বাংলায় মহররম উদযাপনের প্রাচীন দলিল

৬১ হিজরিতে কারবালার ঐতিহাসিক হৃদয়দীর্ণ ঘটনাকে কেন্দ্র করে মহররম মাসে শহীদদের স্মরণে যে আয়োজন করা হয় তা মূলত শোকের স্মারক, শহীদদের প্রতি শোকাভিভূত শ্রদ্ধা নিবেদনের মাধ্যম। কিন্তু বাংলায় মহররম উদযাপনের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, শোকের স্মারক পরিণত হয়েছে উৎসবের ম‌ওসুমে; শোকের চেয়ে বেশি থাকে উৎসবের আমেজ। এ কারণে বাংলার উৎসবের ইতিহাসে মহররম একটি আলাদা জায়গা দখল করে আছে।

বাংলায় মহররম উদযাপনের ইতিহাস রচিত হয়েছে একাধিক। অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন 'বাংলাদেশের উৎসব' বইয়ে, ইতিহাসবিদ আবদুর রহিম 'বাংলার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস' বইয়ে, এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে প্রকাশিত 'বাংলার ইতিহাস' তৃতীয় খণ্ডে উঠে এসেছে মহররম উদযাপনের ইতিহাস ও ধারাবাহিকতার নজির। লেখকরা কেবল ঢাকা, হুগলি ও মুর্শিদাবাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলেন।

অথচ ষোড়শ শতকে অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণভাবে মহররম উদযাপনের ইতিহাস আছে রাজশাহীর হজরত শাহ মখদুমের মাজার প্রাঙ্গণে। এর সপক্ষে আছে উদযাপনের লিখিত বিবরণ। কিন্তু এই ইতিহাস এসব বইয়ের কোথাও নেই। অথচ বাংলার সাংস্কৃতিক ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ দলিল এই ঐতিহাসিক সূত্রটি। দলিলটি পাকিস্তান আমলের অন্তিমলগ্নে উদ্ধার করেছিলেন অধ্যাপক মুহম্মদ আবূতালিব। তিনি কীভাবে এই ঐতিহাসিক দলিল আবিষ্কার করেছিলেন তা এখানে সংক্ষেপে আলোকপাত করা হলো।

পাণ্ডুলিপির বিবরণ সূত্রে জানা যায়, ১৬৬৫ সালে বাদশাহ আওরঙ্গজেব নদীপথে বাংলা ভ্রমণ করেন। ভ্রমণকালে হজরত শাহ মখদুমের মাজার প্রাঙ্গণে যাত্রাবিরতি করেন। মাজার প্রাঙ্গণে উপস্থিত হয়ে তৎকালীন খাদেমদের কাছে হজরত শাহ মখদুমের শাজরা এবং অন্যান্য ইতিহাস জানতে চান। কিন্তু বাদশার সামনে হাজির করার মতো লিখিত তেমন কিছু তাদের কাছে ছিল না। এ অবস্থায় খাদেমদের সিদ্ধান্তে ফারসি ভাষায় একটি বই লেখা হয়। যেখানে হজরত শাহ মখদুমের বাংলায় আগমন এবং পরবর্তীকালের ইতিহাসের বর্ণনা আছে। মূল পাণ্ডুলিপিতে মাজারের তৎকালীন দশজন খাদেমের নাম ও স্বাক্ষর পাওয়া যায়। ১০৭৬ হিজরির ২২ সফর মোতাবেক ১৬৬৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে এই ঐতিহাসিক বইটির রচনা হয়।

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পর যখন ইংরেজ সরকার লাখেরাজ সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা শুরু করল, তখন ১৮৩৭ সালে শাহ মখদুমের মাজার এস্টেটের লাখেরাজ সম্পত্তি নিয়ে ইংরেজ সরকার মামলা দায়ের করে। ১৮৩৮ সালে মামলার নিষ্পত্তি হয় এবং রায় মোতাবেক মাজার এস্টেটের লাখেরাজ সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়। কিন্তু মাজার কর্তৃপক্ষ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে। আপিল পরবর্তী সময়ে তারা যেসব দলিলপত্র আদালতে পেশ করে তার মধ্যে উক্ত ফারসি পাণ্ডুলিপির বাংলা অনুবাদটিও ছিল। কেবল আদালতে হাজির করার জন্য‌ই পাণ্ডুলিপিটি অনুবাদ করা হয়। অনুবাদকের নাম জানা যায়নি। অনুবাদকাল ১২৪৫ বঙ্গাব্দ মোতাবেক ১৮৩৮ খ্রিস্টাব্দ। রাজশাহীর কালেক্টরের মহাফেজখানার নথিতেও এ পাণ্ডুলিপির ব্যাপারে লিখিত রয়েছে, 'হজরত শাহ্ মখ্‌দুম রূপোষ আউলিয়ার ফারসি ভাষায় লিখিত জীবনী তোয়ারিক জরাজীর্ণ অবস্থার দরুন ফারসি গ্রন্থ থেকে বাংলা ভাষায় তিন কিতা জীবন চরিত রচনা করা হ‌ইল ও দুই কিতা মখ্‌দুম সেরেস্তায় দাখিল করা হ‌ইল।'

