এখনো মানুষের স্বপ্ন আছে, মনুষ্যত্ব আছে

লেখক, গবেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী তার ৮৯তম জন্মদিন উপলক্ষে গত ২৯ জুন শিশু একাডেমি মিলনায়তনে (ফিরে দেখা) একক আত্মজৈবনিক বক্তৃতা দেন। বক্তৃতায় উঠে আসে তার মুক্তিযুদ্ধের আগে-পরের সমাজ, রাষ্ট্র ও রাজনীতির নানা অনুষঙ্গ ও স্মৃতি, শৈশবের দিনগুলো। সবমিলিয়ে তার বক্তৃতাটি যেন ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসেরই অংশ।

আত্মজৈবনিক বক্তৃতার কথাগুলো পাঁচ পর্বে প্রকাশিত হবে দ্য ডেইলি স্টার বাংলায়। দীর্ঘ বক্তৃতাটি অনুলিখন করেছেন মোস্তফা মুশফিক ও ইমরান মাহফুজ। আজ প্রকাশিত হচ্ছে শেষ পর্ব।

আমাদের সাহিত্যে যে পরিবর্তনগুলো হলো এর চরিত্র কী সেটা ধরার জন্য আমি সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর কথা বলব। ওয়ালীউল্লাহ অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন, পঞ্চাশ বছরও বাঁচেননি, তার আগেই মারা গেছেন। তিনি পাকিস্তান দেখেছেন, ব্রিটিশ দেখেছেন তো বটেই, তারপর তিনি মুক্তিযুদ্ধ দেখেছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি প্যারিসে ছিলেন। পাকিস্তান সরকার তার চাকরি নিয়ে নিয়েছে। ইউনেস্কোর চাকরি করে অত্যন্ত আবেগে আপ্লুত ছিলেন।

ওয়ালীউল্লাহ অত্যন্ত পরিশ্রম করছিলেন বাংলাদেশের পক্ষে সমর্থন আদায়ের জন্য। এর মধ্যেই হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে তার মৃত্যু ঘটে। ওয়ালীউল্লাহর বিখ্যাত গল্প হচ্ছে 'নয়ন তারা'। দুর্ভিক্ষ নিয়ে লেখা, ওই পঞ্চাশের দুর্ভিক্ষ নিয়ে। তার লেখা বই 'লালসালু', ১৯৪৮ সালে বেরিয়েছে। লালসালুতে তিনি কী দেখছেন, অল্প বয়সে, ২৫ বছর বয়সে ধর্ম নিয়ে ব্যবসা হবে, এখানে রাজনৈতিক শক্তি ধর্মকে ব্যবহার করা হবে। মজিদ একটা ভুয়া দরবেশ। সে একটা ভুয়া কবরকে দরবেশের কবর বানিয়ে অত্যাচার করবে মানুষের উপর। তিনি বলেছেন সেই বিখ্যাত কথা, 'শস্যের চেয়ে টুপি বেশী, ধর্মের আগাছা বেশী'। অবস্থা এরকমই খারাপ যে টুপির সংখ্যা বেশি।

মজিদ শেষ পর্যন্ত কিন্তু পরাজিত হলো। পরাজিত হলো তার দ্বিতীয় স্ত্রীর কাছে। ঝড়ের রাতে সব তছনছ হয়ে গেছে। মাজারে গিয়ে দেখে, সেই কিশোরী স্ত্রী কবরের উপর পা তুলে দিয়ে ঘুমাচ্ছে। এখানে তিনি পরাজিত হয়ে গেলেন। এটা ওয়ালীউল্লাহ দেখলেন।

