎকর্মে নিয়োজিত থাকলে তা থেকেই সে আনন্দ পাবে। এটাই তার ফল লাভ। অন্য কী কী লাভ হলো তার হিসেবের কোনো দরকার নেই। আনন্দবোধটা আমাদের কর্মের থেকে আসবে, ফলের থেকে নয়। অতএব হতাশার কোনো প্রশ্ন আসবে না।'
প্রকৌশলী শহীদুল্লাহর বিশেষ বৈশিষ্ট্য নিজের চিন্তা এবং বিশ্বাস প্রকাশে তিনি ছিলেন অকপট। কারো কাছে মাথা নোয়াবার মানুষ তিনি নন। পাকিস্তানি জমানায় বামপন্থি বিশ্বাসের অপরাধে রিমান্ডে নিয়ে গিয়ে সামরিক গোয়েন্দারা অকথ্য নির্যাতন করেছে, কিন্তু তাকে একচুলও টলাতে পারেনি। তিনি জেল খেটেছেন, জেলে থাকা অবস্থায় তার পরিবার অবর্ণনীয় দুর্দশায় পড়েছে, কিন্তু তার চিন্তাগত অবস্থানের কোনো পরিবর্তন হয়নি।
প্রকৌশলী শহীদুল্লাহ আমাদের কালের নায়ক। আমাদের জন্য এক অনন্য প্রেরণা। জনস্বার্থে তার লড়াই, সততা, পরিশ্রম, মেধা, পেশাগত উৎকর্ষতা বহুকাল এই ভূ-খণ্ডের চিন্তাশীল, সমাজমনস্ক মানুষকে উৎসাহ ও প্রেরণা জোগাবে।
তার মৃত্যু এক অপূরণীয় ক্ষতি।
তার প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।
শুভ কিবরিয়া: সিনিয়র সাংবাদিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক
Comments