অধ্যাপক মুহম্মদ আবূতালিব রাজশাহীর মহাফেজখানা থেকে ওই বাংলা অনুবাদের পাণ্ডুলিপি সংগ্রহ করেন। এ অনুবাদের সাপেক্ষে তিনি ১৯৬৭ সালে রচনা করেন 'মুসলিম বাংলা গদ্যের প্রাচীনতম নমুনা' প্রবন্ধ। বাংলা একাডেমী পত্রিকা শ্রাবণ-আশ্বিন ১৩৭৪ সংখ্যাতেও এই অনুবাদের অংশবিশেষ প্রকাশিত হয়েছিল। কিন্তু সমগ্র অনুবাদটি একসঙ্গে গ্রন্থাগারে প্রকাশিত হয় ১৯৬৯ সালের জানুয়ারিতে—'পাকিস্তান বুক করপোরেশন' থেকে।

পাণ্ডুলিপিতে অন্যান্য ইতিহাসের সঙ্গে গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখিত হয়েছে বাৎসরিক মহররম উদযাপনের ইতিহাস‌ও।

'মহরম শরীফের উৎসব' শিরোনামের পুরো অংশটি কৌতূহলী পাঠক ও গবেষকদের জন্য তুলে ধরছি, 'মহরম মাসে প্রথম হ‌ইতে দশ দিবস আস্তানা ও কারবালা আলোকমালায় সুসজ্জিত করা হয়। আবরোকের টাটী দ্বারা আস্তানা সাজান হয়। এমামবাড়ী সাজান হয়। তাজিয়া ধৌত করিবার সময় মহা ধুম করিতে হয়। তৎপর সাজান হয় ১০দিন দিবারাত্র নহবৎখানায় বাদ্য হয়। মাতম, বাঙ্গালা মর্ছিয়া, হিন্দি মর্ছিয়া, উর্দ্দু পার্শী মর্ছিয়া হ‌ইয়া থাকে। স্ত্রীলোকের মাতম হয়। ঐ মাতম সময় পুরুষ লোক আসা নিষেধ। কেহ পুরুষ লোক আসে না। বদ্ধি ধারণ করিতে হয়। সবুজ রঙ্গের শোক পরিচ্ছেদ পরিধান করিতে হয়।'

'১০ দিবস রোজা রাখিতে হয়। দুনিয়াদারী সমস্ত রকম সুখ হ‌ইতে বঞ্চিত থাকিতে হয়। মাছ মাংস তৈল ব্যবহার হ‌ইতে বঞ্চিত থাকিতে হয়। নিজপক্ষ হ‌ইতে প্রত্যহ শরবৎ ও খিচুড়ি করিয়া গরীব দুঃখীকে খয়রাৎ করিতে হয়। কাতল রাত্রিতে মহাধুমে বাদ্যসহ আলোকমালায় আলোকিত করিয়া তাজিয়া ল‌ইয়া ৭ বার প্রদক্ষিণ করা হয়। পরদিবস মঞ্জিল দিনে তাজিয়া সহিত নানা বাদ্যসহ মিছিল বাহির করিয়া বহুদূর বেড়ান হয়। সঙ্গে মাতম মর্সিয়া গাওয়া হয়। কতলের রাত্রিতে মঞ্জিলের দিনে সর্বসাধারণের গ‌ঁওরা তাজিয়া নানা বাদ্য ও মিছিল সহ মর্সিয়া মাতম গাহিতে গাহিতে আস্তানা এমামবাড়ীতে উপস্থিত হ‌ইয়া মখ্‌দুম সাহেবের তাজিয়া, এমামবাড়ী ও আস্তানাকে সম্মান প্রদর্শন করিয়া থাকে। কাসেদের বহুদল আসিয়া থাকে সর্বসাধারণের শরবৎ ও খিঁচড়ার দ্বারা এমামবাড়ী পূর্ণ হ‌ইয়া যায় ও খয়রাৎ করা হয়।'

'ঐ দিবস সর্বসাধারণের আখড়া আসিয়া আস্তানা প্রাঙ্গণ ও কারবালায় পরিপূর্ণ হ‌ইয়া যায়। লাঠি, ঢাল, তলোয়ার, নেজা, বর্শা, গোর্জ্জ—নানারূপ অস্ত্র দ্বারা হিন্দু মোছলমান একত্রিতে রোমহর্ষণ খেলা হ‌ইয়া থাকে। মল্লকুস্তী করা হয়। নানারূপ বীরত্বের পরিচয় দেওয়া হয়। ৬০/৭০ হাজারের বেশী লোকের সমাগম হ‌ইয়া থাকে। মহরম বর্ণনা করা একরূপ সাধ্য রহিত। মঞ্জিল দিবসে সমস্ত দিন ধরিয়া সন্ধ্যার সময় (অনুষ্ঠান) সমাধা হ‌ইয়া থাকে। ঐ দশ দিবসে বহু টাকা আয় হয়! সর্বসাধারণের হাজত নিয়াজ হিন্দু মোছলমান দ্বারা দৈনিক গড়ে ১ মণ ২ মণ সন্দেশ, জিলাপী, বাতাসা ও ১০০/১৫০ শত মোরগ ও ১/২ মণ আতপ চাউলের ভাত হ‌ইয়া থাকে।'