তারপর ১৯৬৪ সালে তার উপন্যাসের নাম 'চাঁদের অমাবস্যা'। এটা কিন্তু আইয়ুব খানের শাসন। চাঁদ আছে কিন্তু অমাবস্যাও আছে। অমাবস্যা কেটে যাবে এমন একটা ভাব। '৬৮ সালে কিন্তু তিনি লিখছেন, উপন্যাস 'কাঁদো নদী কাঁদো'। তখন তিনি বুঝতে পারছেন এই শাসন আইয়ুব খানের শাসন। অমাবস্যা কাটেনি, এখানে নদী কাঁদছে। সেই নদীর কান্না কিন্তু আমরা জানি, আমাদের সব উন্নতি হয়েছে, কিন্তু নদীর কী দুর্দশা হয়েছে। বন্যার কী হয়েছে, খরার কী হয়েছে দেখতে পাচ্ছি।

ওয়ালীউল্লাহ নদীর কান্না শুনেছিলেন। একাত্তর সালের স্বাধীনতার যুদ্ধে ওইভাবে অংশ নিচ্ছিলেন। স্বাধীনতা আসবে, তার আগেই চলে গেলেন। মধ্যে তিনি একটা ইংরেজি উপন্যাস লিখেছেন ১৯৫৯ থেকে ১৯৬৩ এর মধ্যে। তার নাম হচ্ছে 'আগলি নেশন'। এটাই হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদ কীভাবে ঢুকে পড়ছে, সেই ঢুকে পড়ার জায়গাটাকে এবং তার বিরুদ্ধে কীভাবে এখানকার বামপন্থীরা আন্দোলন করছে সেটাকে কেমন করে দমন করা হচ্ছে তার একটা ছবি, তিনি ইংরেজিতে লিখেছেন, তা ধরা পড়ছে সাহিত্যে।

আর দুজন লেখকের কথা বলি—ফররুখ আহমেদ এবং আবদুল হক। এরা দুজনই খুব বন্ধু ছিলেন এবং দুজনেই একসময় সমাজপন্থি ছিলেন। ফররুখ আহমেদ পাকিস্তানপন্থি হলেন এবং ১৯৭৪ সালে খুব করুণ অবস্থায় মারা গেলেন। ফররুখ আহমেদের 'সাত সাগরের মাঝি' কবিতাটি অসাধারণ কবিতা, কিন্তু ওই যে পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদ তাকে শেষ করে দিলো!

আবদুল হক রাজনীতিবিদ ছিলেন। তিনি প্রবন্ধ লিখেছেন বাঙালি জাতীয়তাবাদের পক্ষে, লিখেছেন মুসলিম জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে। তার বিরুদ্ধে পুলিশ তদন্ত করেছিল। বাংলাদেশ যখন স্বাধীন হলো তখন তিনি দেখলেন, তিনি লিখতে পারছেন না। তিনি সম্পাদনা করছেন কিন্তু লিখতে পারছেন না। তিনি বইয়ের নাম দিয়েছেন 'ক্রান্তিকাল', ১৯৬২ সালে। আশা করছেন বদলাবে। তারপরে ১৯৭৪ সালে তিনি বই লিখছেন, নাম দিচ্ছেন 'স্বাধীনতা ও স্বাধীনতা'।

স্বাধীনতার দরকার কী তিনি ওই বইয়ের মধ্যে, একটা প্রবন্ধ আছে, সেখানে তিনি সাম্রাজ্যবাদের অন্তিম দশার কথা বলছেন। আবার তিনি এও বলছেন যে, ইয়েটসের (উইলিয়াম বি. ইয়েটস) যে নাটকগুলো তিনি অনুবাদ করছেন এটাতে তো বোঝাই যাচ্ছে, তিনি পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে বলছেন। ওই যে তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদের মধ্যে আটকে আছেন, তিনি যে উদারনীতি থেকে বাইরে যেতে পারছেন না, তাকে হতাশ হতে হচ্ছে, নিঃসঙ্গ হতে হচ্ছে এবং একসময় তিনি স্মৃতিভ্রষ্ট হয়ে পড়লেন।

