দেখছি শহর তলিয়ে যাচ্ছে, মৃত্যু আমায় ভয় দেখাচ্ছে!

বৃষ্টির পানিতে ডুবে যাওয়া রাজধানীর আরামবাগ এলাকা। ১২ জুলাই ২০২৪। ছবি: আনিসুর রহমান/স্টার

প্রায় দুই কোটি মানুষের এই 'ভয়ের' নগরে উপর থেকে ইট পড়ে মারা যায় পথচলতি মানুষ। পায়ের নিচের খোলা ম্যানহোল পেতে রাখে আরেক মৃত্যুফাঁদ। বিশৃঙ্খল সড়কের বেপরোয়া যান যখন-তখন যতি টেনে দেয় জীবনের। কিছু বুঝে ওঠার আগেই হঠাৎ বিস্ফোরণ কিংবা ছুটে আসা রাজনীতির গুলিতে অনেক সাধের জীবন উড়ে যায়। আবার জতুগৃহ হয়ে ওঠা এ মহানগরে পুড়ে মরা, পিটিয়ে মারার উদাহরণও ভুরি ভুরি।

ধরা যাক এর কিছুই ঘটল না। কিন্তু আয়ু ক্ষয়কারী ভয়ঙ্কর দূষিত বাতাস ও পূতিগন্ধময় পরিবেশে শ্বাস নিতে নিতে এখানে কমে আসতে থাকে জীবনের দৈর্ঘ্য। শরীর হয়ে ওঠে নানা রোগের ঘরবসতি। বাড়ে বিষণ্নতা, বাড়ে ক্লান্তি।

এমন জীবননাশী রাজধানীতে এতকিছুর সঙ্গে নতুন এক প্রবণতা যুক্ত হয়েছে। তা হলো—জমে থাকা বৃষ্টির পানিতে বিদ্যুতায়িত হয়ে মৃত্যু।

জমে থাকা বৃষ্টির পানি বিদ্যুতায়িত হয়ে গেলে সেখানে থাকা মানুষের মৃত্যু প্রায় অবধারিত। ছবি: স্টার

নদী-খাল-জলাশয় খুন করে বানানো এ শহরের সড়ক-মহাসড়ক-অলিগলি সামান্য বৃষ্টিতেই একেকটি খাল-নদী-জলাশয় হয়ে ওঠে। এর সবশেষ উদাহরণ দেখা গেল গত ১২ এপ্রিল; শুক্রবার।

সেদিন আষাঢ়ের ভোর থেকে আধাবেলার ভারী বর্ষণ ভয়ঙ্কর জলাবদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি করে প্রায় পুরো ঢাকাজুড়ে। কোথাও কোথাও সেই পানি নামতে ২৪ থেকে ৩৬ ঘণ্টাও লেগে যোয়। বর্ষায় সাপ্তাহিক ছুটির ভোরে ঝুম বৃষ্টিতে আয়েশি ঘুমের সুযোগ যাদের ছিল না, তারা ঘরের বাইরে বের হয়ে পড়েন থই থই পানিতে। ডুবে যায় উঁচু-নিচু সড়ক ও পাড়া-মহল্লার অলি-গলি। তাতে প্রচণ্ড নাকাল হন গন্তব্যে পৌঁছাতে ঘরের বাইরে পা রাখা মানুষগুলো।

রাস্তা উপচে ময়লা পানি ঢুকে যায় বাজার, দোকান, বিপনীবিতান, হাসপাতাল ও বিশ্ববিদ্যালয়সহ অনেক বাসাবাড়িতে। রাস্তায় বিকল হয়ে পড়ে থাকতে দেখা যায় প্রাইভেট কার, অটোরিকশা, বাস। তৈরি হয় যানজট।

এর চেয়েও ভয়াবহ ঘটনা ঘটে যায় মিরপুর, ভাসানটেক ও সূত্রাপুরে। জমে থাকা পানিতে বিদ্যুতায়িত হয়ে মারা যান চারজন। তাদের ভেতর দুইজন মারা যান তাদের কারখানার যন্ত্রপাতি সরাতে গিয়ে, একজন মারা যান নিজের ঘরে, আরেকজনের মৃত্যু হয় রাস্তায় বিদ্যুতের খুঁটি ধরায়।

পদে পদে ঝুঁকি। ছবি: পলাশ খান/স্টার

এই খবর আসে শনিবার রাতে। পুলিশের সূত্রে। পুলিশ জানায়, বিদ্যুতায়িত হয়ে মারা যাওয়া এই মানুষগুলোর সবাই শ্রমজীবী। তারা হলেন— কাঠমিস্ত্রি রাসেল দাস ও তার সহকারী আলাউদ্দিন, নির্মাণ শ্রমিক আব্দুন নূর এবং রংমিস্ত্রী আইয়ুব আলী।