ওই বর্ণনায় কিছু মজার ব্যাপার লক্ষ্য করা যায়। এমন কিছু ঘটনার কথা আছে যেগুলো এখন আর তেমন দেখা যায় না। যেমন- নারীদের মার্সিয়া গেয়ে মাতম করার একটি নির্দিষ্ট সময় ছিল, যেখানে পুরুষদের প্রবেশ ছিল নিষেধ। আবার বর্তমানে যেভাবে মহররমের সময় শোকের রঙ হিসেবে কালো কাপড় পরতে দেখা যায়, তখন শোকের কাপড় হিসেবে সবুজ রঙের কাপড় পরা হতো। আগত দর্শনার্থীদের জন্য বিনামূল্যে শরবত ও খিচুড়ি বিতরণের আয়োজন বর্তমানেও অনেক জায়গায় জারি আছে। মহররমে লাঠি খেলা গ্রাম বাংলার অন্যতম জনপ্রিয় সংস্কৃতির একটি। আল মাহমুদের আত্মজীবনীতে লাঠিখেলার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ পাওয়া যায়।

রাজশাহীতে মহররম উদযাপনের এই বর্ণনা ১৬৬৫ সালের আগেকার ব্যাপার। উদযাপনের সূচনা কত সালে তা জানা যায়নি। তবে সতেরো শতকের এই বিবরণ মহররম উদযাপনের ইতিহাসকে নতুন করে গড়ে তোলার প্রণোদনা দেয়। ঢাকায় মুঘল রাজধানী প্রতিষ্ঠিত হ‌ওয়ার আগেই রাজশাহীতে এই উদযাপনের শুরু হয়েছিল কি-না এ নিয়েও আলোচনা চলতে পারে। মুঘল রাজধানী প্রতিষ্ঠার আগেই যদি রাজশাহীতে মহররম উদযাপন শুরু হয়ে থাকে তাহলে মহররম উদযাপনের পেছনে মুঘল ও শিয়া শাসকদের একচ্ছত্র আধিপত্যের বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করতে হবে। বদলে যেতে পারে গতানুগতিক ইতিহাসের ধারাও।

মহররমের বিবরণী ছাড়াও, বাংলা গদ্যের নিদর্শন হিসেবেও এর অসাধারণ গুরুত্ব রয়েছে। মুসলমানদের গদ্য লেখার যত প্রাচীন দলিলপত্র পাওয়া যায় তার মধ্যে এটি অন্যতম। মুহম্মদ আবূতালিব বলছেন, 'রচনাকালের দিক দিয়েও গ্রন্থখানি বিদ্যাসাগরের 'বেতাল পঞ্চবিংশতির' নয় বৎসর পূর্বেকার (১২৪৫ সন = ১৮৩৮ ঈ.)। এবং বলেছি, মুসলিম বাংলা গদ্যের‌ও এখানি প্রাচীনতম গ্রন্থ।' ফলে, এই বইটি কেবল ধর্মীয় বিষয়বস্তু ছাড়াও মুসলিম রচিত গদ্যের আদি নিদর্শন হিসেবেও ভাষা ও সাহিত্য গবেষকদের জন্য আকর্ষণীয়।

উল্লেখ্য যে, ব‌ইটি প্রকাশের পূর্বে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ একটি শুভেচ্ছাবার্তা লিখে দিয়েছিলেন। তিনি লিখেছিলেন, 'ইহা কেবল এক পীরের জীবনী নয়, বরং রাজশাহীর ইতিহাসের এক বিস্মৃত অধ্যায়ের আবিষ্কার। পীর সাহেবের জীবনী মূলে ফারসী ভাষায় লিখিত; কিন্তু তাহার বঙ্গানুবাদ হয় ১২৪৫ সনে। আমাদের গণনানুসারে বর্তমানে ইহাই মুসলিম বঙ্গের প্রাচীনতম গদ্য রচনা। সুতরাং ইহাকে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে একটি নূতন অধ্যায় বলিতে হয়।'

পাকিস্তান আমলে এই ঐতিহাসিক বই আবিষ্কৃত ও প্রকাশিত হলেও অদ্যাবধি আমাদের গবেষক মহলের কাছে এটি 'অনাবিষ্কৃত' থেকে গেছে। প্রকাশের ৫৫ বছর পর‌ও এটি থেকে গেছে 'নূতন অধ্যায়' হিসেবে। কোনো ইতিহাসবিদের হাত ধরে, কবে এই ঐতিহাসিক বইয়ের সদ্ব্যবহার হবে তা সময়ই বলে দেবে।

Comments

The Daily Star  | English
COP29 protest

COP29 negotiations: The deadlock over cardinal issues

Developing countries require about $6-8 trillion a year for climate action but some analysts view this as sleight of hand accounting.

25m ago