অন্যদিকে '৬৯ এর অভ্যুত্থান কেন আমাদেরকে মুক্তি দিতে পারল না? এখানে তো সমাজতন্ত্রীরা ছিল, জাতীয়তাবাদীরা ছিল। সমাজতন্ত্রীরাই বেশি সংঘটিত ছিল। এই অর্থে যে তাদের সংগঠন শক্তিশালী ছিল। দিবা দত্তের সঙ্গে দেখা হয়েছে এখানে। দিবা দত্ত আমাদের এই নতুন দিগন্তে নতুন সংখ্যায় একটা প্রবন্ধ লিখেছেন '৬৯ এর উত্তাল দিনগুলো' নামে। সেখানে তিনি দুটো ঘটনা স্মরণ করেছেন। একটা ঘটনা হচ্ছে ফেব্রুয়ারি মাসে। অভ্যুত্থান ২৪ জানুয়ারি হয়ে গেছে, ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে তারা ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে গ্রুপ করে করে বিভিন্ন জায়গায় গেছেন এবং যেখানেই গিয়েছেন দেখতে পাচ্ছেন যে ধনী লোকেরা তাদেরকে খুব সমাদর করছেন। তখন তার মনে হলো আমাদের যে সংগ্রাম সেই সংগ্রাম তো এদেরই বিরুদ্ধে! আমাদের যে সংগঠন তাহলে তো এদের হাতে চলে গেল। এই অভিজ্ঞতাটা তিনি লিখেছেন।

দ্বিতীয় যে অভিজ্ঞতা হলো সেটা খুব মর্মান্তিক। উনি রেলস্টেশনে যাচ্ছেন, তাদের বক্তৃতা করতে হচ্ছে। ট্রেন থামাতে হচ্ছে ঈশ্বরদীতে গিয়ে। যখন সেখানে বক্তৃতা দিচ্ছেন, অনেক লোক হচ্ছে। সেখানে বিহারি কলোনি, সেখান থেকে ছেলেরা এসেছে। সেই ছেলেরা তাদের সংগঠনে, অর্থাৎ চীনপন্থি ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী। তারা বলছেন 'এক ধাক্কা অর দো', এরা কিন্তু পরিচয়ে অহংবাদী কিন্তু তারা আওয়াজ দিচ্ছে স্বাধীনতার পক্ষে, সমাজতন্ত্রের জন্য। তারপরে এদের কী পরিণতি হয়েছে? এই ছেলেদের কী পরিণতি হয়েছে? এই পরিণতিও তো ওই মেহেরুননেছার পরিণতি। মেহেরুননেছাকে যেভাবে পাকিস্তান জাতীয়তাবাদীরা ঝুলিয়ে দিয়েছিল, বাঙালি জাতীয়তাবাদীরাও এই বিহারি সমাজতন্ত্রীদের হত্যা করল।

এত কিছুর পরেও আমি আশাবাদী। কেন এখনো আশাবাদী। কারণ হচ্ছে যে মানুষ স্বপ্ন দেখে এবং স্বপ্ন না দেখলে মানুষ মানুষ থাকে না। আমাদের  কিছুদিন আগে একটা বই বেরিয়েছে, সে বইয়ের নাম আমি দিয়েছি 'স্বপ্ন ছিল স্বপ্ন থাকবে', এ স্বপ্ন আছে বলেই আছি এখনো।

বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে যে তারুণ্য দেখি। তারা এখনো যে এই উপনিবেশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে সেটা দেখে আমরা আশাবাদী হই। তারুণ্যকে নষ্ট করার জন্য যত রকমের কায়দা আছে সব করা হচ্ছে, আপনি ভাবতে পারেন আমাদের ছাত্র সংসদ ডাকসু, এদের কোন নির্বাচন নেই এবং দেশে গণতান্ত্রিক সরকার আছে এরা তারুণ্যকে ভয় করে।