তাদের মৃত্যুর খবরে মনে পড়ে যায় গত বছরের সেপ্টেম্বরের আরেক দুর্যোগময় রাতের কথা। সে রাতে গত শুক্রবারের মতোই মহাজলজটে ঢাকায় যেন দোজখ নেমে আসে। সড়কে আটকা পড়ে সীমাহীন দুর্ভোগ পোহান নগরবাসী। আর সবচেয়ে হৃদয়বিদারক ঘটনাটি ঘটে মিরপুরে। কমার্স কলেজ–সংলগ্ন ঝিলপাড় বস্তির বিপরীত পাশে জলাবদ্ধ সড়কে বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে পড়ায় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হন একই পরিবারের চারজন। তাদের তিনজনই মারা যান। ওই পরিবারের সাত মাস বয়সী শিশুকে বাঁচাতে গিয়ে মৃত্যুকে কাছে টেনে নেন এক তরুণ সিএনজিচালক।

এরও বছরদুয়েক আগে একই রকম পরিস্থিতিতে গ্রিনরোডে বিদ্যুতায়িত হয়ে এক তরুণ শিক্ষানবিশ চিকিৎসকের মৃত্যু হয়।

সুদূর প্যারিসে মাটির ৬৬ ফুট নিচে এক বিশাল সমাধিক্ষেত্র আছে। মাটির নিচে ওই সমাধিক্ষেত্রটির পত্তন হয় আঠারো শতকের দিকে। তখন বিশেষ করে মহামারির কারণে প্যারিসে মৃত ব্যক্তিদের সৎকারের জায়গা ও স্বাস্থ্য সংকট দেখা দেয়। ফলে পৌর কর্তৃপক্ষ শহরের বেশ কয়েকটি সমাধিভূমি থেকে মানুষের দেহাবশেষ সরিয়ে নিয়ে শহর থেকে দূরে মাটির নিচে বিশাল কোনো প্রশস্ত জায়গায় জমা করার সিদ্ধান্ত নেয়।

সে অনুসারে ১৭৮৫ সাল থেকে বিভিন্ন পর্যায়ে প্যারিসের ১৪টি উপশহরে বিশ্বের সবচেয়ে বড় মানবকঙ্কালের সমাবেশ ঘটানো হয়। নাম দেওয়া হয় 'ক্যাটাকম্বম' বা 'পাতালসমাধি'। পরে ১৮০৯ সাল থেকে ওই মৃত নগরীর দ্বার সবার জন্য আংশিক খুলে দেওয়া হয়। এর প্রবেশপথে এখনো লেখা আছে, 'থামুন! এখানেই মৃত ব্যক্তিদের সাম্রাজ্য'।

যে ভোগান্তির শেষ নেই। ছবি: স্টার

প্রায় ৪০০ বছরের পুরোনো শহর ঢাকার চার প্রবেশপথের কোথাও এমন কোনো বার্তা লেখা নেই। কিন্তু এই একবিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিংবা মহামারি ছাড়াই কেবল মানবসৃষ্ট কারণে এখানে যত মানুষের মৃত্যু হয়, তাতে এ শহরকে এখন 'মৃত্যুনগরী' বললেও অত্যুক্তি হবে না।

সবচেয়ে বিপজ্জনক বিষয়টি হলো, এ নিয়ে নগর কর্তৃপক্ষ কিংবা সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থাগুলোর মাথাব্যাথা আছে বলেও মনে হয় না। নাহলে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি কেন হবে? জলাবদ্ধতা নিরসন কিংবা বৃষ্টির জমে থাকা পানিতে বিদ্যুতায়িত হয়ে মৃত্যু ঠেকাতে কেন কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হবে না এত বছরেও?

শহর কলকাতার প্রেক্ষাপটে শিল্পী কবীর সুমন গেয়েছিলেন, 'ধাপার মাঠের গন্ধ নিয়ে/চলছি তোমার রাস্তা দিয়ে/নর্দমাতে সাঁতার দিচ্ছে কলকাতা/রুমাল চেপে নাকেমুখে/বাঁচতে চাইছি কপাল ঠুকে/মৃত্যু আমায় ডাক পাঠাচ্ছে কলকাতা।'

ঢাকার এখনকার পরিস্থিতিকে কি সুমনের গানের এই বর্ণনা থেকে খুব আলাদা করা যাচ্ছে?

এদিকে এক বৃষ্টির ধাক্বা সামলাতে না সামলাতেই আগামী শুক্রবার থেকে ফের ভারী বৃষ্টির আভাস দিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। এই পূর্বাভাস যদি সত্য হয় তাহলে ঢাকা যে আবার ডুববে, সে ব্যাপারে নিশ্চিতই থাকা যায়।

এক্ষেত্রে এবারও কি আমরা আরও মৃত্যুর অপেক্ষায় থাকব?

Comments

The Daily Star  | English

Leading univs withdrawing from cluster system

Undergraduate admission tests under the cluster system faces uncertainty for the 2024-25 academic year, as several prominent universities have decided to withdraw and conduct their own admission tests independently. 

9h ago