আরেকটা কারণের দৃষ্টান্ত দিয়ে বলি। আনু মুহাম্মদের কথা উল্লেখ করছি, তিনি দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন, কাটাই পড়ে যাচ্ছিলেন। তার সহযাত্রী তাকে ধাক্কা দিয়ে বাঁচিয়ে দিয়েছে। আনু মুহাম্মদ যখন আহত হয়েছেন, প্লাটফর্মে পড়ে গেছেন। এর মাঝে কেউ মোবাইলে ছবি তুলছে, একজন নাকি ভিডিও তুলছে। কিন্তু একজন লোক ছুটে এসেছে! ছুটে এসে সাহায্য করছে, লোক সাহায্য করলেন, সিএনজি ডেকে আনলেন।

পরে খবরের কাগজ পড়ে উদ্ধারকারী জানলেন তার পরিচয়। ইমার্জেন্সিতে খোঁজ নিয়েছেন, সেখান থেকে খোঁজ নিয়ে বার্ন ইউনিটে গিয়ে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। তার পরিচয় তিনি পুরান ঢাকার মানুষ। মশলা ব্যবসায়ী। এই যে মানুষ আছে, মনুষ্যত্ব আছে, ভালো মানুষ আছে। অধিকাংশ মানুষ ভালো, অধিকাংশ মানুষই চায় পরিবর্তন। কিন্তু এই যে ব্যবস্থা, সে ব্যবস্থা মানুষকে মানুষ থাকতে দিচ্ছে না, মানুষের মনুষ্যত্ব কেড়ে নিচ্ছে।

মানুষ হচ্ছে খুব সামাজিক জীব। মানুষ চিন্তা করে খুব সামাজিকভাবে, মানুষ বিকশিত হয় সামাজিকভাবে। সেই সামাজিকতা তুলে নেওয়া হয়েছে। আর এ কথা তো সত্য যত উন্নতি হচ্ছে তত বিচ্ছিন্নতা বাড়ছে, বেকারত্ব বাড়ছে, বৈষম্য বাড়ছে। এই যে বেকারত্ব বৃদ্ধি, বৈষম্য বৃদ্ধি, বিচ্ছিন্নতা বৃদ্ধি, এই সমস্ত কিছুই পুঁজিবাদী উন্নতির লক্ষণ এবং যে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার কথা গণতন্ত্রের কথা বুর্জোয়ারা বলে, সেই গণতান্ত্রিক অবস্থা আপনারা দেখছেন, আমরা তো দেখছি।

ইসরাইলের জায়নবাদী কিন্তু সমাজতন্ত্রীরা ভাবে ফিলিস্তিনিদের হত্যা করা হচ্ছে। তারা একসময় হত্যাযজ্ঞের শিকার হয়েছে, তারাই আবার ফিলিস্তিনিদের উপর এ নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে, শিশুদের হত্যা করছে, নারীদের হত্যা করছে। এটি হচ্ছে পুঁজিবাদী গণতন্ত্রের চেহারা। পুঁজিবাদ এখন শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেছে, এরপরে পুঁজিবাদের আর কিছু দেওয়ার থাকবে না।

তবে মানুষের মনুষ্যত্ব আছে, মানুষের স্বপ্ন আছে। সেই মানুষের উপর আস্থা আমাদের রাখতেই হবে, ওই যে ভালো মানুষটি তিনি অপরিচিত লোককে দেখলে এগিয়ে যান, হাসপাতালে রেখে আসেন, সেই মানুষটি; সেই মানুষেরা, আমাদের আশা। আমরাও সে মানুষ হওয়ার আশা ব্যক্ত করছি।

 

প্রথম পর্ব: এ সময় বিচ্ছিন্নতার

দ্বিতীয় পর্ব: পাকিস্তান অনেককে নিঃস্ব করে দিয়েছে

তৃতীয় পর্ব: বাংলাদেশের প্রতীক কী?

চতুর্থ পর্ব: আমরা যে আধুনিকতায় মানুষ হয়েছি

Comments

The Daily Star  | English

Economic expectations: Did govt fall short?

When an interim government was sworn into office following the ouster of the Awami League regime just 100 days ago, there was an air of expectation that the Prof Muhammad Yunus-led administration would take steps to salvage a scam-ridden financial sector and rescue an ailing economy.

7h ago